নির্বাচন কমিশন আইন কি জাতির প্রত্যাশা পূরণ করল?

মতামত

30 January, 2022, 05:30 pm
Last modified: 30 January, 2022, 05:30 pm
গত ৫০ বছরে যে আইন অন্য কেউ করেনি, সেই আইন বর্তমান ক্ষমতাসীনরা করল—এটাকে তারা তাদের সফলতা হিসেবে দেখছে। বিলটি পাসের সময় কোনো দলের পক্ষ থেকে ওয়াকআউটের কোনো ঘটনা ঘটেনি, বরং কণ্ঠভোটে সর্বসম্মতিতে বিলটি পাস হয়। বিলটি পাসের পর সংসদের ভেতরে ও বাইরে সরকার দলের পক্ষ থেকে ভূয়সী প্রশংসা করা হচ্ছে বিল পাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে। সংসদনেতা বিল পাসের প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক ঐকমত্য হিসেবে দেখছেন। তিনি সমাপনী ভাষণে বিরোধীদের ২২টি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করার প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, বিলটি এখন আর সরকারদলীয় বিল থাকল না, এটা এখন বিরোধীদলীয় বিলে পরিণত হলো। সংসদে এই বিল পাসের মধ্য দিয়ে সত্যি কি রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হলো? বিবাদগুলোর মীমাংসা হলো?

২৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে পাস হওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল, ২০২২-এ রাষ্ট্রপতি গতকাল সম্মতি দিয়েছেন। সংসদের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক আলোচিত বিলটি আইনে পরিণত হলো। বহুদিন ধরেই নির্বাচন কমিশন নিয়োগসহ একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ। সংবিধানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ৫০ বছর এটি উপেক্ষিত থেকেছে। এবার জোরালোভাবে দাবিটি সামনে আসে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ চলার সময়। নতুন কোনো আইন তৈরির ব্যাপারে তখন সরকার রাজি না হলেও অনেকটা আকস্মিকভাবে সরকার উদ্যোগ নেয় এবং বর্তমান কমিশনের মেয়াদ পূর্তির ১৫ দিন আগে আইন তৈরি হলো এবং নতুন এই আইনের আলোকেই পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পাবেন।

গত ৫০ বছরে যে আইন অন্য কেউ করেনি, সেই আইন বর্তমান ক্ষমতাসীনরা করল—এটাকে তারা তাদের সফলতা হিসেবে দেখছে। বিলটি সংসদে উত্থাপনের পর প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের সংসদ সদস্যরা আলোচনায় অংশ নেন এবং বিলটির ৭৬টি সংশোধনী প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে অনেকগুলো 'কমন' প্রস্তাব ছিল। সরকারপক্ষ বিরোধীদের ২২টি প্রস্তাব গ্রহণ করে বিলটি পাস করা হয়। বিলটি পাসের সময় কোনো দলের পক্ষ থেকে ওয়াকআউটের কোনো ঘটনা ঘটেনি, বরং কণ্ঠভোটে সর্বসম্মতিতে বিলটি পাস হয়। বিলটি পাসের পর সংসদের ভেতরে ও বাইরে সরকার দলের পক্ষ থেকে ভূয়সী প্রশংসা করা হচ্ছে বিল পাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে। সংসদনেতা বিল পাসের প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক ঐকমত্য হিসেবে দেখছেন। তিনি সমাপনী ভাষণে বিরোধীদের ২২টি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করার প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, বিলটি এখন আর সরকারদলীয় বিল থাকল না, এটা এখন বিরোধীদলীয় বিলে পরিণত হলো। সংসদে এই বিল পাসের মধ্য দিয়ে সত্যি কি রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হলো? বিবাদগুলোর মীমাংসা হলো? উত্তরগুলো খুঁজতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের অবশ্যই সফলতা আছে; সেটা কি আইন করা মধ্যে নাকি অন্যকিছুতে? আমরা সেখানে মনোনিবেশ করতে চাই।

রাষ্ট্রপতির সংলাপ উদ্যোগের সময় হতে ক্ষমতাসীনরা সফলভাবেই প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে, বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নির্বাচন কমিশন আইন না থাকা। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের কারচুপি ও সংঘাত নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা হিসেবে সামনে আসে এবং একটি 'উপযুক্ত' নির্বাচন কমিশনের ধারণাকে সামনে আনা হয়। ফলে সব রাজনৈতিক দল ও আগে থেকে সোচ্চার সুশীল সমাজ সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ সামনে এনে একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের ধারণাটি জোরালো হতে থাকে। প্রথমে সরকার রাজি না থাকলেও রাজনৈতিক এই প্রেক্ষিত কাজে লাগাতে সরকার বিলম্ব করেনি। ফলে খুব দ্রুততার সাথে মন্ত্রীসভার অনুমোদন, সংসদে বিল উত্থাপন, বিপুলসংখ্যক বিরোধী সংশোধনী গ্রহণ, বিল পাস ও রাষ্ট্রপতির সম্মতি—এর প্রতিটি স্তরে সরকার জয়লাভ করেছে।

এরশাদ পতনের পর বিচারপতি রউফ কমিশনের নেতৃত্বে ১৯৯১-এর নির্বাচন অন্যতম সফল ও প্রশংসিত নির্বাচন। তখন সরকারে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। সেই একই কমিশন ১৯৯৪ সালে মাগুরায় উপনির্বাচন করে, তখন সরকারে বিএনপি। এই ঘটনা প্রমাণ করে, রাজনৈতিক ইচ্ছা ও ঐকমত্য নির্বাচন কমিশনের মতো সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের চালিকাশক্তি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আন্দোলনরত সকল দল ও জোটের কয়েকটি প্রশ্নে সমঝোতা তৈরি হয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম হলো সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান জারি রাখা, জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তাছাড়াও নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাতপূর্ণ অবস্থান পরিহার করে সবক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বিরোধ মীমংসার ব্যাপারে দলিলে স্বাক্ষর করেছিল রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতারা।

ঐতিহাসিক এই সমঝোতা ভাঙতে ও পারস্পরিক অবিশ্বাস তৈরি হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বিএনপি নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের পর বিএনপি সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিতে কালক্ষেপণ করতে থাকে। তিন জোটের অঙ্গীকার অনুযায়ী সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনে সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েই রেখেছিল। কিন্তু বিএনপির মুখে তখন অন্য সুর। বিএনপির অনেক নেতা তখন বেগম খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে চান। তাছাড়া বিএনপির গঠনতন্ত্রে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের কথা বলা রয়েছে। অনেক টানাপড়েনের পর অবশেষে ১৯৯২ সালের জুলাইতে সংবিধান সংশোধনের বিল সংসদে উত্থাপিত হয়। দেশ সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে এলেও ইতোমধ্যে যে রাজনৈতিক অবিশ্বাস ও বৈরীতা তৈরি হলো, তা থেকে আমরা আর মুক্ত হতে পারিনি।

এরশাদের পতনের পর দেশে ছয়টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনগুলোর মধ্যে শেষের দুটি বাদ দিলে অন্য নির্বাচন নিয়ে তেমন বিতর্ক দেখা যায় না। (যদিও '৯৬-এর নির্বাচনও আরেকটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছিল) অনেক বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন। এই দুই নির্বাচনের কমিশন গঠিত হয়েছে সার্চ কমিটির মাধ্যমে। সেই অনেকটা একই ধরনের সার্চ কমিটির বিধানই রাখা হয়েছে নতুন আইনে। ফলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের শর্ত কেবল নির্বাচন কমিশন গঠন নয়, বরং অনেক বেশি জরুরি রাজনৈতিক সমঝোতা। বর্তমান রাজনৈতিক বিরোধগুলোকেও পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

নতুন আইনটি নিয়ে ক্ষমতাসীনরা যতটা উচ্ছ্বসিত, তেমনটি আর কেউ নয়। আইনটি নিয়ে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। একপক্ষ খুব জোর দিয়ে বলছেন, এত কিছুর দরকার নেই, নির্বাচনের সময় পদত্যাগ করে নির্বাচনকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা দিতে হবে এবং সেই সরকারই নির্বাচন করবে। গত দুই নির্বাচনের আগ থেকে (২০১৪ এবং ২০১৮) এই একই দাবির কথা আমরা শুনে আসছি। এই দাবি যে সংঘাতের জন্ম দিয়েছে তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ওই সময়ে। এর বিপরীত ধারণাও রয়েছে। অনেকে শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলেন, যার মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করেন। তারা মনে করেন, আরও একটু সময় নিয়ে 'নিয়োগ' আইন নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন কমিশন আইন করা যেতে পারত।

সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নতুন আইনটি তৈরি হলো, কিন্তু এই একই অনুচ্ছেদের ৪ উপঅনুচ্ছেদে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নে 'সংবিধান ও আইনের বিধানের অধীন হইবে' বলা হয়েছে। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার জন্যও আইনের বিধান থাকতে হবে। সে আইন করা হয়নি। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যদি 'স্বাধীন' নির্বাচন কমিশন শর্ত হয়ে থাকে, তাহলে সেই শর্ত পুরণ করা হলো না।

সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।' নির্বাহী বিভাগের প্রতি সংবিধানের এই নিদের্শনার কোনো ব্যত্যয় ঘটলে শাস্তিমূলক কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তার কোনো উল্লেখ নেই। এখানেই নির্বাচন কমিশনের শক্তিশালী হওয়ার প্রশ্নটি জড়িত। ভারতে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের কোনো আইন নেই। তারপরও তাদের সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগের এই সহায়তার প্রশ্নটি সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত করেছে। সেখানে নির্বাহী বিভাগের যেকোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটালে তার মাশুল চাকরিজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গুনতে হয়। সে কারণে ভারতের রাজনীতি বহুধাবিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার নির্বাচন নিয়ে তেমন বিতর্ক সৃষ্টি হয় না।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক দাবির মালিকানার বদল ঘটে। ক্ষমতার পরিবর্তনের সাথে এই মালিকানার বদল হয়। এই পরিবর্তন ক্রমান্নয়ে সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির জন্ম দেয়। জনজীবনে নিয়ে আসে অন্ধকার। 'আমরা অনেক কিছু দিলাম' এরকম অহংবোধ থেকে বের হয়ে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক করার কোন বিকল্প নেই।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.