অস্ত্র সংবরণ চুক্তির মৃত্যু হয়েছে, এসেছে প্রতিযোগিতার যুগ

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
04 July, 2022, 10:15 pm
Last modified: 05 July, 2022, 12:46 pm
অস্ত্র প্রতিযোগিতা বিপুল বিনিয়োগের বিচারে অমানবিক, তবে বিশ্বশান্তি রক্ষার এক আবশ্যক উপাদান...

দেশে দেশে দিকে দিকে অবসান হচ্ছে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের, শুরু হয়েছে অস্ত্র প্রতিযোগিতার ঝনঝনানি। গত দুই দশকে ধসে পড়েছে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে অস্ত্র সম্বরণের চুক্তিগুলির ভিত্তি। একে একে অচল হয়েছে অ্যান্টি-ব্যালেস্টিক মিসাইল ট্রিটি, দ্য কনভেনশনাল আর্মড ফোর্সেস ইন ইউরোপ ট্রিটি, ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস ট্রিটি আর ওপেন স্কাইস ট্রিটি। এখন রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে চুক্তিটি রয়ে গেছে তা হলো- নতুন স্টার্ট চুক্তি। তবে এই চুক্তিও বলি হতে পারে ইউক্রেন যুদ্ধের। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসহ পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চীনও তার প্রচলিত ও পারমাণবিক উভয় ধরনের অস্ত্রসজ্জা দ্রুতলয়ে বাড়িয়ে চলেছে। বিশ্বব্যাপী নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব সামরিক শক্তি নাটকীয় হারে বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।  

অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত নতুন এ দুনিয়ায় শান্তিকামীদের স্বাগতম! যে দুনিয়ায় উত্তেজনা তীব্র, সামরিক ভারসাম্য সর্বদা চ্যালেঞ্জের মুখে এবং পরাশক্তিগুলি কোন ধরনের অস্ত্র কতটি মজুদ রাখতে পারবে- সেই সীমারেখাও বিলীন। নতুন এ দুনিয়া আসলে সমরসজ্জার অতীত প্রতিযোগিতার-ই প্রতিচ্ছবি।

ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে লেখা তার নিবন্ধে এমন কথাই উল্লেখ করেছেন জনস হপকিন্স স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সম্মানীয় হেনরি কিসিঞ্জার ফেলো অধ্যাপক হাল ব্র্যান্ডস। তার পরামর্শ, এ বাস্তবতায় বিপর্যয় এড়াতে আমেরিকাকে সচেষ্ট হতেই হবে। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে দেশটি অস্ত্র প্রতিযোগিতায় যে পারদর্শিতা দেখিয়েছিল- তারই পুনরাবৃত্তি করতে হবে আরও একবার। 

হাল ব্র্যান্ডস অস্ত্র প্রতিযোগিতার খুঁটিনাটি ও ইতিহাসের দিকেও আলোকপাত করেছেন। সংজ্ঞা দিয়েও বলেছেন- যখন দুই বা ততোধিক বিশ্বশক্তি সামরিক ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে রাখতে অস্ত্রসজ্জার দ্বৈরথে নামে প্রতিযোগিতা তাকেই বলা চলে। কিন্তু, শান্তিকামী মানুষের কাছে এটি চিরকাল নিন্দিত। বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, রণসম্ভার বাড়িয়ে চলা যুদ্ধান্মদনার শামিল অথবা সামরিক শিল্প কোম্পানিগুলোর পকেট ভারী করার পায়তাঁরা। এই প্রতিযোগিতাই দুনিয়াজুড়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, জন্ম দেয় সর্বনাশা যুদ্ধের।

শুধু সাধারণ মানুষ নয়, আমেরিকার সর্বোচ্চ ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ কালেভদ্রে সামরিক প্রতিযোগিতার নিন্দা করেছেন, আবার অসহায়ত্বও উঠে এসেছে তাদের ভাষ্যে। যেমন ১৯৫৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইসেনহাওয়ার তার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদকে বলেছিলেন, "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (আমেরিকা) যে অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তুলেছে, তা কখনোই তার চূড়ান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না। তবুও আমরা অস্ত্রের পাহাড় গড়ছি, কারণ এর বিকল্প আমাদের জানা নেই।"     

এভাবে 'আর্মস রেস' খ্যাত অস্ত্র প্রতিযোগিতার দুর্নাম দিকে দিকে। তবে পৃথিবীর ভূরাজনৈতিক বাতাবরণ ক্রমে বাজে রূপ ধারণ করায়—আবেগের আতস ফেলে বাস্তবিক দৃষ্টিতে এর দিকে তাকানোর পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক ব্র্যান্ডস। 

স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকার চিন্তাশীল নীতি-নির্ধারকরা উপলদ্ধি করেছিলেন, অস্ত্রসজ্জা নিরর্থক উন্মাদনা নয়। বরং বৈরী শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক ক্ষমতার সুষম ভারসাম্য তৈরির পন্থা; যা আসলে যুদ্ধে প্ররোচনা না দিয়ে তা এড়াতে সাহায্য করে।   

অস্ত্র প্রতিযোগিতায় হয় স্মার্ট বিনিয়োগ, এটি এমন এক গভীর কৌশলগত প্রক্রিয়া যা সময়ের সাথে সাথে শক্তির ভারসাম্য কোনো একপক্ষের অনুকূলে নিয়ে আসে। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণকে অস্ত্র প্রতিযোগিতার যোগ্য বিকল্প হিসেবে দেখা হয় না। তবে প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মনে করা হয়। অর্থাৎ, প্রথমে অস্ত্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিপুল রণসজ্জা তৈরি করে শত্রুকে ভীত হতে বাধ্য করা হয়, অতঃপর অস্ত্র সম্বরণ চুক্তিতে উৎসাহী করা হয় তাকে।

বর্তমান সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বীতার যুগে আমেরিকার সামনে রয়েছে সমরাস্ত্র প্রস্তুতে এগিয়ে থাকার মহার্ঘ্য সুযোগ। তবে সেজন্য আমেরিকাকে স্নায়ুযুদ্ধের অস্ত্র প্রতিযোগিতার পন্থা—যা শিল্পের পর্যায়েই পৌঁছেছিল—সেটি পুনঃআয়ত্ত করতে হবে বলে মনে করেন ব্র্যান্ডস। 

তার মতে, অস্ত্র প্রতিযোগিতা কোনো নির্দিষ্ট সময়কালের নয়, যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এর ধারাবাহিকতা। তবে 'আর্মস রেস' শব্দটির বহুল প্রচলন শুরু হয় বিংশ শতকের শুরুতে। এসময় ড্রেডনট যুদ্ধজাহাজ ও বিমানের মতো নব্য প্রযুক্তি সামরিক ভারসাম্যে ব্যাপক পরিবর্তনের সম্ভাবনা যোগ করতে থাকে। বিশ্বশক্তিগুলির মধ্যে এসব নব প্রযুক্তি আয়ত্তের চেষ্টা তীব্র আকার ধারণ করলে সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা একান্ত জরুরি হয়ে দেখা দেয়। যেমন প্রথম মহাযুদ্ধের কয়েক দশক আগেই ব্রিটেন ও জার্মানির মধ্যে সবসেরা যুদ্ধজাহাজ তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল।  

তবে পারমাণবিক অস্ত্রের আবিস্কার ও স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষিতে কৌশলগত অধ্যয়ন একাডেমিক ক্ষেত্রে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে অস্ত্র প্রতিযোগিতা সম্পর্কে আমাদের ধ্যান-ধারণা আজকের পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেছে।   

স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন ও কলিন এস. গ্রে'র মতো পণ্ডিতরা অস্ত্র প্রতিযোগিতার সংজ্ঞাকে আরও শানিত করে দেখিয়েছেন যে—এটি আসলে এক ধরনের উন্মুক্ত, পাল্টাপাল্টি লড়াই যেখানে বিবাদমান পক্ষগুলি সামরিক ভারসাম্যে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করে তার কৌশলগৎ সুবিধালাভ করতে চায়।

এনিয়ে সরকারিভাবে ও একাডেমিক পর্যায়ের বিশ্লেষকরা আমেরিকা ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে যেসব অধ্যয়ন করেছেন, তাতে দেখা গেছে এক পক্ষের পদক্ষেপ অন্য পক্ষকে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে উৎসাহিত করে। দুই পরাশক্তির বৈশ্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এ লড়াইয়ে তাদের অস্ত্র প্রতিযোগিতার নানান দিক পৃথিবীর সেরা বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারকদের জন্য আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। 

খুব শিগগিরই মারাত্মক রূপধারণ করে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক প্রতিযোগিতা। এসময় মস্কো ও ওয়াশিংটন উভয়েই মানব সভ্যতাকে একাধিকবার পৃথিবী থেকে মুছে ফেলার মতো ধবংসাত্মক শক্তি অর্জন করে। এজন্যই পরমাণু অস্ত্রের এই ইঁদুর দৌড়কে উন্মাদনার চূড়ান্ত হিসেবে দেখা হয়েছিল। নিরাপত্তা লাভের নিরন্তর চেষ্টা কীভাবে মানবজাতির অস্তিত্বের জন্যই হুমকি হয়ে উঠতে পারে—এ ঘটনা ছিল তারই প্রমাণ। 

পরাশক্তিগুলোর ধবংস ক্ষমতায় লাগাম টেনে ধরারই প্রচেষ্টা ছিল ১৯৭০ এর দশক ও তার পরবর্তী সময়ের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিগুলো- যার আওতায় তাদের পারমাণবিক বোমা ও সেগুলি নিক্ষেপের সক্ষমতাকে কমানোর পাশাপাশি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মতো প্রতিযোগিতা উস্কে দেওয়ার মতো সক্ষমতাও হ্রাস করা হয়।  

এসময় সামনে আসে ম্যাড ডকট্রিন- বা মিউচ্যুয়ালি এসিউরড ডিসট্রাকশন- এর ধারণা। পরমাণু যুদ্ধে উভয় পক্ষই একে-অপরকে ধবংস করে দিতে পারবে এবং এজন্যই এমন যুদ্ধ শুরুর চিন্তাও সর্বনাশী এই বাস্তবিক বুদ্ধিটি উভয় পক্ষের নীতিনির্ধারকদের মগজে গেঁথে যায়। 

তারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় ১৯৬৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট ম্যাকনেমারার ঘোষণায়। তিনি বলেন, "আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতা করতে চাই না। ক্রিয়া ও পাল্টা-প্রতিক্রিয়ার এই চেষ্টা নিরর্থক এবং নির্বুদ্ধিতারই শামিল।"

যদিও বাস্তবে বিষয়টি আরও জটিল। যেমন আইজেনহাওয়ার ১৯৫৭ সালে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডুলেস- এর কাছে স্বীকার করেন যে, 'অস্ত্র প্রতিযোগিতা উত্তেজনা তৈরির কারণ নয়, বরং তার ফসল।' পরাশক্তিগুলি একে-অপরের শত্রু হওয়ার ফলেই রণসজ্জা বৃদ্ধি করছে—কারণ এতে হার না মানাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। 

এ বাস্তবতায় কোনো এক পক্ষ দুর্বল হলে- যেমন যদি পশ্চিমা দুনিয়া ভূরাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়তো—তাহলে অপরপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়ন চূড়ান্ত সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমের চেষ্টা করতো। তাতে সৃষ্টি হতো পরমাণু যুদ্ধের তাণ্ডব। তাই চতুরতম পর্যবেক্ষকরা বুঝতে পেরেছিলেন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা নির্বোধের কাজ নয়, বরঞ্চ এক বিজয় সংগ্রাম। এ উপলদ্ধি-ই উদ্ভাবনী চিন্তা ও কৌশলগত অন্তর্দৃষ্টি উপহার দিয়েছিল বিশ্বকে। 

অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিষয়ে আমেরিকাকে আরও উন্নত চিন্তাধারা উপহার দিয়েছিলেন প্রতিরক্ষা বুদ্ধিজীবী ও মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক বিশ্লেষণ বিভাগের প্রথম পরিচালক অ্যান্ড্রু মার্শাল। এই বিভাগটি আসলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব চিন্তক সংস্থা। মার্শাল তার প্রধান হিসেবে ম্যাকনামারার 'ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া' মডেলের সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরেন। 

তিনি ব্যাখ্যা করেন, সোভিয়েত-মার্কিন অস্ত্র প্রতিযোগিতা উভয় দেশের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা এবং আমলাতান্ত্রিক ভিন্নতার মাধ্যমে ততোটাই হচ্ছে, যতোটা হচ্ছে পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা হিসেবে। ওয়াশিংটন যেহেতু মস্কোর সাথে সামরিক সংঘাত একা এড়াতে পারে না- তাই এ প্রতিযোগিতার সম্পর্ককে তাকে নিজের জন্য সুবিধেজনক অবস্থানে আনতে হবে। আর সেজন্য "সোভিয়েতদের চেয়েও বেশি সৃজনশীল হতে হবে আমেরিকাকে।"

১৯৭২ সালে মার্শাল লিখেন, "অবধারিতভাবে আমেরিকার চেয়ে বেশি খরচের সামর্থ্য নেই সোভিয়েত রাষ্ট্রের। তাই আমাদের বেশি খরচ করে যেতেই হবে। আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত এভাবে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিযোগীর আর্থিক সক্ষমতাকে দুর্বল করা, মুক্তবিশ্বের বিজয় নিশ্চিত করা। এভাবেই আমেরিকা তার তুলনামূলক সুবিধাকে (আর্থিক শক্তি) ব্যবহার করতে পারে।"  


সূত্র: ফরেন পলিসি অবলম্বনে 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.