বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০২২: পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে তামাকের ব্যবহার

মতামত

31 May, 2022, 01:35 pm
Last modified: 31 May, 2022, 03:26 pm
এ বছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য, 'পরিবেশকে রক্ষা করো'। তামাক প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৮০ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, আবার ৮০ মিলিয়ন (৮ কোটি) টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন করে।
প্রতীকি ছবি/সংগৃহীত

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে ১৯৮৭ সালে স্বাস্থ্যের নানা ঝুঁকি বিশেষ করে তামাকের মৃত্যু ও অসুস্থতা রোধে বছরে একটি দিন ধূমপান থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার করে এপ্রিলের ৭ তারিখ তামাকমুক্ত দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত হয় এবং এক বছর সেটা পালনও করা হয়েছে। সেটা ছিল ২৪ ঘণ্টা ধূমপান না করার অঙ্গীকার। কিন্তু ১৯৮৮ সালে আর একটি রেজ্যুলিউশান গ্রহণ করে মে মাসের ৩১ তারিখ বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এই দিনেও ২৪ ঘণ্টা কোন প্রকার তামাকদ্রব্য ব্যবহার না করার অঙ্গীকার করা হয়।

তামাকের প্রসঙ্গ আসলেই তার সাথে স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান আমরা পাই। তার সাথে আরও পাই তামাক কোম্পানিগুলো কী করে সমাজে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে, কী করে সরকারের নীতি নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করে তারা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন থাকা সত্ত্বেও বাস্তবায়ন কঠিন করে রাখছে। তামাক পণ্যের ওপর করারোপ করতে গেলে বাধা দিচ্ছে, আবার কোম্পানি নিজেই সর্বোচ্চ ভ্যাট প্রদানকারী হিসেবে পুরস্কার বাগিয়ে নিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাকমুক্ত দিবস নিয়ে ভাবলেও তার সব সদস্য রাষ্ট্রের সম্মতিতে একটি সনদ করতে পেরেছে মাত্র ২০০৪ সালে, যা ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশান অন টোবাকো কন্ট্রোল (সংক্ষেপে এফসিটিসি) নামে পরিচিত এবং এই সনদের আলোকে সরকারগুলো নিজ নিজ দেশে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে। বাংলাদেশ সরকার এই ব্যাপারে খুব তাড়াতাড়ি সাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন 'ধূমপান ও তামাকদ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫' প্রণীত হয়েছে যা  ২০১৩ সালে একবার সংশোধিত হয়েছে, এখন আবার সংশোধনের প্রক্রিয়ায় আছে। আইনকে বাস্তবায়নযোগ্য করে তোলার চেষ্টায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য তামাক যে হুমকি সৃষ্টি করেছে, তা নিয়ে আর কোন বিতর্ক নেই। প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর ১৯% তামাক সেবনের কারণে হয়, সংখ্যায় বছরে গড়ে ১,৬১,০০০ মানুষ তামাক সেবনের কারণে মারা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৮ সালে এই তথ্য দিয়েছে। হৃদরোগ সংক্রান্ত মৃত্যুর ২৪% তামাকসেবীদের হয়। এত অসুস্থতা, এত অকালমৃত্যু একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

তামাকের কারণে জনস্বাস্থ্যের হুমকি নিয়ে কোন বিতর্ক নেই সত্য, কিন্তু তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তা যথেষ্ট নয়। বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০২২- এ এই কথা বলতে চাই যে শত আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও সরকার তামাক কোম্পানির কব্জা থেকে বের হতে পারছে না, কারণ ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির মতো বড় কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার আছে।

এ বছরের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের যে প্রতিপাদ্য তাতে উদ্বেগের কারণ আরো বেড়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ''Protect the environment'' অর্থাৎ পরিবেশ রক্ষা করো। তামাক সামাজিক পরিবেশ তো নষ্ট করেই, প্রাকৃতিক পরিবেশও মারাত্মকভাবে হুমকির মধ্যে ফেলেছে, এই বিষয়টি এখন নজরে আনা জরুরি মনে করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তামাক প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৮০ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, আবার ৮০ মিলিয়ন (৮ কোটি) টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন করে।

ফরিদা আখতার। প্রতিকৃতি: টিবিএস

তামাক সবচেয়ে বেশি আবর্জনা সৃষ্টিকারী পণ্য। যেখানেই সিগারেট, বিড়ি খাওয়া হয়, সেখানেই তার ছাই এবং শেষাংশটা আবর্জনা হয়ে থাকে। যেখানে পানের সাথে জর্দা, সাদাপাতা খাওয়া হয়, সেখানে লাল থুথু পড়ে পরিবেশ নষ্ট করে। গুল ব্যবহারকারীদের ছোট ছোট প্লাস্টিকের কৌটা যেখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায়। যেসব কার্যালয় ধূমপান বা তামাকমুক্ত নয়, সেখানে সিঁড়ির ধাপে ধাপে বালি দিয়ে একটা পাত্র রাখা হয়, যেন সিগারেটের শেষাংশ (Butt) সেখানেই ফেলা হয়, যদিও ধূমপানকারীদের সেই হুঁশ সব সময় থাকে না। রাস্তাঘাটে, রেলস্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে, সমুদ্রের তীরে, এমনকি হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই সিগারেট বাট পাওয়া যায় আবর্জনা হিসেবে। বাড়িঘরে ড্রয়িংরুমে এশট্রে বা ছাইদানি রাখা হত ধূমপায়ী মেহমানদের সিগারেট আবর্জনা ফেলার জন্যে। যা ভরে গেলে ঘরে আবর্জনার সৃষ্টি করে। বাস বা গাড়িতে বসে যারা ধূমপান করেন তাদের বেশিরভাগ অনায়াসে সিগারেট খাওয়ার পর জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেন; নৌযানে যারা যান তারা নদীতে ফেলে দেন, রেলের যাত্রীরা চলন্ত অবস্থায় বাইরে ফেলে দিয়ে বসে থাকেন।

সিগারেট বাট দেখতে কাগজের তৈরি মনে হলেও আসলে এটা একধরণের প্লাস্টিক, যা cellulose acetate (সেলুলুজ এসিটেট) জাতীয় প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি এবং এর মধ্যে রয়েছে শতাধিক বিষাক্ত কেমিক্যাল দ্রব্য। এগুলো মাটিতে মিশে যেতে কমপক্ষে ১০ বছর লাগবে, আর এর মধ্যে যে কেমিক্যাল রয়েছে তা পরিবেশে আরো অনেক বছর থেকে যাবে। প্রায় ৪.৫ ট্রিলিয়ন সিগারেট বাটের প্লাস্টিক আবর্জনার শিকার হচ্ছে এই বিশ্ব। বাংলাদেশে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে ১২ কোটি ৩০ লক্ষ সিগারেট খাওয়া হয়, অর্থাৎ সমপরিমাণ বাটের আবর্জনা ফেলে দেয়া হয়। এখানে যারা মাঝে মাঝে সিগারেট খান তাদের সংখ্যা যোগ করলে আরো বেশি বাটের আবর্জনা সৃষ্টি হয়। প্রতিদিন ৭ কোটি ২০ লক্ষ বিড়ি সেবন করা হয়, যার সমপরিমাণ বাট আবর্জনা তৈরি হয়।

সিগারেটে প্রায় ৭০০০ কেমিক্যাল আছে যা একদিকে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে অন্যদিকে সিগারেটের শেষাংশ মাটি এবং পানিকে দূষিত করে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র কণার প্লাস্টিক ভেঙ্গে গিয়ে কেমিক্যালগুলো পরিবেশ দূষিত করে।

তামাক, ধোঁয়াযুক্ত বা ধোঁয়াবিহীন, যাই হোক না কেন, এর উৎপাদনও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রক্রিয়ার মধ্যে ঘটে।  
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.