পুতিন মনে করেন তিনি যুদ্ধে জিততে যাচ্ছেন

আন্তর্জাতিক

তাতিয়ানা স্তানোভায়া, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস
19 July, 2022, 03:50 pm
Last modified: 19 July, 2022, 04:04 pm
পুতিনের বাজি হচ্ছে, পশ্চিমা দেশগুলোতে মৌলিক রাজনৈতিক পরিবর্তন তৈরি হলে তা একসময় একটি পরিবর্তিত ও বন্ধুত্বপূর্ণ পশ্চিমের সূচনা ঘটাবে।

সবকিছু পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছে।

কথাটা বলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেনের যুদ্ধ পাঁচ মাসে গড়িয়েছে, এখনো শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যুদ্ধের অবস্থা করুণ, কিন্তু ক্রেমলিনের বড়কর্তারা এখনো বারবার বলে যাচ্ছেন, এ যুদ্ধে রাশিয়া তার সবগুলো লক্ষ্য অর্জন করবে।

এটা বিশ্বাস করাটা কঠিন বলে মনে হতে পারে। কেননা, রাশিয়া কিয়েভ থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে, দেশটিকে অনেকগুলো সামরিক বিপর্যয় মোকাবেলা করতে হয়েছে, নজিরবিহীন মাত্রায় নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক মহল থেকে গণহারে তীব্র সমালোচনা শুনতে হয়েছে। তাই এতসব ব্যর্থতাকে সাফল্য হিসেবে দাবি করাটা কিছুটা প্রোপাগান্ডা, ভণ্ডামি বা আত্মবিভ্রম মনে হতে পারে।

তবে গত দুই দশকের বেশি সময় আমি প্রেসিডেন্ট পুতিনের কথা, আচরণ, ও সিদ্ধান্তগুলো নিবিড়ভাবে নিরীক্ষণ করেছি। এর ফলে প্রেসিডেন্টের হিসাবনিকাশের একটি বিস্তৃত দৃশ্যপট আমার চোখের সামনে ধরা দিয়েছে।

পাবলিক রেটরিক, বিভিন্ন নীতি, ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনার সুবাদে ক্রেমলিন আপাতত কী পর্যায়ের চিন্তাভাবনা করছে সেটা নিয়ে কিছুটা ধারণা হয়েছে। যে ব্যাপারটা ভীষণ পরিষ্কার তা হলো, গত মে মাসের শেষের দিকে ক্রেমলিন দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, শেষ পর্যন্ত এ যুদ্ধে তাদেরই জয় হবে। আর প্রথমদিকের বিশৃঙ্খল মাসগুলোর তুলনায় পুতিনের এখন একটি স্বচ্ছ পরিকল্পনা রয়েছে।

তিনটি মৌলিক মাত্রাকে বিবেচনায় নিলে পুতিনের পরিকল্পনাটি একপ্রকার কৌশলগত রাশিয়ান পুতুল। এ পরিকল্পনার প্রতিটি দৃষ্টিকোণ একে অপরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, সামগ্রিকভাবে এগুলো একটি বৃহৎ পরিকল্পনায় রূপ নিয়েছে, যেটা ইউক্রেনের পরিধি ছাড়িয়ে গেলেও ইউক্রেনকে কেন্দ্র করেই নিয়ন্ত্রিত।

এ পরিকল্পনার সবচেয়ে ক্ষুদ্র, প্রায়োগিক ও অর্জনযোগ্য লক্ষ্যটি হলো ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার ভৌগোলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, একে ঘিরেই পরিকল্পনা আবর্তিত। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনের ভেতরে বেশি এগোতে না পেরে রাশিয়া নিজেদের লক্ষ্যকে ছোট করে ফেলেছে। কিয়েভ দখলের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দেশটির চলমান ও অধিকতর বাস্তবিক পরিকল্পনা হচ্ছে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের দখল নেওয়া।

খোদ ক্রেমলিন মনে করছে এ লক্ষ্য অর্জন সময়ের ব্যাপার মাত্র। রাশিয়ান বাহিনী ইতোমধ্যে লুহানস্ক অঞ্চল দখল করেছে। এছাড়া ক্রিমিয়ার সঙ্গে সংযোগকারী স্থল করিডোরও এখন রাশিয়ার দখলে।

ভ্লাদিমির পুতিন মনে করছেন, সময়ের তাস তার হাতে। পুতিনের এমন ভাবনার কারণটা অবশ্য বোঝা যায়। পশ্চিমা সামরিক সহায়তা একটি সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। এদিকে ওয়াশিংটনও ইঙ্গিত দিয়েছে তারা এমন কোনো রেড লাইন অতিক্রম করবে না যার কারণে পুতিন রুষ্ট হবেন।

পশ্চিমা শক্তি ইউক্রেনকে এমন পর্যায়ে সাহায্য করবে না যার দরুন রাশিয়া এ যুদ্ধে সামরিকভাবে পরাজিত হবে। পশ্চিমা দুনিয়ায় ইউক্রেনের জয় চাওয়া হলেও, এখন মনে করা হচ্ছে রাশিয়ার দখল করে নেওয়া অঞ্চলগুলো ইউক্রেনের পক্ষে আর পুনর্দখল করা সম্ভব নয়। ক্রেমলিন মনে করছে, একটা সময় পশ্চিমারা ইউক্রেনের ওসব অঞ্চল পুনরায় জয় বিষয়ে হাল ছেড়ে দেবে, আর ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল পুরোপুরি রাশিয়ার অধীনে চলে আসবে।

পরবর্তী লক্ষ্যটি হচ্ছে কিয়েভকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা। এটি ইউক্রেনের টিকে থাকা অঞ্চলগুলোর ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটি পরিকল্পনা। আর এ পরিকল্পনার অনেক বেশি ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে।

বাস্তবতার দিক থেকে চিন্তা করলে, কিয়েভের আত্মসমর্পণ করার মানে হচ্ছে ইউক্রেনের রাশিয়ার দাবিগুলো মেনে নেওয়া। আর তাতে শেষ পর্যন্ত দেশটিকে 'ইউক্রেনীয়করণ-রদ' ও 'রাশিয়াকরণ'-এর মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে। এ পরিকল্পনার লক্ষ্য হচ্ছে, ইউক্রেনকে নিজের জাতি গড়ে তোলা থেকে বঞ্চিত রাখা।

পুতিনের দ্বিতীয় লক্ষ্যটি শুনতে উদ্ভট মনে হলেও, তার জন্য এটি আবার অনিবার্য হিসেবে ঠেকছে। আর এ লক্ষ্য অর্জনে অনেক সময়ও লেগে যেতে পারে। আগামী এক-দু বছরে ইউক্রেন যুদ্ধ করতে করতে নিঃশেষ হয়ে যাবে বলেই ক্রেমলিন বিশ্বাস করে। তখন দেশটির স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড থমকে যাবে, মনোবল ভেঙে যাবে- আর এমন পরিস্থিতিতেই কিয়েভকে আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করার সবচেয়ে বড় সুযোগ পাওয়া যাবে।

ক্রেমলিনের হিসাব বলছে, ইউক্রেনের প্রভাবশালীরা বিভক্ত হয়ে যাবে, জেলেনস্কির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠবে, তারা চাইবে যুদ্ধের সমাপ্তি দেখতে। তখন রাশিয়ার আর কিয়েভের বাহিনীকে গিয়ে পরাজিত করতে হবে না, এ বাহিনী নিজে থেকেই ভেঙে পড়বে। প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করছেন, ভবিষ্যতে এমনটাই ঘটবে আর এটা বন্ধ হওয়ার কোনো অন্তরায় এখনো তার চোখে পড়ছে না।

রাশিয়ার দরজায় ন্যাটোর কড়া নাড়া থামানো, নাকি পুতিনের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব; এ দুইয়ের মধ্যে কোনটি পুতিনের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে ইতোমধ্যে যথেষ্ট আলাপ হয়ে গেছে। কিন্তু এ দুই ব্যাপার আবার একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ইউক্রেন যতই ন্যাটোর দিকে ঝুঁকছে, আর ডনবাসের যুদ্ধে কোনো ফলাফল দেখা যাচ্ছে না, ততই পুতিন দেশটি নিয়ে আরও বেশি আবিষ্ট হয়ে আছেন।

পুতিন বিশ্বাস করেন ইউক্রেন ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ। এদিকে ন্যাটো রাশিয়ার চরম শত্রু। তাই ন্যাটো কর্তৃক ইউক্রেনের 'ধরাশায়ী' হওয়াটা পুতিনের পছন্দ হয়নি। তার প্রত্যুত্তর হিসেবে ন্যাটোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে ইউক্রেন পুতিনের লক্ষ্য হয়ে গিয়েছে। এখানে অনেকে মনে করেন, ন্যাটোকে ছবক শেখাতে গিয়ে পুতিন বুঝি ইউক্রেনকে আক্রমণ করে বসলেন। কিন্তু আদতে তার এ হামলা ন্যাটোকে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনারই অংশ।

আর এর মাধ্যমে তৈরি হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনের তৃতীয় পরিকল্পনা। ভূ-রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ পরিকল্পনাটি হলো: নতুন একটি ওয়ার্ল্ড অর্ডার তৈরি করা।

আমরা এমনটা ভেবেই অভ্যস্ত যে পুতিন পশ্চিমা শক্তিকে একটি আক্রমণাত্মক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেন যারা কিনা রাশিয়াকে ধ্বংস করার তালে আছে। কিন্তু আমার মনে হয় পুতিনের কাছে পশ্চিমা শক্তি দুইটি: একটি ভালো পশ্চিম, আরেকটি খারাপ পশ্চিম।

'খারাপ পশ্চিম' হচ্ছে চিরায়ত পশ্চিমা রাজনৈতিক গুরুরা যারা এখন পশ্চিমা দেশগুলো শাসন করছে। পুতিনের কাছে এ রাজনৈতিক নেতারা তাদের নির্বাচকদের সংকীর্ণমনা দাস হিসেবে মনে হয়, যারা আসল জাতীয় স্বার্থকে এড়িয়ে যায় ও যাদের কৌশলগত চিন্তা করার ক্ষমতা নেই।

অন্যদিকে 'ভালো পশ্চিম' হলো ইউরোপ ও আমেরিকার সাধারণ মানুষ, পুতিনের বিশ্বাস অনুযায়ী যারা রাশিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চায়। এ তালিকায় আরও আছে, পশ্চিমা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যেগুলো রাশিয়ার বাজারে ব্যবসায় করে লাভবান হতে চায়।

পুতিনের চিন্তাভাবনা অনুযায়ী, খারাপ পশ্চিম এখন পতনের মুখে। অন্যদিকে ভালো পশ্চিম বর্তমান স্ট্যাটাস-কুয়োকে চ্যালেঞ্জ করছে। তারা চাচ্ছে পুরনো অর্ডার ভেঙে ফেলে নতুন একটি তৈরি করতে। আর এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে হাঙ্গেরির ভিক্টর অর্বান, ফ্রান্সের মেরিন লে পেন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো কিছু জাতীয়তাবাদী নেতা। পুতিনের বিশ্বাস ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধিসহ এ যুদ্ধের ইত্যাকার প্রভাব ভালো পশ্চিমকে বেড়ে উঠতে ও গতানুগতিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সহায়তা করবে।

পুতিনের বাজি হচ্ছে, পশ্চিমা দেশগুলোতে মৌলিক রাজনৈতিক পরিবর্তন তৈরি হলে তা একসময় একটি পরিবর্তিত ও বন্ধুত্বপূর্ণ পশ্চিমের সূচনা ঘটাবে। আর তারপরই গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে দেওয়া নিরাপত্তা দাবিগুলো নিয়ে পুনরায় ভাবতে পারবে রাশিয়া। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এটি অসম্ভব বলে মনে হলেও, পুতিনের প্রত্যাশায় কোনো লাগাম নেই।

তবে কিছু ভালো খবরও রয়েছে। এ পরিকল্পনাটি যে এক সময়ে কার্যকরী হবে সেটা যতদিন পুতিন বিশ্বাস করবেন, ততদিন কোনো প্রকার নিউক্লিয়ার যুদ্ধের ভয় থাকবে না। কিন্তু দুঃসংবাদ হলো, যদি পুতিনের পরিকল্পনা ভেস্তে যায় পুতিন চূড়ান্তভাবে হতাশ হয়, তখন তিনি হয়ে উঠবেন আরও ভয়ংকর। পশ্চিমারা যদি মারাত্মক কোনো সংঘর্ষ এড়াতে চায়, সেক্ষেত্রে পুতিনের মতো লোকের সঙ্গে বিরোধিতায় তাদেরকে সত্যিকার অর্থে কী কী মোকাবেলা করতে হবে তা ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে।

  • লেখক: তাতিয়ানা স্তানোভায়া কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর অনাবাসিক বিশেষজ্ঞ এবং আর.পলিটিক নামক একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ফার্মের প্রতিষ্ঠাতা

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.