ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি এতো কম কেন?

মতামত

21 February, 2022, 06:20 pm
Last modified: 21 February, 2022, 09:19 pm
টেলিভিশনই বুঝি এখন শেষ সম্বল। তারাই যা প্রভাত ফেরি ফি বছর ধরে রাখে। ধরে রাখে শহীদ মিনার। কিন্তু শুধুই নিউজ ক্লিপ কি সংবেদনশীলতা তৈরি করতে পারে বা অনুভূতি যোগান দিতে পারে? যেমনটা পারে চলচ্চিত্র বা বই।

সাকুল্যে তিনটি চলচ্চিত্রের নাম করা যায় – জীবন থেকে নেয়া, বাঙলা ও ফাগুন হাওয়ায়। অথচ ৭০ বছরে পড়ল এবার বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি। সকলেই স্বীকার করেন একাত্তরের ভিত্তি তৈরি করেছে বায়ান্ন। আরো স্বীকার করেন- পৃথিবীতে এমন আন্দোলনের নজির আর নেই। প্রতিবছর একুশ আসে- কোটি মানুষ খালি পায়ে হাঁটে, কালো পোশাক পরে, ফুল দেয় শহীদ মিনারে। ফি বছর সরকারি অনুদানে ডজনখানেক ছবি হয়, বেসরকারিভাবে তো হয় এর দু-তিন গুণ। তাহলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি হয় না কেন? সম্পূরক প্রশ্ন আরো অনেক আছে- যেমন ছবিগুলো কি ব্যবসায়িক সাফল্য পাবে না ধরে নিয়েছেন প্রযোজক-নির্মাতারা? বাঙালির ভাষাপ্রীতি কি আটকে আছে কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই?

১৯৭০ সালের ১১ এপ্রিল মুক্তি পায় 'জীবন থেকে নেয়া'।  ছবিটির পোস্টারে লেখা– একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন। এতে আনোয়ার হোসেনকে দেখা যায়, প্রতিবাদী আর রাজ্জাককে সহযাত্রী, রোজীকে দেখা যায়- দেশপ্রতীকে সর্বংসহা মাতৃজননী রূপে। রওশন জামিল এই ছবিতে পাকিস্তানী অত্যাচারী সরকারের প্রতীক। তিনি একটি চাবির গোছা আগলে রাখেন- যেটি সংসারের ওপর তার নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। একটি সংলাপ তাঁর এমন-  'আমি চাবির গোছা হাতে রাখার জন্য যা দরকার সব করব'। অন্যদিকে, আনোয়ার হোসেনের একটি সংলাপ এমন-'এই মাটিতে আমি জন্মেছি,  এই মাটিতেই বাঁচি। মায়ের মতো লাগে একে, আমার কাছে এটা এতই পবিত্র'। 

একটি সংসারের প্রতীকে জহির রায়হান এই ছবিতে দেশ, স্বৈরতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ হাজির করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদা আকতারের একটি নিবন্ধের শিরোনাম থেকেও উপরোক্ত বক্তব্যের প্রমাণ মেলে। শিরোনাম এমন- 'জীবন থেকে নেয়া: স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চলচ্চিত্রিক রূপায়ন'। 

তবে চলচ্চিত্র বিশ্লেষক মো. রবিউল ইসলাম ছবিটি বুঝতে চেয়েছেন আরো গভীরভাবে। তিনি এজন্য ফার্দিনান্দ দ্য সস্যুর বা ডানিয়েল শ্যান্ডলারের উপনিবেশোত্তর চলচ্চিত্র তত্ত্বের সহায়তা নিয়েছেন। চাবির রিংকে তিনি ছবিটির অন্যতম প্রধান প্রতীক বা সিম্বল মানছেন। ঘটক যেমন ছবিতে বলেন, ওই স্বৈরাচারীর (রওশন জামিল) ক্ষমতার উৎস হলো- চাবির রিং। তাতে রওশনের স্বামী উপলব্ধি করেন, চাবিগুলো যদি হস্তান্তর করা যায় তবে স্বৈরাচারের গদি টলে যাবে। আরো অনেক প্রতীক আছে ছবিতে, যেমন বিষমেশানো পানির গ্লাস চক্রান্তের প্রতীক, ধাতব থালা-বাটির ঝনঝনানি প্রকাশ করে অস্থিরতা, ডাঙার কই মাছ বলে স্বৈরাচারের নিয়ন্ত্রণে দুঃসহ জীবনের কথা। তারপর নতুন শিশুর নাম মুক্তি রাখা হলে বোঝা যায় হতাশ মানুষগুলোর মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। জীবন থেকে নেয়ার সব প্রতীকই কোনো উদ্দেশ্যকে ব্যক্ত করে। এই ছবিটির ঘরে-বাইরে সর্বত্রই সংগ্রাম। 

ঘরে নারীরা স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্তি পেতে লড়াই করে, বাইরে ছাত্র, ছাত্রনেতারাও লড়াই করে গণতন্ত্র ফিরে পেতে। মোদ্দা কথা গণআন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, রাজনীতি, পুলিশি নির্যাতন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, একনায়কতন্ত্র বা সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ইত্যাদি ঘটনা ও প্রসঙ্গ নিয়ে এ ছবি। জীবন থেকে নেয়ার আগে মানে ১৯৬৫ সালে জহির রায়হান ২১ ফেব্রুয়ারি নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দেন। তাঁরই কাহিনি অবলম্বনে চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর চিত্রনাট্যও তৈরি করেছিলেন। সেটি এফডিসিতে জমা দেওয়ার পরই পুরোটা ভেস্তে দেয় পাকিস্তান সরকার। ধারণা করা হয়, এফডিসি থেকেই উধাও করে দেওয়া হয়েছিল ওই চিত্রনাট্য। উল্লেখ্য জীবন থেকে নেয়ায় রাজ্জাক, সুচন্দা, রোজী সামাদ, খান আতা, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ অভিনয় করেন। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো এবং এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে'র মতো গানও ব্যবহৃত হয়েছে এ চলচ্চিত্রে। সময়ের প্রেক্ষিতে যথেষ্টই সাহসী ব্যাপার বলতে হয়।

এরকম একটি ভালো ছবির নজির থাকার পরও কেন গত পঞ্চাশ বছরে ভাষা আন্দোলনভিত্তিক ছবি বেশি হলো না? ফাগুন হাওয়া'র নির্মাতা তৌকীর আহমেদ মনে করেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হলে বেশি বাজেট প্রয়োজন। সেকারণে হয়তো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে না। (সূত্র: ডেইলি জাগরণ ডটকম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১)

আবার 'ওরা ১১ জন' চলচ্চিত্রের প্রযোজক মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা) ডেইলি জাগরণ ডটকমকে বলেছেন, 'ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে তো প্রতিবন্ধকতা নেই। একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষার প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যায়। যখন মাসটা শেষ হয়ে যায়, তখন আমাদের ভালোবাসা উড়ে যায়। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে বইও বেশি লেখা হয়নি। তাহলে চলচ্চিত্র নির্মাণ বেশি হবে, আশা করা যায় না। আসলে আমাদের সদিচ্ছারই অভাব'।

চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সাবেক সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার একুশ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ না হওয়ার কারণ হিসেবে সরকারি উদ্যোগের অভাবকেই মুখ্য করে দেখেছেন। বলেছেন, 'এ ধরনের ঐতিহাসিক গল্পকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এজন্য বিস্তর গবেষণা দরকার। প্রচুর অর্থলগ্নির ব্যাপারও আছে। মূলত এসব কারণেই ভাষা নিয়ে ছবি হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ জরুরী'।

এই সেদিনই বলা যায়:

২০০৬ সাল মানে দেশ স্বাধীন হওয়ার ৩৫ বছর পর শহীদুল আলম খোকন বাঙলা নামের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ আহমদ ছফার ওঙ্কার উপন্যাস অবলম্বন করে ছবিটি নির্মিত হয়। এর প্রধান চরিত্র এক বোবা নারী। তাঁকে কেবল ভাষার মিছিলই চঞ্চল ও কৌতূহলী করে তোলে। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান' এক সময় ওই নারীকে স্পষ্টভাবে বাঙলা শব্দটি উচ্চারণ করায়। আর তারপরই তাঁর মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে, সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। অসাধারণ এই কাহিনীর চলচ্চিত্রায়নে পরিচালক কি ততোটা মননশীলতার পরিচয় দিতে পেরেছেন?- প্রশ্ন তুলেছেন বোদ্ধারা। ছবিটি দর্শকের কাছে পৌছায়ওনি ব্যাপকভাবে।

তারপর এই ২০১৯ সালে নির্মিত হলো 'ফাগুন হাওয়ায়'। তৌকীর আহমেদ নির্মাণ করেছেন। ছবিটাতে তৌকীর আহমেদ গণ্ডি ভাঙার সাহস দেখিয়েছেন, জানাচ্ছে ইরাবতী ডটকম। খুলনার পটভূমিতে ছবির পাত্র-পাত্রীরা কেউ কেউকেটা নন, বরং সাধারণ মানুষ। তারা বাউল, মেথর, ডাক্তার, মিষ্টি বিক্রেতা বা নাট্যকর্মী। ছবিটা জানিয়েছে, ভাষা আন্দোলন আপামর জনসাধারণের আন্দোলন। গল্পের শুরুতে তাই ময়না পাখিকে মানুষের ভাষা শেখানোর প্রতি নাসির চরিত্রের বক্রোক্তি আসলে একটি প্রস্তাবনা। ৪৪তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ তিনটি বিভাগে পুরস্কার পায়।  তবে এই ছবিটাও খুব বেশি লোকের কাছে পৌছাতে পেরেছে বলে মনে হয় না।

প্রামাণ্যচিত্র:

প্রামাণ্যচিত্রও কিন্তু খুব বেশি হয়নি। সন্ধান পাচ্ছি রফিক উদ্দিনের 'হৃদয়ে একুশ', শবনম ফেরদৌসীর 'ভাষা জয়িতা' আর রোকেয়া প্রাচীর 'বায়ান্নর মিছিল'- এর।

শবনম তাঁর ভাষা জয়িতায় ৪৮ থেকে ৫২ পর্যন্ত পুরো নয় বছরের ইতিহাস বলার চেষ্টা করেছেন। আর ফাঁকে ফাঁকে ভাষা আন্দোলনে নারীর অবদান বুঝতে চেয়েছেন। তিনি শুটিং শুরু করেছিলেন ২০০৭ সালে। যারা জীবিত ছিলেন না- শবনম তাদের পরিবারের কাছে গিয়েছেন এবং স্থিরচিত্র সংগ্রহ করেছেন। বায়ান্নর আন্দোলনে ছিলেন এমন নারীদের মধ্যে ছয়জনকে জীবিত পেয়েছেন শবনম। তারা হলেন: টাঙ্গাইলের সোফিয়া খান, বরিশালের রানী ভট্টাচার্য, ঢাকার রওশন আরা বাচ্চু, হালিমা খাতুন, সুফিয়া আহমেদ। তবে দেশের বাইরে যারা ছিলেন- তাদের কাছে শবনম পৌঁছাতে পারেননি। তাদের খুঁজতে গিয়ে, প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছিল শবনমকে। ছবিটি করার সময়ই টাঙ্গাইলের প্রতিভা মুৎসুদ্দি মারা যান (ফেব্রুয়ারি ২০০৮)। শবনম বলছিলেন, 'আমি দেখলাম একজন নারী ভাষা সৈনিক কতটা অবহেলায় মারা গেলেন। লোকে জানেই না তিনি একজন ভাষা সংগামী।'

কী হবে তাহলে?

তাহলে এখন উপায় কী? এমন একটা সংগ্রামের কথা কি চলচ্চিত্রে অধরাই থেকে যাবে? করোনার আগেও এফডিসিতে কিছু সিনেমা তৈরি হতো, এখন তো কেবল শিল্পী নির্বাচন হয়, ঝগড়া হয়, ফ্যাসাদ হয় কিন্তু ছবি কই? তার ওপর একুশের ছবি!

আমরা স্কুলে কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা (আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতা) অনেকবার পড়েছি। আমাদের ক্লাসের সুব্রত দে'র আবৃত্তিও সহপাঠীরা অনেক মনে করে। ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমাদের পুকুরের ধারের চিলতে জমিতে মোহাম্মদ হোসেন ভাইরা গাঁদা ফুলের গাছ লাগাতেন। রাত জেগে পাহারা দিতেন যেন কেউ চুরি করতে না পারে। বিশ ফেব্রুয়ারি রাতটা আমরা সারারাত জাগতাম। বড়রা গিয়ে স্কুলের শহীদ মিনার ধোয়ামোছা করতেন। আরেকটু বড়রা রাস্তায় আল্পনা আঁকতেন। খালারা ফুলের তোড়া বানাতেন বা মালা গাঁথতেন। সকালে প্রভাতফেরী। আব্দুল্লাপুর থেকে পানাম গিয়ে মিরকাদিম হয়ে প্রায় ৫ কিলোমিটার রাস্তা হাঁটতাম।

টেলিভিশনই বুঝি এখন শেষ সম্বল। তারাই যা প্রভাত ফেরি ফি বছর ধরে রাখে। ধরে রাখে শহীদ মিনার। কিন্তু শুধুই নিউজ ক্লিপ কি সংবেদনশীলতা তৈরি করতে পারে বা অনুভূতি যোগান দিতে পারে? যেমনটা পারে চলচ্চিত্র বা বই। আসুন না আমরা বছরে অন্তত দুটি ছবি বানাই ভাষা নিয়ে, আন্দোলন নিয়ে, ভাষা শহীদদের নিয়ে। জানেন তো- সে সময় মানে ওই পঞ্চাশের দশকে সন্তানের বাংলা নাম রাখা নিয়ে নতুন আর পুরোনো প্রজন্ম সংঘাতে জড়াত। রিজিয়া রহমানের 'নদী নিরবধি'তে তার নজির আছে। কত না আবেগ আর লড়াইয়ে গাঁথা একুশে মালা। ভুললে তো নিজেকেই হারিয়ে ফেলব।      


  • লেখক: গণমাধ্যম কর্মী

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.