নবীকে নিয়ে বিতর্ক: ভারত কেন কূটনৈতিক চাপের মুখে?
যে ১৫ টি মুসলিম দেশ ভারতের মুসলিম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে, তাদের মধ্যে ইরান হচ্ছে একমাত্র দেশ যাদের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের সম্পর্ক শীতল। বিশেষ করে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কটি শিয়া ও সুন্নির বিভাজনের কারণে বহুকাল যাবৎ শীতল পর্যায়ে রয়েছে। এমনকি মাঝে কিছুদিন ইরানীদের হজ পালন বন্ধ ছিল।
তারপরও হঠাৎ করে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন অন্যান্য দেশগুলো কেন এই প্রতিবাদ করলো? যে বিষয়ে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে তার থেকেও ভয়ঙ্কর ঘটনা অতীতে ভারতে সংঘটিত হয়েছে বহুবার।
লাগাতারভাবে মুসলিম বিদ্বেষ ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিজেপি ও তার সহযোগী সংগঠন সংঘ পরিবার তাদের রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। দীর্ঘ একটা সময় কখনোই এ বিষয়ে কোনো মত প্রকাশ করতে দেখা যায়নি ওই প্রতিবাদকারী আরব দেশগুলোর পক্ষ থেকে। তাহলে এখন কেন?
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সমস্ত অর্থনীতি, জীবন ধারণ সবকিছুতেই পশ্চিমাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। ওই দেশগুলোর উচ্চ শ্রেণীর মানুষদের সন্তানেরা শিক্ষা-দীক্ষায় পশ্চিমা ধ্যান-ধারণা দিয়েই প্রভাবিত। যেমন বর্তমান সৌদি প্রিন্স একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাজীবন শেষ করেছে। তাছাড়া এসব দেশের নিরাপত্তা-ব্যবস্থাও পশ্চিমাদের তৈরি করা। পশ্চিমা যুদ্ধাস্ত্র দিয়েই তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
কোন কোন দেশ যদিও রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকেও কিছু অস্ত্র সরবরাহ গ্রহণ করেছে। তবে তাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর । বর্তমানে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধে ভারত রাজনৈতিকভাবে খানিকটা সুবিধাজনক অবস্থান গ্রহণ করেছে। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার বিপক্ষে আজ অবধি ভারত একটা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করে অব্যাহতভাবে তারা রাশিয়ান তেল সস্তা দামে কিনছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খানিকটা বিব্রতকর অবস্থার কারণ। এই যুদ্ধের অল্প আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরাপত্তার কথা বলে জোট গঠন করেছে: জাপান অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে সাথে নিয়ে, কোয়াড তার নাম।
জোটের সদস্য হয়ে ভারত রাশিয়ার পক্ষ্ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধিতায় লিপ্ত হবে তা কখনোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা না । ধারণা করা যায় সাম্প্রতিককালের নূপুর শর্মা ও জিন্দালের ভূমিকাকে যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছে তা হয়তো পৃথিবীকে এক নতুন মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পর্দার অন্তরালের ধর্মীয় মেরুকরণ প্রকাশ্যে চলে আসছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রতিক্রিয়াকে ভারতের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নাই। ভারতের এক বিশাল জনগোষ্ঠী এই দেশগুলোতে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত রয়েছে। বাৎসরিক প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স আসে ওই দেশগুলো থেকে। প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ লাখ শ্রমিক সেখানে কর্মরত। ভারতের জন্য বিষয়টি খুবই কঠিন।
পশ্চিমাদের সাথে ভারত যত সহজভাবে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে কূটনৈতিক সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে কিংবা মতদ্বৈততায় লিপ্ত হয়েছে তাতে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশগুলোর অবস্থানকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ তাদের নাই। সেই বিবেচনায় নুপুর শর্মা ও জিন্দালের মতন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মীদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছে ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিজেপি ।
আবার অন্যদিকে, নূপুর শর্মার মামলাটির সঙ্গে ভিন্ন ধর্মের কজন মুখপত্রের নাম জড়িয়ে মামলাটিকে একটি ভিন্ন মাত্রা দেওয়া হয়েছে। এ মামলায় হায়দ্রাবাদের মুসলিম ধর্মীয় নেতা আসাউদ্দিন ওয়াসির নাম সংযোজন করা হয়েছে। বলা হয়েছে এরা সকলেই ধর্মীয় বিভাজনের পক্ষে ভারতীয় সংবিধান ভঙ্গ করছে।
প্রথমদিকে নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে মামলার কথা বলা হলেও পুলিশি নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে নূপুর শর্মাকে দলীয় গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে। যে মামলাটি সেখানে করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে এই মামলা ভারতের বিচারের আদালতে কোনদিনই নিষ্পত্তি হবে না। কারণ এটি একটি অত্যন্ত বড় পরিসরের মামলা। এর নিষ্পত্তি করা ভারতের বিচার বিভাগের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে না।
এদিকে সত্যি সত্যি যদি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ ভারতের বিরুদ্ধে গ্রহণ করে তবে তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের এই শ্রমিক ফিরে এলে অর্থনীতির উপর যে আঘাত আসবে তার ফলাফল নিম্নবিত্ত মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই বিবেচনায় যদি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিষয়টাকে স্বাভাবিক না করে তাহলে বুঝতে হবে যে এটি একটি পশ্চিমা কূটনীতি, ভারতকে চাপের মুখে ফেলাই মূল উদ্দেশ্য।
আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। সমঝোতার রাস্তা উন্মুক্ত হচ্ছে না। যুদ্ধ সম্পর্কে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল যে মন্তব্য করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার ছয় মাস পরে প্রথম প্রকাশ্যে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন গণমাধ্যমের সাথে তিনি। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন যে পশ্চিমারা ইউক্রেনের এই বিষয়টি সঠিকভাবে মোকাবেলা করেনি, তাদের ব্যর্থতা এই যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী করেছে । যদিও যুদ্ধের জন্য পুতিনের ভূমিকাকে তিনি সমর্থন করেননি।
সাক্ষাৎকারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে ইউক্রেনের বিষয়ে পুতিনের সঙ্গে কোনো কথা বলবেন কিনা? তিনি তাতে না-সূচক জবাব দিয়েছেন, কারণ তার দেশের বর্তমান সরকার যেভাবে বিষয়টি নিষ্পত্তি করছে সেখানে তার কোনো ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নাই। যদি তাকে কেউ এ বিষয়ে কোনো মতামত দিতে বলে তখন হয়তো তিনি কথা বলবেন। তার অতীত ভূমিকা নিয়ে অর্থাৎ জর্জিয়া যখন ন্যাটোতে যোগদানের প্রস্তাব করেছিল তখন তিনি যে বিরোধিতা করেছিলেন সে বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়। সে সময় যদি জর্জিয়ার বিষয়টি নিষ্পত্তি করার সুযোগ দেওয়া হতো তাহলে ইউক্রেন পরিস্থিতি আজকের জায়গায় পৌঁছাত না। কারণ ওই ধারাবাহিকতায় ইউক্রেন হয়তো ন্যাটোর সদস্য হত। পশ্চিমা গণমাধ্যম মনে করে যে ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য পদ থাকলে পুতিন আক্রমণ করত না।
জবাবে মার্কেল বলেন, গণতান্ত্রিকভাবে ইউক্রেন প্রস্তুত ছিল না কিংবা সামযরিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। গত ১০ বছরে ইউক্রেন বর্তমান অবস্থানে এসেছে। নিজেকে করেছে, এতে তার পক্ষে হয়তো ন্যাটোতে যোগদানের মতন অবস্থা হয়েছে । কিন্তু পুতিন কোনভাবেই ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান মেনে নেবে না।
কৌশলগতভাবে পশ্চিমারা ইউক্রেন রাশিয়ার বিষয়টি সঠিকভাবে সামলায়নি বলে মন্তব্য করেছেন মার্কেল ।
ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় দীর্ঘায়িত হতে পারে। এই যুদ্ধ মার্কিনিরা অতীতকে আফগানিস্তানের মাটিতে আটকে দিয়েছিল, যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে দিয়েছিল এবং সেই পরাজয়ের পরিণতিতে ৯০ দশকের গোড়াতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছিলো, এরকম একটি রাস্তাতেই হাঁটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তি।
বর্তমানে বিশ্ব শাসন করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মুদ্রাব্যবস্থার মাধ্যমে। রাশিয়া চীন বারবার চেষ্টা করছে মার্কিন ডলারের এই মুদ্রা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য । ইউক্রেইন যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে সেই রাস্তাকে বিনষ্ট করা মার্কিনীদের প্রধান লক্ষ্য। মুদ্রাব্যবস্থার বিপক্ষে যদি চীন এবং রাশিয়া নতুন কোনো বাণিজ্যিক মুদ্রা তৈরি করতে পারে তাহলে মার্কিনীদের বিশ্বের উপর যে প্রভাব তা বিলুপ্ত হবে । সে কারণে মার্কিনিরা এই যুদ্ধে কোনোভাবেই পরাজয় মেনে নেবে না।
তার একটি উদাহরণ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে একটি অবস্থান সৃষ্টি করা যাতে ভারত ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে পশ্চিমাদের অনুসৃত পথ গ্রহণ করে। ভারতীয় সমাজের বিচারে বিগত ৮/৯ বছরের সংঘটিত সকল ঘটনাসমূহ ও ধর্মীয় বিভাজনের গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করলে নূপুর শর্মা ও জিন্দালের কথাবার্তা নতুন কিছু নয়। বিষয়টা গুরুত্ব পেয়েছে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে।