ভূরাজনীতির নানান সিদ্ধান্ত আমাদের প্রভাবিত করে, নির্বাচন কমিশনের সেকথা মাথায় রাখা উচিত 

মতামত

23 June, 2022, 04:50 pm
Last modified: 23 June, 2022, 04:54 pm
আমাদেরকে ভাবতে হয় ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে আমরা কোন পক্ষ নেব! আমরা স্বাবলম্বী হিসেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। কারণ, একদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের পোশাক শিল্পের সম্পর্ক; অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এসবই আমাদের জন্য গভীর সংকটের সৃষ্টি করছে।

এদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে অনেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন ৫৭ বছর বয়সের পর অবসরে যাবেন, রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটাবেন। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসন চালিয়ে রাখার মতন জনবলের সংকটের ফলে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু অবসরপ্রাপ্ত আমলা-কর্মচারীদের পুনঃনিয়োগের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর তা এখনও বহাল আছে। পুনঃনিয়োগপ্রাপ্তরা স্বাভাবিক কর্মজীবনে সরকারের প্রতি 'চরম আনুগত্য' প্রদর্শন করে এই 'বিশেষ যোগ্যতা' অর্জন করে থাকেন। ফলে স্বাভাবিক অবসরের পরে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গগুলোতে অনেককেই এইরকম দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। 

বর্তমানের কর্মজীবন হিসাবে ৫৯ বছর। বিচার বিভাগের বিচারপতিদের জন্য ৬৭ বছর আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে ৬৫ বছর। তবে অবসর জীবনের পরও অনেককে সেই ১৯৭৪ সালের অধ্যাদেশের ক্ষমতাবলে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, নির্বাচন কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, পিএসসির সদস্যবৃন্দ, ল-কমিশন, মানবাধিকার কমিশন থেকে শুরু করে সর্বত্রই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বিরাজমান। তবে পিএসসি সাংবিধানিক পদ হলেও নিয়োগ আইনে বয়স সর্বোচ্চ ৬৫ বলা আছে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে তা সুনির্দিষ্ট করা নেই। ল-কমিশন এর ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট কোনো বয়স উল্লেখ করা হয়নি। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৬৫ বছর কর্মজীবন নির্ধারিত থাকার পরও সাম্প্রতিককালে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনকে উপাচার্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার স্বাভাবিক কর্মজীবন শেষ করেছিলেন।

২০০৫ সালে তৎকালীন আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিকে সেই সময়কার সরকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের পর থেকেই তাকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিতর্কের মূল কারণ ছিল- একই ব্যক্তি দুটি সাংবিধানিক পদে কী করে দায়িত্ব পালন করেন? সেই বিতর্কের চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে ২০০৭ সালের পর্দার অন্তরালের সামরিক শাসন। আপিল বিভাগের সেই বিচারপতি অবসরের পর যে রাজনৈতিক দল তাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মনোনীত করেছিল- সেই দলের পক্ষ থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাকে যখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা হল তখন তিনি অনেক গণমাধ্যম বন্ধু হয়ে ওঠেন। প্রায় প্রতিদিনই তাকে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যেত। কখনো-সখনো তার হতাশাও ব্যক্ত করতেন। আবার কখনো কখনো তিনি উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করতেন। তার সেই সময়কার একটি বহুল আলোচিত উদ্ধৃতি ব্যাপকভাবে গণমাধ্যমের আকর্ষণ সৃষ্টি করেছিল, তা হচ্ছে, "খবর নাই রে ভাই, খবর নাই।"

এক গণমাধ্যমকর্মী তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তখনকার চলমান বিতর্ক নিয়ে অর্থাৎ তার নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করা নিয়ে। এনিয়ে তখনকার বিরোধী দল যে অবস্থান নিয়েছিল- সেই বিষয়ে। তার কাছে জানতে চাওয়া হলে, তিনি উপরোক্ত উক্তিই করেছিলেন। গণমাধ্যমের মাধ্যমে যা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে গিয়ে একটি হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিল। তেমনি আর একটি তামাশা সৃষ্টি করেছেন, বর্তমানের নির্বাচন কমিশনার। যারা এই দায়িত্বে আছেন- তাদের প্রায় সকলেই অবসরপ্রাপ্ত। 

নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে একটি নির্বাচন কমিশন আইনের মাধ্যমে। হঠাৎ করে এই নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় আইনের প্রয়োজনীয়তার দাবি করলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তাৎক্ষণিকভাবে আইনটি প্রণয়ন করা হল। যদিও আইন প্রণয়নের প্রাক্কালে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের কোন মতামত গ্রহণ করা হয় নাই। সরকারি দল তাদের নিজ উদ্যোগে আইন তৈরি করে পার্লামেন্টে তাদের দলীয় সদস্যদের দ্বারা হ্যাঁ ভোট জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ ভোট জয়যুক্ত হয়েছে- ইত্যাদির মাধ্যমে একে আইনে রূপান্তরিত করে। সেই আইনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়।

নির্বাচন কমিশনের কেউ কেউ হয়ত অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন দেশে বা বিদেশে। তাদেরকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করার পর প্রথমেই তারাও আগের কমিশনের মতই গণমাধ্যমের বন্ধু হয়ে ওঠেন। প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে তাদের উপস্থিত হতে দেখা যায়। এভাবেই নানান বিষয় সামনে এসেছে, যেমন সম্প্রতি কোনো এক কমিশনার কর্তৃক ১০ কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা। এই পুরস্কার ঘোষণার ভেতর দিয়ে তাদের গ্রহণযোগ্যতা এবং তাদের কর্মযোগ্যতা উভয় বিষয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। বিগত জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশে যে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে- সেখান থেকে আগামী দিনে একটি সফল নির্বাচন করার জন্য এই নির্বাচন কমিশনারের যে গ্রহণযোগ্যতা প্রয়োজন- তার কোনোটাই দেখা যাচ্ছে না। 

গত কয়েক মাসের ঘটনা পরম্পরায় কুমিল্লা সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রথমেই তাদের ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে স্থানীয় সাংসদকে এলাকা ত্যাগ করতে বলা নিয়ে শুরু হয় নানান আলোচনা। স্থানীয় সংসদ সদস্য এলাকা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। তার অস্বীকৃতি যথার্থ। কারণ, এরকম কোনও আইনি ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশন অতি-উৎসাহী হয়ে সরকারের নির্বাচন সংক্রান্ত আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিলেন। তারা ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে সংসদ সদস্যকে এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দিয়ে তাদের যোগ্যতা এবং ক্ষমতার প্রশ্নে দেশের মানুষের কাছে হাস্যাস্পদ হয়েছেন। এরপরই তারা নতুন করে বলেছেন যে, স্থানীয় সংসদ সদস্য এলাকা ত্যাগ না করে কোন আইনভঙ্গ করেননি।

আমলা হিসেবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন শেষে এরকম একটি পদে অধিষ্ঠিত হয়ে প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা এবং আইনকানুন সম্পর্কে না জেনে- এই দুই বিপরীতধর্মী অবস্থানের ফলে দেশের মানুষের কাছে আগামীদিনের নির্বাচন পরিচালনার জন্য তাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে- সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

ইভিএম নিয়ে ১০ কোটি ডলার পুরস্কারের ঘোষণা হাসাহাসির খোরাক হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে ইভিএমের গতি যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে তার থেকে বেশি ভোটার একত্রিত হয়, যদি ৭০/৭৫ শতাংশ ভোটার ইভিএমে ভোট দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ান- তাহলে তাদের ভোট দিতে বহু সময় ব্যয় হবে, যা নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত সময়ের বাইরে চলে যাবে। ভোটগ্রহণের জন্য সাধারণভাবে ৮ ঘণ্টা সময় নির্ধারণ করা হয়, কিন্তু ইভিএমের সক্ষমতা ঘন্টায় ২০০ ভোটগ্রহণ করার। সে হিসাবে এই মেশিন নিয়ে একটি বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। 

তারপরও এ মেশিন নিয়ে গত কয়েকদিন যাবত তারা তাদের সক্ষমতা প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছেন। তা মূলত প্রত্যাখ্যান হয়েছে বলেই ধারণা করা যায়, কারণ দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করে নাই।

কুমিল্লা নির্বাচনের ভেতর থেকে যে ফলাফল আমরা দেখেছি তাতে এটি সুস্পষ্ট যে, বিএনপি কর্তৃক বহিস্কৃত দুজন সদস্য মিলিতভাবে ক্ষমতাসীন দলের বিজয়ী প্রার্থীর থেকে অনেক বেশি ভোট পেয়েছেন। সুতরাং তাদেরকে বাদ দিয়ে ভোট করাটা আগামীদিনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে সেটিও বড় প্রশ্ন। মনে রাখতে হবে, আমাদের অর্থনীতি এখনো কিশোর পর্যায়ে আছে। সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর নানান ভূরাজনৈতিক ঘটনাসমূহ আমাদের অর্থনীতির উপর প্রভাব বিস্তার করে। 

আমাদেরকে ভাবতে হয় ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে আমরা কোন পক্ষ নেব! আমরা স্বাবলম্বী হিসেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। কারণ, একদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের পোশাক শিল্পের সম্পর্ক; অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এসবই আমাদের জন্য গভীর সংকটের সৃষ্টি করছে। দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়েও টানাপোড়েন শুরু হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সঠিকভাবে অনুষ্ঠিত না হলে দেশে আবারো বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হবে- যেমনটা ঘটেছিল ২০০৬ সালে নির্বাচন কমিশন গঠন করা নিয়ে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.