শিশুদের পোস্ট কোভিড ট্রমা: মাদকের মতোই ভয়ানক যে আসক্তি

মতামত

23 May, 2022, 01:15 pm
Last modified: 23 May, 2022, 08:53 pm
মাদক না পেলে একজন নেশাখোর যেমন অস্থির হয়ে উঠেন, স্ক্রিন আসক্ত শিশুর কাছ থেকে মোবাইল/ ট্যাব কেড়ে নিলে ঠিক তেমনিই প্রতিক্রিয়া দেখায়। মনোবিজ্ঞানীরা এই মাদককে ‘ডিজিটাল কোকেন’ নামে অভিহিত করেছেন।

কেস স্টাডি-০১

মন্টু সাহেবের মেয়ে নবনীতা। কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠতো। কিন্তু এখন উঠে সকাল দশটায়। করোনার কারণে দুই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায়, তার রুটিন পরিবর্তন হয়ে গেছে। সারারাত মোবাইলে পড়ে থাকে, সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠে, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করে না, মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে, অল্পতেই রেগে যায়।

কেস স্টাডি-০২

ফারহান এখন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। কোভিডের কারণে টানা দুই বছর স্কুলে যেতে হয় নি। অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে মোবাইলে গেমস খেলতো। সে এখন পুরোপুরি মোবাইল আসক্ত। অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে যে চোখের ডাক্তার পর্যন্ত দেখাতে হয়েছে। এখন চশমা পড়েই মোবাইলে বুদ হয়ে থাকে। মোবাইল কেড়ে নিলে চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো বাড়ি এক করে ফেলে।

কেস স্টাডি-০৩

আবরার, বয়স দশ বছর। সারাদিন কার্টুন দেখে। বাইরে বের হতে চায় না, কারো সাথে মিশতে পারে না। মেহমান আসলেও কথা বলে না। কেমন যেন অসামাজিক হয়ে গেছে! অথচ করোনার আগেও সে সবার সাথে মিশতো, পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলতো। লকডাউনের সময় মা তাকে কার্টুন ছেড়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করতো।

উপরের তিনটি ঘটনা হচ্ছে চারপাশে (কোভিডকালীন সময়ে) ঘটে যাওয়া অসংখ্য দুঃসংবাদের কয়েকটি উদাহরণ। বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ- পোস্ট কোভিড ট্রমা। প্রাপ্তবয়স্কদের কোভিড পরবর্তী স্বাস্থ্যগত দিক নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। শিশুদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ততটা মনোযোগ পায়নি। আমরা মনে করেছি শিশুদের মধ্যে কোভিড আক্রান্তের হার কম, তাই তাদের পোস্ট কোভিড ট্রমা বিষয়টি অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ শিশুদের শারীরিক ট্রমা থেকেও মানসিক ট্রমা যে মহামারি আকার ধারণ করেছে, সেটা আমাদের ভাবনার অগোচরে।

এবার একটু খোলাখুলি আলোচনা করা যাক। করোনার সময়ে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি ছিল শিশুদের ঘরে বন্দী রাখা। বাস্তব কারণেই অভিভাবকদের এই কাজটি করতে হয়েছে। যে বয়সে শিশুরা বাইরে ছোটাছুটি করবে, স্কুলে যাবে, বন্ধুবান্ধবদের সাথে খেলাধুলা করবে সে সময়ে শিশুরা গৃহবন্দী। ছোট একটি বাসায় কতক্ষণ বসে থাকা যায়? অভিভাবকরাও নিরুপায়। ঠিক কী করবে? বুঝে উঠতে পারছিলেন না। স্বাভাবিকভাবেই শিশুদের সময় কেটেছে টিভিতে কার্টুন দেখে অথবা কম্পিউটারে গেমস খেলে অথবা মোবাইলে ইউটিউবে ভিডিও দেখে। মা-বাবাও বিষয়টিকে সহজভাবে মেনে নিয়েছে।

যখন অনলাইনে ক্লাস শুরু হলো তখন শিক্ষার্থীদের দিনের একটি অংশ কাটতো মোবাইল অথবা ট্যাবের স্ক্রিনের সামনে তাকিয়ে। এভাবে অনেকদিন কেটে গেল। আমরা মনে করছি শিশুর শিক্ষা কার্যক্রমকে কিছুটা হলেও চালু রাখতে পেরেছি। এটা নিঃসন্দেহে এক সাফল্য। কিন্তু এই সাফল্যের অন্তরালে অনেক ভয়ংকর ক্ষতি হয়ে গেছে যা আমরা বুঝতেই পারিনি।

সবচেয়ে ভয়ংকর যে ঘটনাটি ঘটেছে তা হলো স্ক্রিন আসক্তি। বেশিক্ষণ স্ক্রিনের সামনে সময় কাটানোর ফলে অনেক শিশুর মধ্যে স্ক্রিন এর প্রতি আকর্ষণ আসক্তির পর্যায়ে চলে গিয়েছে। বিষয়টি মাদকের মতোই ভয়ংকর। মাদক না পেলে একজন নেশাখোর যেমন অস্থির হয়ে উঠেন, স্ক্রিন আসক্ত শিশুর কাছ থেকে মোবাইল/ ট্যাব কেড়ে নিলে ঠিক তেমনিই প্রতিক্রিয়া দেখায়। মনোবিজ্ঞানীরা এই মাদককে 'ডিজিটাল কোকেন' নামে অভিহিত করেছেন। তারা লক্ষ্য করেছেন যে স্ক্রিন আসক্ত শিশু এবং কোকেন আসক্ত মানুষের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ব্রেইন স্ক্যানে এই দু গ্রুপের ছবি একই রকম। দু'দলেরই মস্তিষ্কের সামনের দিকের হোয়াইট ম্যাটারগুলো ক্ষয়ে যাওয়া।

ব্রেইনের হোয়াট ম্যাটার নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের আবেগ, মনোযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা। হোয়াইট ম্যাটার ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে আবেগ ভারসাম্যহীন হয়, মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়।

অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে, অনেক শিশু দরজা বন্ধ করে রাত জেগে সোশ্যাল মিডিয়া বা ইন্টারনেট বা ভিডিও গেমস বা পর্ণ সাইটে বুদ হয়ে থাকে। অথবা কম্বলের নিচে সারা রাত ট্যাব অথবা স্মার্টফোনে সময় অতিবাহিত করছে। মা-বাবা মনে করে শিশু শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। প্রতিদিন ক্রমাগত ঘুম বিঘ্নিত হওয়ার কারণে এর প্রভাব পড়ছে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যে। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, ক্ষুধামন্দা, অস্থিরতা ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিচ্ছে। যার ফলে ক্লাসে মনোযোগী হতে পারছে না, পড়াশোনার পিছিয়ে যাচ্ছে।

স্ক্রিন আসক্তির কারণে নড়াচড়া কম হচ্ছে, যা শিশুর স্বাভাবিক মনোদৈহিক বিকাশকে চরমভাবে ব্যহত করছে। শিশুরা মুটিয়ে যাচ্ছে, হাড় ও মাংসপেশীর গঠন মজবুত হচ্ছে না। এসব শিশুদের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও খুব বেশি। স্ক্রিন থেকে প্রতিনিয়ত রেডিয়েশন বিকিরণ হচ্ছে, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে স্বাস্থ্যের উপর। চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সারাক্ষণ কাছের জিনিস দেখার কারণে দূরের জিনিস ঠিকমতো দেখতে পায় না। শিশু বয়সেই চশমা পড়তে হচ্ছে।

স্ক্রিন আসক্তির কারণে অটিজমের মতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে, পারস্পারিক যোগাযোগ দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না, অন্যের কাছে সহজে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছে না।

পরিবারে অবস্থান করেও এই শিশুরা বিচ্ছিন্ন। বন্ধু বান্ধবদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ না হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে অসামাজিক হয়ে উঠছে। যেহেতু মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ কমে যাচ্ছে, তাই তারা মানুষের চেহারার অভিব্যাক্তি বুঝতে পারে না। আরেকজনের আবেগ অনুভূতি ঠিকমত না বুঝার কারণে, পারষ্পারিক যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা একবারেই কম। যদি এভাবে চলতে থাকে, এই শিশুরা বড় হয়ে সহজে কারো সাথে মিশতে পারবে না। ফলাফল- সমাজ বিচ্ছিন্ন, আত্মকেন্দ্রিক, বিপদগামী প্রজন্ম। 

একবার স্ক্রিন আসক্ত হয়ে গেলে শিশুকে সহজে কোন কিছু শোনানো বা বোঝানো যায় না। তারা কোনো কমান্ড বা নির্দেশনা অনুসরণ করতে পারে না। বিচার বিবেচনাবোধ আস্তে আস্তে লোপ পেতে থাকে। মাদকাসক্ত মানুষ যেমন বুঝতে পারে না সে ভুল কাজ করছে, স্ক্রিন আসক্ত শিশুদের অবস্থাও একই রকম। ভার্চুয়াল জগত তথা ফ্যান্টসির মধ্যে ডুবে থাকতেই তারা স্বচ্ছন্দ্যবোধ করে। বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যার ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না তারা। এছাড়াও সাইবার বুলিং, সাইবার অপরাধ ও পর্ণ ভিডিও ওয়েবসাইটে ভিজিটের আশংকা তো আছেই। যা শিশুকে আস্তে আস্তে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাবে।  

অনেক মা-বাবা এখন অসহায়। স্ক্রিন আসক্তি নিয়ে ঠিক কী করবেন- বুঝতে পারছেন না। তারা যখন শিশুকে ধমকান অথবা শিশুর কাছ থেকে মোবাইল/ ট্যাব কেড়ে নেন, এতে শিশু খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায়। চিৎকার চেচামেচি করে, প্রচন্ড অস্থিরতায় ভোগেন এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না- মাদকাসক্তির মতো এটিও এক ধরনের আসক্তি। তাই শোধরানোর কাজটি করতে হবে ধীরে ধীরে, যাতে শিশু বুঝতে না পারে।

স্ক্রিনে সময় কাটানোর পরিমাণ আস্তে আস্তে কমাতে হবে। প্রয়োজনে সময় নির্দিষ্ট করে দিন। যেমন- আপনার শিশু যদি দিনে সাত ঘণ্টা স্ক্রিনের সামনে থাকে, প্রথম দিকে খুব বেশি সময় কমাতে যাবেন না। আপনি বলতে পারেন- এখন থেকে তুমি পাঁচ ঘণ্টা স্ক্রিনের সামনে থাকতে পারবে- সকালে দুই ঘণ্টা, বিকেলে দুই ঘণ্টা, রাতে এক ঘণ্টা। এভাবে আস্তে আস্তে সময়ের পরিমাণ কমাবেন। 

পিতামাতার প্রতি অনুরোধ, যতক্ষণ বাসায় থাকবেন শিশুকে গুণগত সময় দেওয়ার চেষ্টা করবেন। এই সময়টা টিভি বা সোশ্যাল মিডিয়ার পেছনে ব্যয় না করে, সন্তানের সাথে খেলাধুলা করুন। খেলাধুলার সঙ্গী পেলে শিশুও স্ক্রিন থেকে দূরে থাকবে। এই সময়ে শিশুর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক মিথস্ক্রিয়া (অর্থাৎ পরিবার ও আশেপাশের মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ) এবং প্রকৃতির সাথে একাত্মতা (গাছ-পালা, পশু-পাখি, জীব-জন্তুসহ প্রকৃতির সাথে পরিচয় ঘটানো)। তাকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসুন, নদী বা সমুদ্রের কাছে যান, সবুজ ঘাসের উপর হাঁটুন।   

স্কুলগুলোতে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলা-ব্যায়ামসহ নানা ধরনের সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। যেকোনো আসক্তি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে যোগব্যায়াম এবং মেডিটেশন ভালো ফল দেয়। বয়স অনুযায়ী শিশুদেরকে যদি যোগব্যায়াম (সহজ কিছু আসন) এবং মেডিটেশন করানো যায়, নিঃসন্দেহে তা শিশুদের দেহ-মন-মস্তিষ্কে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করবে। এ বিষয়গুলো আমাদের অভিভাবক, শিক্ষক সমাজ ও নীতি নির্ধারণী মহল ভেবে দেখতে পারেন।

শ্যামল আতিক
  • লেখক:প্যারেন্টিং গবেষক

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.