কেকের মৃত্যু, ‘বাবুই পাখি রাষ্ট্রে’র এক নাগরিকের চোখে 

মতামত

01 June, 2022, 04:20 pm
Last modified: 01 June, 2022, 06:28 pm
বিশাল ভারতে কেকের সাফল্য সম্ভবত অ-হিন্দিভাষী হয়েও রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দিতে গান গেয়েই হিন্দি ও অ-হিন্দিভাষী সহ কোটি জনতার হৃদয়কে স্পর্শ করা- পাশের দেশে আমার মত ভ্যালাভোলাদের মন ছোঁয়াও- তাঁর ব্যর্থতাও সম্ভবত ওটাই। নিজের ভাষায় গান গেয়ে কোটি মানুষের হৃদয় ছোঁয়া হয়নি তাঁর। অবশ্য সে তো লিথুয়নীয় ভাষার দস্তয়েভস্কিকেও রুশ ভাষায় লিখেই কোটি মানুষের মনকে জয় করতে হয়েছে।

আমি একদমই একথা স্বীকার করতে লজ্জা পাব না যে কেকে নামের কোন গায়কের নাম আমি গতকালই প্রথম জেনেছি- অথচ, হায়...ফেসবুকে তাঁর নাম ও ছবি দেখে শুরুতে না চিনলেও তাঁর গানগুলো শুনে এক লহমায় চিনে গেলাম। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে যে কারো মৃত্যুই খুব দুঃখজনক। ছবিতে তাঁকে স্বাস্থ্য সচেতন, ফিট ও বয়সের চেয়ে হাজার গুণে তরুণতর দেখতে এক গায়ক বলেই মনে হয়েছে। তাঁর পুরো নাম কৃষ্ণকুমার কুন্নথ । 

তাঁর অনেক গানই বিশেষত: ``হাম রহে ইয়া না রহে , ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল "আমাদের প্রজন্মের সবার হৃদয়কে কোন না কোন সময়ে দ্রবীভূত করেছে। ফেসবুকে গতকাল তাঁর মৃত্যর পরই কেবল বাংলাদেশেও যে এই শিল্পীর এমন বিপুল ভক্ত-মন্ডলী ছিল সেটা জানা গেল। 

গতকাল কলকাতার নজরুল মঞ্চে তাঁর কনসার্টে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে স্বাক্ষ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে উদ্যোক্তাদের অবহেলাই তাঁর মৃত্যুর কারণ। দর্শক-শ্রোতা ধারণ ক্ষমতার চারগুণ মানুষ ঢোকায় নজরুল মঞ্চ কর্তৃপক্ষ তাদের সবগুলো এসি বন্ধ করে দেয় । হাজার হাজার দর্শক, মঞ্চের অত আলোর গরমে শিল্পীর অনেক অনুরোধ, তোয়ালে দিয়ে ঘাম মোছা ও বারবার জল পান করার পরও কর্তৃপক্ষ না এসি চালু করেছে, না তাঁকে বিশ্রাম দিয়েছে! 

এছাড়াও এই আয়োজনের উদ্যোক্তারা তাদের আত্মীয়-পরিজনসহ প্রায় ৫০/৬০ জন মঞ্চের উপরে উঠে শিল্পীর সাথে ছবি তুলতে গেলে মঞ্চের পরিসর সঙ্কুচিত হয়ে শিল্পীর একটু বাতাস বা দম পাওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকগুলো হিট গানের পরেও সাম্প্রতিক সময়ে কেকে বলিউডে কাজ পাচ্ছিলেন না। তাই কলকাতায় এসেছিলেন। বোধকরি সঙ্গীত ভুবনের রাজনীতি ছিল।

এছাড়াও মিডিয়ার এটাই নিয়ম। কিছুদিন কাউকে তুলবে, তারপর আস্তে আস্তে ফেলে দেবে বা এক টানেই হয়তো ছুঁড়ে ফেলে দেবে। এটাই নিয়ম। চাপের মুখে শিল্পীকে তাই গান গেয়ে যেতেই হয়। তারপর? মৃত্যু। আমরা যে শুধুই রিক্সাওয়ালা বা পোশাক শ্রমিকদের কথা বলি...একজন লেখককে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা গদ্য লিখতে হয় বলতে গেলে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়া- উন্নয়ন পেশার মানুষ যখন দিন-রাত কাজ করে...শ্রম অধিকার কোথায় কার আছে?  

তবু কলকাতায় যা হয়েছে সেটাই হয়তো আর একটু বেশি আর্থিক স্বাচ্ছল্য বা 'শিল্প-সাহিত্য' কিছু কম বুঝলেও অধিকতর 'পেশাদার'  দিল্লি বা মুম্বাইয়ে এমনটা হতো না। এমনকি হয়তো ঢাকাতেও এটা হতো না। কারণ হিসেবে ঢাকার মানুষের গড়ে 'শিল্প-সাহিত্য' কিছু কম বোঝা ও 'কর্ম সংস্কৃতি' কিছু বেশি থাকাও হতে পারে। অবশ্য এসবই অনুমান। শেষ পর্যন্ত শিল্পীদের জীবনটা যেন মান্না দে'র গাওয়া 'সে আমার ছোট বোন' গানের সেই শেষ লাইনগুলোর মতই: 'একদিন শহরের সেরা জলসা/ সেদিনই গলায় তার দারুণ জ্বালা/ তবুও শ্রোতারা তাকে দিলো না ছুটি/ শেষ গান গাইলো সে পড়ে শেষ মালা।'  তা 'সাত কোটি' বাঙ্গালীরে বঙ্গজননী ত' মানুষ কোনোদিনই করেননি।

এদিকে নেটমাধ্যমে কেকে নিয়ে নিয়ে বাংলার অনুরাগীদের উল্লাস চোখে বিঁধেছে ভারতের জাতীয় পুরস্কারজয়ী গায়ক রূপঙ্কর বাগচীর, তিনি মন্তব্য করেছেন: "আজ শো করতে কেকে কলকাতায় এসেছিলেন। ওয়ান অ্যান্ড ওনলি কেকে। এই শো নিয়ে তুমুল উত্তেজনা। তাঁর কনসার্টের কিছু লাইভ ভিডিয়ো দেখছিলাম। তিনি 'ওয়ান্ডারফুল' গায়ক। কিন্তু, আমার মনে হল সোশ্যাল মিডিয়ায় এই রকম ভিডিও আমার রয়েছে, সোমলতা, ইমন মনোময়, রাঘব, উজ্জ্বয়িনী, ক্যাকটাস, রূপমের রয়েছে। আমি গান শুনে যা বুঝলাম আমরা কেকে-র থেকে সবাই ভালো গান গাই। কেন আমাদের নিয়ে এত উত্তেজনা বোধ করেন না বলুন তো!"

তার এরকম মস্তব্যের একদম পরপরই কেকের এমন মৃত্যুতে সেই রূপঙ্করের বক্তব্যকে আসলেই মেনে নেওয়া কঠিন...তবে সেই শিল্পীও হয়তো শুধুমাত্র ভাষিক সংখ্যালঘিষ্ঠতার কারণে ক্রমাগত কোণঠাসা হওয়া, দানবীয় বলিউডি সংস্কৃতি ও তার পুঁজির কাছে অন্য সব ভাষা বা জাতিসত্ত্বার ক্রমাগত হেরে যাওয়ার ক্ষোভ থেকে এমনটা বলে থাকতে পারেন। ঢাকায় ঐ রাতে খাবার টেবিলে বসার সময় পাঁচ-দশ মিনিট যে 'স্টার জলসা' চোখে পড়ে, সেই বাংলাভাষী টিভি চ্যানেলে বা একটি বাংলা ভাষা-ভাষী ভূ-খন্ডের টিভি নাটকে গান দেখালেই যদি হিন্দি গান দেখানো হয়, তখন সেই ভাষার এক সঙ্গীত শিল্পীও বিপন্ন বোধ করতে পারেন কিন্ত। 

শিল্পীর শুদ্ধতা রেখে সব ধরনের অসঙ্গতির ভেতর লড়াই করা আসলেই কঠিন। কেকে নিজেও কি জন্মসূত্রে হিন্দিভাষী ছিলেন? না। তাঁকেও হয়তো সেই আপোষ করে অন্যের ভাষাতেই গান গাইতে হয়েছে। অন্তর্জালে যা বুঝলাম ওপারের যে বাঙ্গালীরা ভারত রাষ্ট্রের অখন্ডতায় আজও শ্রদ্ধাশীল এবং এই শ্রদ্ধাশীলতার সুতোয় বলিউডের দানবীয় হিন্দি সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা তাদের গ্রাস করছে, তারা রূপঙ্করের প্রতি ক্ষুব্ধ।

তবে এরা আবার আরবান নক্সাল জাতীয় বাকবিধি ব্যবহার করেন না বলে তাদের সাথে মানুষ হিসেবে মেলা-মেশা সহজতর। আবার 'বাঙলা' ও 'বাঙ্গালী'র স্বার্থের কথা ভাবা অনেকের আরবান নক্সাল জাতীয় বাকবিধি তৃতীয় কোন অপরিচিতের ভেতর অস্বস্তি বোধ করতে পারে। সোজা বাংলায় বিপ্লব বুঝে-শুনে করা আর কী!

কিন্ত এই যে আমি বিশাল ভারতের কেউ নই, পাকিস্তানেরও না...বাবুই পাখির মত ছোট-খাটো একটি স্বকীয় রাষ্ট্রের মানুষ...ডিশ সংস্কৃতির বদৌলতে হিন্দি গান আমার কানেও আছড়ে পড়ে...তবু বয়সে ষাট-সত্তর না হলেও পঙ্কজ কুমার মল্লিককে চিনি অথচ কেকের নাম জানতাম না- এমন পারিবারিক আবহের মানুষ আমি- তবু তাঁর মৃত্যুর পর এই যে তাঁর গান শুনেই চিনলাম ও ভাষার ব্যবধান পার হয়েই তাঁর একটি বা দু'টি যে গান আমার খুব প্রিয় ছিল- এখানেই তাঁর অমরত্ব। এখানেই বড় পুঁজি ও বলিউডি সংস্কৃতির সাফল্যও বটে।

যেমন ওপারের যে শিল্পী তাঁকে নিয়ে বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তাঁর গান নানা কারণেই শোনা হয়ে ওঠেনি। সুমন-অঞ্জন-নচিকেতা ও প্রসেনজিত অভিনীত সিনেমায় কণ্ঠদানের বদৌলতে বড় জোর অনুপম রায় পর্যন্ত শুনেছি- তার বাইরেও রূপম ইসলাম থেকে রূপঙ্করকে না শোনা- আমারই প্রবল অজ্ঞতা।

বিশাল ভারতে কেকের সাফল্য সম্ভবত অ-হিন্দিভাষী হয়েও রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দিতে গান গেয়েই হিন্দি ও অ-হিন্দিভাষী সহ কোটি জনতার হৃদয়কে স্পর্শ করা- পাশের দেশে আমার মত ভ্যালাভোলাদের মন ছোঁয়াও- তাঁর ব্যর্থতাও সম্ভবত ওটাই। নিজের ভাষায় গান গেয়ে কোটি মানুষের হৃদয় ছোঁয়া হয়নি তাঁর। অবশ্য সে তো লিথুয়নীয় ভাষার দস্তয়েভস্কিকেও রুশ ভাষায় লিখেই কোটি মানুষের মনকে জয় করতে হয়েছে।

সেই হিসেবে বরং বাংলাদেশে যে অনিমেষ রায় তাঁর হাজং ভাষার গান দিয়ে লাখো মানুষের হৃদয় ছুঁতে পারলেন, এটা আমাদের অনেক ক্ষুদ্রতা, অনেক নিষ্ঠুরতা আর অনেক অন্যায়ের ভেতরেও একটি বড় অর্জন। 'কোক স্টুডিও বাংলা'র পুঁজি এখানে কিছুটা বুদ্ধিদীপ্ত আচরণও করেছে বৈকি।

যদিও এটা ধারাবাহিক ভাবে 'কোক স্টুডিও বাংলা' করতে পারবে কিনা জানি না। না পারার সম্ভাবনাই বেশি। আমাদের ঝর্ণা বসাক ওরফে 'শবনম' হয়ে উঠেছিলেন উর্দু ছবির সেরা অভিনেত্রী। চেহারায় কবরীর মত সাদা-সিধে বাঙ্গালীনী নন, রূপে খানিকটা আর্যাবর্ত ঘেঁষা ছিলেন বলেই মুম্বাইয়ে এক বাঙ্গালিনী সুচিত্রা সেন পর্যন্ত খুব বেশি জয়ী না হলেও আর্যাবর্তের আর একটি বড় অংশের সিনে শহর লাহোরে শবনম দাপটে তাঁর বিজয় রথ চালিয়েছেন বহু বহু দিন। হলিউড 'দ্য জিভাগো' বানালে ইংরেজিতেই বানায়। 

মুম্বাইয়ের 'দেবদাস'-এ যেমন একটি/ দু'টো বাংলা শব্দ বড়জোর ব্যবহৃত হতে পারে। বলিউড যত পরিসর দিক শাহরুখ খানকে, তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলোর নব্বই শতাংশের নাম 'রাহুল। 'ঐ ঘুরে-ফিরে 'রাহুল শর্মা' বা 'রাহুল খান্না' বা 'রাহুল কাপুর' ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি 'রাহুল নায়ার' বা 'রাহুল গাঙ্গুলি' পর্যন্ত না!

উত্তর ভারতীয় পৌরুষই হবে পৌরুষ। বাংলা বা দক্ষিণের ব্রাহ্মণেরই সেখানে পাত্তা নেই ত' অন্যরা। মণিপুর-অরুণাচল-ত্রিপুরার মানুষের কথা কে আর ভাববে? ঠিক যেমন স্বাধীন হবার আগ পর্যন্ত পাক ক্রিকেট টিমে বড় জোর একজন কি দু'জনের বেশি বাঙ্গালী খেলোয়াড় জায়গা পেত না। হ্যাঁ, শাহরুখ 'মাই নেম ইজ খান'-ও করেছেন বটে। সেটা ব্যতিক্রমই বটে। সংখ্যালঘুর ভবিতব্য এটাই। 


  • অদিতি ফাল্গুনী একজন কথাসাহিত্যিক, কবি, অনুবাদক

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.