দিবস মাফিক ভালবাসা 

মতামত

মানস চৌধুরী
14 February, 2022, 01:45 pm
Last modified: 14 February, 2022, 04:02 pm
আমাদের এই অঞ্চলটাতে ভ্যালেন্টাইনস বা ভালবাসা দিবস যে বসন্তকালের আশপাশে এসে ঠেকেছে, সেটা বোধহয় কাকতাল হবে। পৃথিবীর সব প্রান্তেই বসন্ত বলে একটা ঋতু আসে ধরে নিলেও সেটা এই দিবসের আশপাশে থাকে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের নগরাঞ্চলে ফাল্গুনের প্রথম দিন আর ভালবাসা দিবস মিলেমিশে একটা কৌতূহলোদ্দীপক ফিউশন তৈরি করেছে।
মানস চৌধুরী; অলংকরণ-টিবিএস

বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে তথাকথিত ভালবাসা দিবসের আমদানিকারক হিসাবে যায়যায়দিন পত্রিকা এবং এর কর্ণধার শফিক রেহমানের প্রসঙ্গ এখন আর নতুন কিছু নয়। বা, বলতে চাচ্ছি, এর চর্চা বেশ কিছুদিন হয়েছে। তিনি এই আমদানির কাণ্ডারি হিসাবে যতটা জননন্দিত হয়ে থাকেন, তার থেকে কম মাত্রায় হলেও, নিন্দিতও হয়ে থাকেন বটেন। এই বিষয়ক নিন্দাগুলো মোটামুটি দুইটা ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে আছেন 'মূল্যবোধ' পন্থীবৃন্দ। এটা অনেক বড় দল। দ্বিতীয় ভাগে আছেন 'বেসামরিক' পন্থীবৃন্দ। প্রথম ভাগকে 'মূল্যবোধ'-এর পাশাপাশি 'ঐতিহ্য' পন্থীও বলা চলে। এদের নিন্দামন্দ হলো এই যে শফিক সাহেব ও তার প্রতিষ্ঠান বিদেশি জীবনাচরণকে বাংলাদেশে বাজারজাত করার চেষ্টা করেছেন। এটা একটা নাহক নিন্দা। হেন কোনো বড় কোম্পানি নাই যে এটা করছে না। তাছাড়া পাশ্চাত্যীয় জীবনাচরণ বাজারজাত করার জন্য কি আর রেহমান সাহেব পর্যন্ত কেউ অপেক্ষা করে আছেন? রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানই তো প্রায় নকল করা – বিচারালয়, সংসদ, পুলিশি ব্যবস্থা। এসব নিয়ে পণ্ডিতদের অনেকেই কথা বলেছেন এবং অনেক বছর ধরে।

দ্বিতীয়ভাগের মূল অভিযোগ হচ্ছে, তিনি এসব করার মধ্য দিয়ে ১৪ই এপ্রিলে মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় হামলা ও হত্যাকে জনস্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছেন। অনেকেরই মনে আছে যে ১৯৮২ সালে এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী আন্দোলনে ট্রাকচাপা দিয়ে মারা হয়েছিল। এই বিচারবোধটার অনেক মেরিট আছে। আবার সারল্যও আছে। ভুলিয়ে ভালিয়ে দেবার নানাবিধ পলিসিতে কি লোকে অত সহজে ভোলেন? আবার মনে-রাখানোর সকল প্রচেষ্টা সমেতও কি লোকে বিগড়ে যান না? তাছাড়া শফিক রেহমানের বা যায়যায়দিন পত্রিকার সামরিক শাসনের সাথে সম্পর্ক অতটা সরল নয় যতটা অনেকে দেখতে পছন্দ করেন। বরং, তার উপন্যাস গুরুতর সব সংকেতও দিয়েছে যেগুলো শাসনপ্রণালীর সাথে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। সে সম্পূর্ণ আরেক আলাপ। আমি যে জিনিসটা বলতে চাইছি, তাতে অনেকেরই অশান্তি হবে। মূল্যবোধপন্থীদের দুইটা গুরুতর দল আছে যারা পরিশেষে প্রায় একই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের যাত্রী। একপক্ষ অবশ্যই ইসলামপন্থীপক্ষ। আরেকপক্ষ নিজেদের সেক্যুলার বলতে পছন্দ করেন এমন পক্ষ। তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে, দেশে ভালবাসা দিবসের আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ধর্মে আঘাত হানার অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি আছে ঐতিহ্যকে আঘাত হানার অভিযোগ। এখন, ঝামেলা হচ্ছে, ধর্ম আর ঐতিহ্য এক বিষয় নয়। দুই পক্ষ নিজেদের একপক্ষও ভাবতে রাজি হবেন না। আবার মূল্যবোধের পতাকা উড়াতে দুই পক্ষই সমান পারঙ্গম। পুরাই একটা গোলকধাঁধার অবস্থা; অবশ্যই যদি আপনি এ নিয়ে ভাবতে বসেন। 

আমি ভাবি না। বাস্তবে দিবস বিষয়ক কোনো উত্তেজনাই আমার আর অবশিষ্ট নাই। কোনো দিবস নিয়েই। যা ও যতটুকু ছিল তা নাবালক ও বালক বয়সেই অতিক্রান্ত হয়েছে। সর্বশেষ যেসব দিবসে আমার আবেগাপ্লুত অতিবাহন লক্ষ্য করা গেছে সেগুলো সবই রাষ্ট্রীয় দিবস। বলাই বাহুল্য। কেবল তাই নয়, কোনো কোনো দিবসের আগের রাতটাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারতাম না। কখন সকাল হবে এই ভেবেই হোক, আর মধ্যরাতের বেলাতেই হারমোনিয়াম গলায় নিতে বড়রা, ও ন্যায্য দাবিদারেরা, অনুমোদন করবেন কিনা সেই দুশ্চিন্তাতেই হোক। দুয়েকবার অনুনয়-বিনয় করে আমিও প্রভাতফেরির হারমোনিয়ামখানা গলায় পেয়েছিলাম বলেই মনে পড়ে। সেসব সুদূর অতীতের ঘটনা। উচ্চ-মাধ্যমিক পড়ি বলেই মনে পড়ে। আমার সর্বশেষ যেসব দিবস নিয়ে অতিশয় বিরক্তি কাজ করেছে সেগুলোর সবগুলো উল্লেখ করা ঠিক হবে না। তবে টেলিকম্যুনিকেশন কোম্পানি যে দিবসে লক্ষ লোককে মাঠে জড়ো করার জন্য বাদ্যবাজনা বাজিয়ে বিজ্ঞাপন করছিলেন, সেই দিবসটার উল্লেখ করাই যায়। তবে ভালবাসা দিবস কোনো বয়সেই আমার অনুরাগ অর্জন করতে পারেনি। ভালবাসা দিবস শুনলেই আমার ব্রাত্য রাইসুর 'হালুম হুলুম ভালুমবাসা' কবিতাটার নাম মনে পড়ে। বাস্তবে কোনো সম্পর্ক নাই। কিন্তু মনে হয়, হালুম-হুলুম করে একটা দিবসে ভালবাসা চাওয়া (বা দেখানো) হচ্ছে।

আমাদের এই অঞ্চলটাতে ভ্যালেন্টাইন বা ভালবাসা দিবস যে বসন্তকালের আশপাশে এসে ঠেকেছে, সেটা বোধহয় কাকতাল হবে। পৃথিবীর সব প্রান্তেই বসন্ত বলে একটা ঋতু আসে (বা আছে) ধরে নিলেও সেটা এই দিবসের আশপাশে থাকে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের নগরাঞ্চলে ফাল্গুনের প্রথম দিন আর ভালবাসা দিবস মিলেমিশে একটা কৌতূহলোদ্দীপক ফিউশন তৈরি করেছে। এর সাথে বাসন্তী রঙ, চারুকলার জাগরূক শিক্ষার্থীবৃন্দ, রবীন্দ্রনাথ, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, আইসক্রিম, বাদাম মিলেমিশে একটা মারাত্মক নিউক্লিয়াস তৈরি করেছে যা আমাদের জীবদ্দশায় ফিকে হবার সম্ভাবনা দেখি না, যদিও বেশিকাল আগে এর উৎপত্তি হয়নি। অবশ্য এভাবে ভাবা যায় যে, বেশিকাল আগে উৎপত্তি হয়নি বলেই এর বিলোপের জন্য কিছুকাল দেয়া সাধারণ কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। তবে আমাকে এর বিলোপের জন্য মরিয়া ভাবা অন্যায় হবে। আসে যায় না কিছু। অনেকেই এমন ভাবেন যেন বা বৈশাখের শোভাযাত্রাটাও সম্রাট আকবরের আমল থেকেই চলে আসছে। মাত্র বছর ৩০-৩৫ আগের এই আয়োজনটা নিয়ে তাদের ওই জানাতে সম্রাট আকবার বা বৈশাখের হাওয়াই মিঠাইওয়ালা কিংবা প্ল্যাস্টিকের চেয়ার বিক্রেতা, এমনকি চারুকলার দারুণ শিল্পী, কারোরই তো কিছু আসে যায় না!

ভালবাসা দিবস প্রসঙ্গ আসলেই মোটামুটি হেটারোসেক্সুয়াল একটা দৃশ্য ভেসে আসে – একজন নারী একজন পুরুষ পরস্পরের সাথে আছেন, হাসছেন, হাঁটছেন। শহরে যে দৃশ্য বাস্তবে দেখা যায় তাও মোটামুটি এরকম। প্রায় বিয়া-বিয়া ধরনেরই দৃশ্য। যেসব রাষ্ট্রসমাজে সমলিঙ্গীয় সম্পর্ক অধিক গৃহীত, সেখানে এর থেকে কিছুটা শিথিল দৃশ্য দেখা দিতে পারে। মনোজগতের কল্পনাও, আন্দাজ করা যায়, সেখানে ভিন্ন। কিন্তু তাতেও জুটিভিত্তিক অনুভূতি-মডেল ছাড়া আর কিছু নাই। এই জুটিভিত্তিক অনুভূতি নিয়ে আসলে কড়া আলাপ হওয়া দরকার। অনেকেই প্রস্তাব করেন যে বাংলায় 'প্রেম' হলো জুটিভিত্তিক/রোমান্সীয়; আর 'ভালবাসা' হচ্ছে উন্মুক্ত বা সর্বজনপ্রয়োগযোগ্য। কেউ কেউ আরো একটু খোলাসা করেন এভাবে যে 'প্রেম' হলো সকাম আর 'ভালবাসা' নিষ্কাম। তবে এতে নিষ্কামপন্থী প্রেমিকেরা মনঃক্ষুণ্ণ হন। এসব কোনো বিভাজনেই আমার মাথা খুব একটা সায় দেয় না। অভিধান খুলে প্রেম আর ভালবাসাকে খুব একটা আলাদা করবেন কীভাবে! আচ্ছা, ধরে নিলাম, তা করছেন না, আপনি ব্যাঞ্জনাতে মনোযোগ দিচ্ছেন। তো এই তালিকাটা তো তালগোল ছাড়া কোনো উপায় দেবে না – প্রেম, ভালবাসা, অনুরাগ, আকর্ষণ, নৈকট্য, লিপ্সা, কামনা, প্রণয়, পিরিতি, মমতা, মায়া, বাৎসল্য, স্নেহ...। দুইটা না হয় টান দিয়ে ছাড়ালেন। এতগুলোর কী করবেন!

কোনো অনুভূতিতে যৌনতার বসবাস আছে কিংবা নাই তা এত সহজে মীমাংস্য নয়। কোনো সম্পর্কে অধিকারের দাবিনামার উপস্থিতি আছে কিংবা নাই তা আইনি বোঝাপড়ার বিষয় নয়। আবার সকালে যা অযৌন বোধ হয়েছিল তা সন্ধ্যায় না বোধ হতে পারে; এক ব্যাখ্যাকারী যাকে অযৌন ঘোষণা দিয়েছেন, আরেক ব্যাখ্যাকারী তা না দিতে পারেন। এমনকি আপনার অযৌন ঘোষণাটিও গ্রহীতাপক্ষে সমর্থিত না হতে পারে। বা উল্টোটা। ঠিক একই পরিস্থিতি ঘটতে পারে অধিকার বা অধিকারের দাবিনামার বিষয়েও। ফলে শব্দ মেপে তাতে অর্থ ভরে দিতে চাইলে এই দুই শব্দের পার্থক্য সহজ থাকবে না – প্রেম ও ভালবাসা। এই কুস্তিতে স্বস্তি নাই আমার। কিন্তু কারো যদি কোনো শব্দকে নির্দিষ্ট সময়ে অধিক আরামদায়ক লাগে তো লাগুক তার।

ভালবাসার একটা মানে হতে পারত, এখনো পারে, দখলদারিত্বের অবসান ঘোষণা। মালিকানার বিলোপ ঘোষণা কিংবা ক্রূর লড়াইয়ের সমাপ্তি। পাল্লাপাল্লির পর সমঝোতার আরাম। এটা ম্যাক্রো পর্যায়ে প্রায় হাস্যকরই লাগবে শুনতে। অন্তত বিরাট মালিকদের তো লাগবেই। কিন্তু মাইক্রো পর্যায়ে এটা নিয়ে হাস্যরস করার সুযোগ সামান্য। ধরুন, দুই বা ততোধিকজন, পরিবারে বা তার বাইরে, বন্ধুত্বে (এমনকি শত্রুত্বে) পরস্পরের দখলদারিত্ব আর পাল্লাপাল্লি থেকে পরস্পরকে মুক্ত করে দিচ্ছেন সকলে। সেটা মনে হয় না যে একটা দিবসের মধ্যে সম্ভব; আর একটা দিবসেই সীমিত রেখে লাভ আছে।
              

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.