শিনজো আবে: বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের উন্নয়নের অকৃত্রিম বন্ধু

আন্তর্জাতিক

09 July, 2022, 09:20 am
Last modified: 09 July, 2022, 09:25 am
বাংলাদেশের প্রতি শিনজো আবের কতটা সহমর্মিতা ছিল, তা বোঝা যায় ২০১৬ সালের হলি আর্টিজানের হামলার ঘটনায়। ভয়াবহ সেই হামলায় জাপানের সাত নাগরিক মারা যান। ওই হামলাকে 'দুর্ভাগ্যজনক' মন্তব্য করে আবে বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দেন।

শুক্রবার নারা শহরে বক্তৃতার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। 

তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হারাল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অংশীদার জাপানের হয়ে সহায়তার পথ দেখিয়েছেন শিনজে আবে।

স্বাধীনতার পর থেকেই জাপান বাংলাদেশের বন্ধু হিসাবে অর্থনীতি পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখলেও দেশটির সঙ্গে মূল বন্ধুত্ব তৈরি হয় শিনজো আবে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। 

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি দুই শতাধিক শীর্ষ জাপানি বিনিয়োগকারী সমভিব্যাহারে ৬ বিলিয়ন ডলারের জাপানি সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসেন। এর আগে কোনো দেশই বাংলাদেশের জন্য এত বেশি সহায়তা নিয়ে আসেনি।

জাপানে বাংলাদেশের কমার্স কাউন্সিলর হিসাবে দুই মেয়াদে ৬ বছর দায়িত্ব পালন করা সাবেক সচিব ড. আব্দুল মজিদ বলেন, বাংলাদেশের জন্য আবের ২০১৪ সালের সফর ছিল এক ঐতিহাসিক মূহূর্ত। শিনজো আবের এই সফরের মধ্য দিয়ে জাপান ও বাংলাদেশের বহুমুখী অংশীদারিত্বের ভবিষ্যৎ নির্মিত হয়। 

তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ওই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথ দেখিযে গিয়েছেন শিনজো আবে। 

যদিও শিনজো আবের ওই সফরের আগে ২০১০ ও ২০১৩ সালে দুই দফা দেশটিতে সফর করে তার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে আসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।   

বাংলাদেশের প্রতি শিনোজো আবের মনোযোগ কতটুকু ছিল, তা তুলে ধরে আব্দুল মজিদ বলেন, ২০১২ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে শিনজো আবে ঘোষণা দেন, দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করবেন। 

'নিজের কার্যালয়ে সেদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে একাধিকবার তিনি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা বলেন,' বলেন মজিদ।

জাপান টাইমসের এক প্রতিবেদন বলা হয়, ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত জাপানে একাধিক সরকার পরিবর্তনের কারণে কোনো দেশের সঙ্গেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অতটা জোরদার হয়নি। ২০১৪ সালে শিনজো আবের আগে টানা ১৪ বছর কোনো জাপানি প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আসেননি।

২০১৬ সালের ২৭ মে জাপানের মিয়ে প্রিফ্যাকচারের কাশিকো দ্বীপে জি-৭ আউটরিচ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আবের আমন্ত্রণেই অংশগ্রহণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও আবের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরেকটি মাইলফলক হিসাবে উল্লেখ করেন আব্দুল মজিদ।

২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানে রাষ্ট্রীয় সফর যান। সেই সফরে আবের সরকার মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন, ঢাকা ম্যাস র‍্যাপিড ট্রানজিট লাইন-১, এনার্জি এফিসিয়েন্সি অ্যান্ড কনজারভেশন প্রমোশন ফাইন্যান্সিং প্রজেক্টসহ বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। 

এসব চুক্তির মূলে শিনজো আবের ভূমিকাই মুখ্য বলে মন্তব্য করেন আব্দুল মজিদ। 

শিনজো আবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর একটি যৌথ বিবৃতিতে সেবার বলা হয়, ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে বাংলাদেশ সরকারকে সব রকমের সহায়তা করতে চান শিনজো আবে।

শিনজো আবের আগ্রহ ও সহায়তার কারণেই বাংলাদেশে একাধিক জাপানি কোম্পানি ব্যবসা শুরু করে। এরপর ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে শিনজো আবের সরকার। 

জি২জি সহযোগিতার পাশাপাশি আবের নেতৃত্বে জাপান জাইকার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা ও সহযোগিতা প্রদান করেছে বাংলাদেশকে। যার লক্ষ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করা।

২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার কয়েকদিন আগেও বাংলাদেশের সাতটি মেগা প্রকল্পের জন্য সহযোগিতা করে গেছেন শিনজো। 

২০২০ সালের ১২ আগস্ট জাইকা বাংলাদেশে সাতটি মেগা প্রকল্প পরিচালনার জন্য ৩ লাখ ৩৮ হাজার ২৪৭ মিলিয়ন ইয়েন পর্যন্ত ওডিএ ঋণ প্রদানের জন্য বাংলাদেশেরসঙ্গে  একটি ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে জাপান। এরও পেছনে ছিলেন শিনজো।

এই সাতটি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে যমুনা রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্প, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প, ঢাকা ম্যাস র‍্যাপিড ট্রানজিট উন্নয়ন প্রকল্প, ঢাকা ম্যাস র‍্যাপিড ট্রানজিট উন্নয়ন প্রকল্প উত্তর রুট, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট, ফুড ভ্যালু চেইন ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট এবং নগর উন্নয়ন ও সিটি গভর্নেন্স প্রজেক্ট।

আবের কারণেই বাংলাদেশে এখন জাপানি কোম্পানির সংখ্যা অনেক বেশি বলে উল্লেখ করেন জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সালাউদ্দিন কাশেম খান।

তিনি জানান, ২০০৮ সালে যেখানে ৭০টি জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করতো, সেটি এখন প্রায় চারশোর কাছাকাছি।

বাংলাদেশের প্রতি শিনজো আবের কতটা সহমর্মিতা ছিল, তা বোঝা যায় ২০১৬ সালের হলি আর্টিজানের হামলার ঘটনায়। ভয়াবহ সেই হামলায় জাপানের সাত নাগরিক মারা যান। ওই হামলাকে 'দুর্ভাগ্যজনক' মন্তব্য করে আবে বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দেন। 

রোহিঙ্গা ইস্যুতেও শিনজো আবের ভূমিকা প্রশংসনীয় ছিল। শারীরিক সমস্যার কারণে পদত্যাগের আগে তিনি একাধিকবার মিয়ানমারের সঙ্গে সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আলাপ করেন।

শিনজো আবের বাংলাদেশকে সহায়তা ও তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে পররাষ্ট্র ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন, 'আবে আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশেরও ঘনিষ্ঠজন।'

তিনি বলেন, তাঁর মৃত্যুতে জাপানের জনগণ এক অসাধারণ নেতাকে হারাল, একই সঙ্গে বাংলাদেশ হারাল তার একজন অকৃত্রিম বন্ধুকে।

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু শিনজো আবের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদও।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.