ঈসা ব্রাদার্স, নেশেস্তার হালুয়া, আর খাবারে তবক দেওয়ার বনেদিয়ানা
মতামত
টিকাটুলিতে থাকাকালীন প্রতিটা উৎসব খুব আনন্দমুখর পরিবেশে পালিত হতো। কদিন আগেই শবে বরাত গেল। কিন্তু মনে হলো যেন টেরই পাইনি কিছু।
অথচ আমাদের সময়, এমনকি দশ বছর আগেও জাঁকজমকের সাথে পালিত হতো এই শবে বরাত। ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও আমাদের কাছে কিন্তু শবে বরাত মানে উৎসবের রাতই ছিল। এই উৎসবের আয়োজন শুরু হতো আরও দুদিন আগে থেকেই। প্রত্যেক বাড়ির মায়েদের দেখতাম শবে বরাতের তিনদিন আগ থেকেই ডাল ভেজাতে দিত, এটা বাটতে দিত, ওটা শুকাতে দিত—এভাবে বিভিন্ন উপকরণ প্রস্তুত করা শুরু হতো। আমার মনে আছে, চালকুমড়া পর্যন্ত মায়েরা আগে থেকে শুকিয়ে রাখত। যাতে ওই শবে বরাতে তা দিয়ে হালুয়া তৈরি করা যায়।
আমরা কোনোদিন মাকে দুপুরবেলা আমাদের সঙ্গে খেতে দেখতাম না…
দুপুরবেলা আমরা চার ভাই আগে খেয়ে নিতাম। মায়ের কথা চিন্তাও করতাম না। আমরা খেয়ে ওঠার পর মা গোসল করে এসে তোয়ালে মাথায় জড়িয়ে খেতে বসত। মায়ের এই তোয়ালে জড়ানো চুলের দৃশ্য তো এখন আর দেখতেও পাব না…। যা-হোক, চার ভাইয়ের খাওয়ার পর, যতটুকু বাঁচত, ততটুকুই ছিল মায়ের দুপুরের আহার। বোধহয় এটা ছিল তখনকার মায়েদের নিয়ম।
রান্নাটা শুরু হতো একেবারে আগের দিন রাত থেকে!
দুপুরের রান্না সেরে রাখতে হতো সকালেই। তাই দুপুরের খাওয়ার পর অবসর হয়ে পুরোপুরি হালুয়া বানানোর কাজ শুরু হতো। এই হালুয়া বানানোর কাজে সাহায্য করতেন পাড়ার লোকেরা। এখন তো এটা ভাবাই যায় না!
এই প্রতিবেশীরা এসে ডালটা পিষে দিত, বিভিন্ন কিছু বেঁটে দিত। আর আমরা ছোটোরা চারপাশে খুব ঘুরঘুর করতাম, যদি একটু হালুয়া খেতে দেওয়া হয় এই আশায়!আসলে সবুজ, লাল, হলুদ বিভিন্ন ধরনের চৌকোনা আকারের হালুয়া দেখে খুব লোভ হতো। শুধু মনে হতো, একাই বুঝি সব খেয়ে ফেলব!
বুটের ডালের হালুয়া খুব পছন্দ করতাম। এটা বোধহয় এখনও ঘরে ঘরে বানানো হয়। কিন্তু নেশেস্তা হালুয়া নামে একটা আইটেম ছিল, আমাদের খুব প্রিয়। এটা নাকি খুব দামি ছিল। মনে আছে, মা বলত, 'অনেক পয়সা খরচ হয় এটা বানাতে'।
আমরা ভাইয়েরা ছিলাম খুব দুষ্টু। আমরা সব হালুয়া খেয়ে ফেলতাম। তাই আমাদের ভয়ে মা, বাবার জন্য হালুয়া উঠিয়ে রাখত। যেন বাবা বাসায় ফিরে খেতে পারেন।
আরেকটা পছন্দের খাবার ছিল, ডিমের হালুয়া। একবার মনে আছে, মা খুব দুঃখ করে বলেছিলেন, 'একবারে যে খেয়ে ফেললে, তোমাদের ধারণা আছে এগারোটা ডিম ছিল ওতে?'
কিন্তু আমাদের কি এতে কিছু যায়-আসে? আমরা তো বুঝিই না তখন এগারোটা ডিম মানে কী..। এতই ছোটো ছিলাম!
পাঁচটার সময় মানুষের বাড়ি থেকে হালুয়া আসা শুরু হতো…
শবে বরাতের দিন বিকেল পাঁচটার দিকে দেখতাম, সব রান্না মোটামুটি শেষ, বিশেষ করে হালুয়া তৈরি করা হয়ে যেত। মাগরিবের নামাজের আগেই সব রান্না শেষ করার বোধহয় নিয়ম ছিল তখন।
অন্যদের বাড়িতে হালুয়া পাঠানো হতো, আবার তারাও আমাদের বাড়িতে পাঠাতো। প্লেটে বা কখনো বড় থালায় করে হালুয়াগুলো নিয়ে যাওয়া হতো। বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন রকমের হালুয়া, সাথে চালের রুটি। তাছাড়া, গরুর মাংস, হাঁসের মাংসও রান্না হতো। নামাজ পড়ে এসে সবাই একসঙ্গে মাংস আর রুটি দিয়ে রাতের খাবার খেত আর অন্য বাসা থেকে পাঠানো খাবারগুলো খেয়ে কোন বাসার আইটেমগুলো ভালো হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা বসত।
এই যে একটা সংস্কৃতি, উৎসবের সংস্কৃতি তা এখন আর নেই। এবার যে শবে বরাত হয়েছে তা-ই তো জানতাম না। মসজিদগুলোও ছিল নীরব। অথচ, আগে পাড়ার এই মসজিদগুলো একেবারে কান ফাটিয়ে বিভিন্ন দোয়া, মিলাদ, মাহফিল, কোরান তিলওয়াত করতো। এই মসজিদগুলোতেও হালুয়া পাঠানো হতো।
তখন খাবারে তবক দেওয়া ছিল বনেদি ব্যাপার…
আমাদের বাড়িতে কোনো মুরুব্বি মেহমান এলে মা তাকে তবক দেওয়া হালুয়া খেতে দিতেন। খাবারের উপরে পাতলা রুপালি এক ধরনের আস্তরণ দেয়া হতো। কোনো স্বাদ ছিল না তাতে, কিছুটা কাগজের মতো দেখতে। এরই নাম তবক। একে বোধ হয় এখন 'সিল্ভার পেপার' বলা হয়।
তবকের আলাদা কোনো স্বাদ না পেলেও, খেতে চাইতাম অনেক।
কিছুদিন আগপর্যন্ত দোকানগুলোতে তবক দেয়া মিষ্টি পাওয়া যেত। এখন আর দেখা যায় না তেমন। তবে বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে এই তবক দিয়ে পান সাজানো হয়। কবি আসাদ চৌধুরীর 'তবক দেয়া পান' নামে একটি কবিতাও আছে।
ঈসা ব্রাদার্স
সে সময় আরেকটা জিনিস ছিল, তা হলো গোলাপ জল। শবে বরাতের জন্য যখন বাজার করা হতো, তখন একটা গোলাপ জলও কেনা হতো সাথে।
ঈসা ব্রাদার্স নামে একটা দোকান ছিল নওয়াবপুরে। তখন মনে হয় ৬০-এর দশক। এই দোকান থেকে অনেক জিনিস কেনা হতো, বিশেষ করে তবক, গোলাপ পানি এসব। দোকানটা এখন আছে কি না জানি না। তবে সে আমলে খুব নামকরা ছিল।
গরিবদের মাঝে রুটি বিলানোর সংস্কৃতি…
শবে বরাত মানেই প্রত্যেক বাড়িতে ভিক্ষুকদের ভিড় হবে। এটাই তখন স্বাভাবিক ছিল। ভিক্ষুকরা এসে কিছু বলত না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকত। তারাও জানত, প্রত্যেক বাসা থেকে তাদের রুটি-হালুয়া দেওয়া হবে। তবে ভিক্ষুকদের দেখতাম, তারা শুধু হালুয়াগুলো খেত। রুটিগুলো রেখে দিত পরের দিনের জন্য।
আমাদের বাড়িতে রুটি খাওয়ায় তেমন প্রচলন ছিল না। কিন্তু শবে বরাতের দিন বানানো হতো। এই রুটিগুলো বিভিন্ন বাসায় এবং ভিক্ষুদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হতো।
এলাকায় সবসময় নির্দিষ্ট কিছু বাঁধা ফকির থাকলেও, শবে বরাতের দিন, অন্য পাড়া থেকেও ভিক্ষুক আসত। গরিবদের মাঝে খাবার বিলিয়ে দেয়াটা তখন সামাজিক আচারের মধ্যেই পড়ত।
বাজি ফোটানো তো এখন আর হয় না
এখন তো বাজি ফোটানো হয় থার্টি ফার্স্টে। তখন শবে বরাতেও বাজি ফোটানো হতো। আতশবাজির মধ্যে ফুলঝুরি তুবড়ি আর বোম, এই তিনটা জিনিস খুব কিনতাম আমরা। ফুলঝুরি আর তুবড়ি ফোটাতে আগুনের দরকার হতো, তাই বাবা এসে ফোটাতেন সেগুলো। তাই শবে বরাতের দিন বাবার আসাটা ছিল অনেক আনন্দের বিষয়।
আমি তো খুব ছোটো ছিলাম, আমার ভাইদের দেখতাম এসব ফোটাতে। ফুলঝুড়িটা ধরলে পুষ্পবৃষ্টির মতো স্ফুলিঙ্গ বের হতো। আর আমি পেতাম ভয়। পাশ থেকে তখন ভাইয়েরা অভয় দিয়ে বলতেন, 'আরে কিছু হবে না।' আমিও মনকে সাহস জুগিয়ে ধরে থাকতাম।
আর তুবড়ি ছিল অনেকটা এখনকার জন্মদিনে ব্যবহৃত স্পার্ক্লিং মোমের মতো। আগুনের ফুলকির ফোয়ারা বের হয় এমন।
তবে আমার বড় ভাইয়ের স্বভাব ছিল কিছুক্ষণ পরপর ধুমধাম বোম ফাটানোর। আর আমার বাবা খুব খেপে যেতেন তখন।
থার্টি ফার্স্টের মতো কিছুক্ষণ পরপর পুরো এলাকা জুড়ে শুধু বোমের আর আতশবাজির শব্দ শোনা যেত। এটা খুব ভালো লাগতো আমাদের। উৎসব উৎসব মনে হতো। একবার নাকি বোম ফোটানোর প্রতিযোগিতা করা হয়েছিল পাড়ায়। যে দল বেশি বোম ফাটিয়েছে, তাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল।
খুব কষ্ট হতো নামাজ পড়তে…
আর সবচেয়ে কষ্টের অংশ ছিল যখন নামাজ পড়তে ডাকতো মা। আমার মায়ের বিশ্বাস ছিল, শবে বরাতের রাতে যদি আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া যায়, আল্লাহ তা পূরণ করে। তাই, আমার মা নিজে তো পড়তেনই, আমাদেরও ধরে ধরে নামাজ পড়াতেন। আমার ছোটোভাই ছিল তিন বছর বয়সী। তাকেও পড়াতেন! আর ভয়ে আমার বড় দুই ভাই ঘরেই ঢুকতেন না। আমরা ছোটো দু'ভা-ই মায়ের বলির শিকার হতাম!
তবে বেশিক্ষণ আমাদের নামাজে বসিয়ে রাখতে পারতেন না, কারণ শরীর জায়ানামাজে থাকলেও, মন তো পড়ে থাকত ওই পটকা বাজি ফোটানোর দিকে। ওই বয়সে কি আর এসব ছেড়ে নামাজে মন বসে? তাই আমার মা-ও একসময় ব্যর্থ হয়ে ছেড়ে দিতেন। আর আমরাও দৌড়ে ভাইদের কাছে চলে যেতাম।
পাড়া সংস্কৃতি আজ কই?
পাশের বাড়িতে একটা হিন্দু মেস ছিল। ওই মেসে আমার মা এবং পাড়ার অন্যরাও হালুয়া পাঠাত। ওরা কিছু বানাতো না, শুধু খেত। এখন ভাবি, কত সৌভাগ্য ছিল ওদের!
যা-হোক, তখন পাড়া সংস্কৃতির ধারণাটা খুব প্রবল ছিল। সময়টা ছিল খুব সুন্দর। মানুষের মধ্যে পাড়া সংস্কৃতি ছিল, ভালোবাসা দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক ছিল, ধনী-গরিব মিলেমিশে থাকার সংস্কৃতি ছিল। এখন পাড়াও নেই, সংস্কৃতিও নেই।
ইরানি নওরোজ থেকেই…
পরে যখন দিলু রোডে চলে আসি, আমরা গোটা বাড়ি জুড়ে একশো-দেড়শোর মতো মোমবাতি জ্বালাতাম। মাজারে যেভাবে জ্বালানো হয় অনেকটা সেভাবে। লোকজন ছবিও তুলতে আসত, সেই ছবি ছাপা হতো পত্রিকায়। এটা কিন্তু শুধু আমাদের বাড়িতে না, পাড়ার সব বাড়িতেই তখন মোমবাতি জ্বালানোর চল ছিল। এই চর্চাটা এখন একদম চলে গেছে।
পরবর্তীতে আমরা যখন পাকিস্তান (১৯৬৩) গেলাম, সেখানেও আমার মা শবে বরাতের আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। আমার বাবা তখন বলেছিলেন, 'এখানকার লোকেরা শবে বরাত করাটা খুব অপছন্দ করে।'
আসলে শবে বরাতের ধারণা এসেছে ইরানি নওরোজ উৎসব থেকে। নওরোজ অর্থ নতুন দিবস। ইরানি সংস্কৃতিতে নববর্ষের উৎসবকে বলা হয় নওরোজ। ইরানের সবচেয়ে প্রাচীন উৎসব এটি। শুধু বাংলাদেশে নয়, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজস্ব আচারে মধ্য দিয়ে এ উৎসব পালন করা হয়।
- লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.