স্নেক আইল্যান্ড: কৃষ্ণসাগরের কৌশলগত দ্বীপটির দখল কেন রাশিয়া ধরে রাখল না?

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের প্রথম দিনেই কৃষ্ণ সাগরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এই ছোট, পাথুরে দ্বীপটি দখল করে নিয়েছিল রাশিয়া। এরপর থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বড় একটি ভূমিকা রেখেছে এই দ্বীপ। কিন্তু চার মাসেরও বেশি সময় ধরে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের উপর্যুপরি গোলাবর্ষণের শিকার হয়ে অবশেষে দ্বীপটি থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে রুশ সেনারা। কিন্তু এই বিশেষ দ্বীপের নাম কী? ইউক্রেনে 'জিমিয়েনি দ্বীপ' নামে পরিচিত হলেও, ইংরেজিতে এটি 'স্নেক আইল্যান্ড' নামেই খ্যাত।
যদিও রাশিয়া জানিয়েছে, তারা 'প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ' দ্বীপটি ছেড়ে এসেছে, যাতে করে প্রমাণ হয় যে খাদ্যশস্য রপ্তানির উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে না রাশিয়া। কিন্তু এই দাবিকে পুরোপুরি অস্বীকার করে ইউক্রেন দাবি করেছে, মস্কো এখনো ইউক্রেনের খাদ্যশস্য ভাণ্ডারের উপর গোলাবর্ষণ করেই যাচ্ছে।
প্রতিরোধ করা কঠিন
আকাশ ও সমুদ্রপথসহ চারদিক থেকেই খোলা এই স্নেক দ্বীপের সুরক্ষার দায়িত্ব প্রথমে ইউক্রেনীয় ও পরে ছোট একদল রুশ সৈন্যের হাতে ছেড়ে দেওয়াকে উপহাস করেছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। তারা এই সৈন্যদের 'সিটিং ডাকস' বা শত্রুর আক্রমণের মুখে অসহায় বলে অভিহিত করেছেন।
চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ সৈন্যদের হাতে দখল হয়ে যাওয়া স্নেক দ্বীপ ইউক্রেন উপকূল থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার (২২ মাইল) দূরে অবস্থিত। স্বভাবতই, তীর থেকে এই দ্বীপে ক্ষেপণাস্ত্র, গোলন্দাজ কামান ও ড্রোন দিয়ে হামলা চালানো কঠিন কিছু নয়।
আর ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী ঠিক সেই কাজটিই করেছে। সরাসরি দ্বীপের উপর এবং দ্বীপে ভারী অস্ত্র ও সৈন্য বহন করে নিয়ে যাওয়া সব জাহাজ লক্ষ্য করে তারা দুর্ধর্ষ হামলা চালিয়েছে।

গত এপ্রিলে কৃষ্ণসাগরে রুশ যুদ্ধজাহাজ মস্কোভা ডুবির পর কৃষ্ণসাগরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রাশিয়ার আকাশ-প্রতিরক্ষা সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য রকম দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় ক্রেমলিন কেন স্নেক দ্বীপে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট সিস্টেম এবং রেডিও-ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার নিয়ে আসতে মরিয়া ছিল। কিন্তু কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার মূল নৌ ঘাঁটি থেকে দ্বীপের অবস্থান অনেক দূরে হওয়ায় দ্বীপটিকে রক্ষা করা রাশিয়ার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে, ইউক্রেনের নৌ-শক্তি এতটাই সীমাবদ্ধ যে তারা দ্বীপটিতে নিজেদের সৈন্যসমেত পৌঁছাতেই সক্ষম হয়নি।
কিন্তু, ইউক্রেনীয় সামরিক বিশ্লেষক ওলেহ দানভের মতে, দুই পক্ষের জন্যই স্নেক দ্বীপে সৈন্য বহালের কোনো মানে হয় না, কারণ এটি খুব সহজেই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে। এর পরিবর্তে বরং আক্রমণ প্রতিরোধের সক্ষমতা তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে বলেন দানভ। এর ফলে কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় বন্দর ওডেসাসহ পুরো উত্তর-পশ্চিম অংশের নিরাপত্তাও জোরদার হবে।
গুরুত্বপূর্ণ এক দ্বীপ
ইউক্রেনের কৃষ্ণ সাগর উপকূলের একটি বড় অংশ ইতোমধ্যেই রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে; সেই সাথে ক্রিমিয়ান পেনিনসুলা এবং সমগ্র আজভ সাগর তো আছেই। তাই স্নেক দ্বীপ নিজেদের দখলে আনতে পারলে ওডেসার উপরেও কার্যকরী অবরোধ দেওয়া সম্ভব হবে। অর্থাৎ, তখন ইউক্রেনের সিংহভাগ খাদ্যশস্য রপ্তানি অসম্ভব হয়ে যাবে।
তাছাড়া, আক্রমণের মুখে পড়তে পারে কৃষ্ণ সাগর উপকূল। কিয়েভের সামরিক বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, রাশিয়া এখানে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো দূরপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বসাতে পারে।
মানচিত্রে এটিও স্পষ্ট যে, স্নেক দ্বীপ রাশিয়ার অধীনে চলে গেলে তা ন্যাটোভুক্ত দেশ রোমানিয়ার জন্যেও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। শুধু কৌশলগত কারণেই নয়, এ অঞ্চলে রয়েছে বিপুল পরিমাণ পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসের মজুদ, যার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।
মস্কো কী বলছে?
যেকোনো আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সাধারণত দুটি ভিন্নধর্মী গল্প থাকবেই। একদিকে পশ্চিমা সরকার বা ইউক্রেনের বলা গল্প, অন্যদিকে এর বিপরীতে রাশিয়ার বক্তব্য।
মস্কোর দাবি, স্নেক দ্বীপ থেকে কোনো রুশ সৈন্য পশ্চাদপসরণ করেনি। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতি দিয়ে দাবি করা হয়, স্নেক দ্বীপে রাশিয়ান সৈন্যদের উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল, তারা তা সম্পন্ন করে চলে এসেছে। ইউক্রেনের খাদ্য রপ্তানির উপর রাশিয়া কোনো বাধা দিচ্ছে না, তার প্রমাণস্বরূপ 'প্রীতির নিদর্শন' হিসেবে স্নেক দ্বীপ থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়েছে রাশিয়া।
কিন্তু স্নেক দ্বীপের কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় এবং ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন আরম্ভের পর থেকে দেশটিতে রাশিয়া যেসব হামলা চালিয়েছে, তাতে রাশিয়ার এই 'প্রীতির নিদর্শন' নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে অনেকের মনে।
আবার এও হতে পারে- স্নেক দ্বীপ ছেড়ে আসার মাধ্যমে রাশিয়া নিজ দেশের মানুষকে বোঝাতে চাইছে যে, এই যুদ্ধে রাশিয়াই 'ভালো' এবং ইউক্রেনে তাদের 'বিশেষ সামরিক অভিযান' পরিকল্পনামতোই যাচ্ছে।
পাল্টে দিতে পারে যুদ্ধের অনেক সমীকরণ!
স্নেক দ্বীপ থেকে রাশিয়ানদের বিতাড়িত করা ইউক্রেনের জন্য স্রেফ জয়ের প্রতীক নয়, বরং একটি কৌশলগত সফলতাও বটে! অন্যদিকে, রাশিয়ার জন্য এটি একটি বাধা এবং লজ্জাজনক পরাজয়।
কিন্তু এ ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবে যুদ্ধের গতিপথ পাল্টে দেয়নি। রাশিয়ার লক্ষ্য হচ্ছে, পূর্ব ডনবাস অঞ্চলের পুরোটা দখল করা এবং যুদ্ধের শুরুর দিকে দক্ষিণের যেসব অঞ্চল তারা কব্জা করেছিল, তা ধরে রাখা।
কৌশলগত কারণে এবং আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র বসানোর দিক থেকে কৃষ্ণ সাগরে স্নেক দ্বীপ হয়তো বেশ ভালো একটি জায়গা। কিন্তু সবকিছু সত্ত্বেও এটি একটি ছোট্ট পাথুরে দ্বীপই।
কিন্তু দিনশেষে প্রশ্ন হচ্ছে, ইউক্রেন কি রাশিয়ানদের হটিয়ে, খাদ্যশস্য রপ্তানি চাঙ্গা করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে পারবে? দক্ষ নৌ বাহিনী ব্যতীত সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, কারণ কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়া এখনো তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইউক্রেনিয়ান স্টাডিজ- এর অধ্যাপক অ্যান্ড্রু উইলসন বলেন, "নিরাপদে খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে চাইলে ইউক্রেনকে আরো ১০টি বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে, স্নেক দ্বীপ তার মধ্যে একটি।"
যেহেতু আগে বন্দরের বাইরে পুঁতে রাখা মাইন সরাতে হবে, তাই ওডেসা থেকে খাদ্যশস্য বহনকারী জাহাজগুলো রাশিয়ান পাহারায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছে ইউক্রেন।
নতুন একটি চুক্তিতে আসার জন্য তুরস্ক এই মুহূর্তে রাশিয়া ও ইউক্রেন, দুই পক্ষের সাথেই কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো কোনো আশার আলোর দেখা যায়নি। জুলাই থেকেই শস্য তোলার মৌসুম আরম্ভ হওয়ায় আগামী কয়েক সপ্তাহকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে দেখছেন ইউক্রেনের বিশেষজ্ঞরা।
- সূত্র: বিবিসি