অর্জন ফিকে হয়ে যায়, যখন আমি আর আমার সন্তান নিরাপত্তাহীন থাকি

মতামত

21 January, 2022, 01:55 pm
Last modified: 21 January, 2022, 02:01 pm
অনেকেই প্রশ্ন করেন, অব্যাহত প্রতিবাদ ও মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকার পরেও কেন দেশে ধর্ষণের হার বাড়ছে? কেন আমাদের ক্ষোভ, ভয়, ঘৃণা প্রকাশ চর্বিতচর্বণের মতো হয়ে গেছে?

অভিনেত্রীকে হত্যার পর তার ১০ টুকরা লাশ নিয়ে সারা ঢাকা শহর ঘুরে বেরিয়েছে স্বামী, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষিকাকে মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্য খুন করে গর্তে ফেলে রাখা হয়েছে, সিলেটের শাবিপ্রবি'র উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি জঘন্য ধরণের 'কটুক্তি' করেছে। এর আগে স্বামী-সন্তানসহ কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন গৃহবধু এবং নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় চলন্ত বাসে উচ্চ শব্দে গান বাজিয়েদলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন আরেক গৃহবধূ।

এসবই গত ৩০ দিনের খবর। বাংলাদেশে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া নারীর প্রতি সহিংসতার অসংখ্য ঘটনার কিছু বিচ্ছিন্ন চিত্র এই ঘটনাগুলো। বারবার বলা হচ্ছে নারী নিরাপদ নয় তার গৃহে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাঙ্গনে, গণপরিবহনে বা বেড়াতে গিয়ে। অথচ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনরকম ইতিবাচক উদ্যোগ চোখেই পড়ছে না।

আইন আছে এবং চলছে নিজ গতিতে। অথচ ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন নিয়ে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়কে কখনো কোন উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখি না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেই উদ্যোগী হয়ে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কেন আমাদের এই ক্ষোভ, ভয়, ঘৃণা প্রকাশ চর্বিতচর্বণের মতো হয়ে গেছে?

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ এ  পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে ১০ শতাংশ। পারিবারিক নির্যাতনকে ঘিরে হত্যা, আত্মহত্যাসহ মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে ৭ শতাংশ। ১১ মাসে পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৬০৮টি। এর মধ্যে ৩৫৫টি হত্যার ঘটনায় ২১৩টি খুন স্বামী করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৩২টি।

নারীর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ যে আশ্রয়, তার গৃহ, সেই গৃহেই নারী নির্যাতিত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। গতবারের করোনাকালে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ জানিয়ে কল আসার সংখ্যা এক বছরে আড়াই গুণের বেশি বেড়েছে, যা ১৭৪ শতাংশ বেশি। কতটা ভয়ংকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে শুধু একটি ফোনকলের তথ্য পর্যালোচনা করে! কিন্তু এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে কোথাও কি কোন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে?

স্বামীর হতে স্ত্রীর মার খাওয়ার কারণের মধ্যে আছে --- সময়মতো রান্না না হওয়া, তরকারিতে লবণ কম বা বেশি হওয়া, কথার জবাব দেয়া, স্বামীর পরিবারের লোকদের যত্ন না করা. দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা, ভাত শক্ত বা নরম হয়ে যাওয়া, সন্দেহ, পড়াশোনা করতে চাওয়া, যৌতুক না পাওয়া, সন্তান না হওয়া, সহবাসে আপত্তি করা এবং স্ত্রীর কাছে টাকা বা স্বর্ণালংকার চেয়ে না পাওয়াসহ অসংখ্য তুচ্ছ কারণ। যারা তৃণমূল পর্যায়ে নারী ও মেয়েদের নিয়ে কাজ করছে, তারা জানে মেয়েদের কতভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয় পরিবারে।

এই চিত্র শুধু গ্রামের নয়, শহরের স্ত্রীদেরও এ ধরণের ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অধিকাংশ নারী মামলা করেন না ঝামেলা করতে চান না বলে। অনেকে ভাবেন মামলা করে লাভ হয় না, শুধু ভোগান্তি হয়। অনেকে শুধু পরামর্শ নিয়ে ফিরে যান। আর অন্যতম বড় কারণ অধিকাংশ নারী সংসার ভাঙতে চান না। আমাদের গ্রামে বা শহরে, শিক্ষিত বা নিরক্ষর অবস্থায় নারী এতটাই অসহায় ও নির্যাতিত থাকে যে, কোন পদক্ষেপ নেয়ার সময় ১০ বার চিন্তা করেন। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপই নেন না।

শুধু কি গৃহেই নারী নির্যাতিত হচ্ছে ? না তা নয়। ২০২১ এ বেসরকারি সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, 'চ্যালেঞ্জিং ফিয়ার অব ভায়োলেন্স' শিরোনামে জরিপ প্রতিবেদনে পরিবার, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং জনসমাগম স্থলে নারীর প্রতি সহিংসতার তথ্য প্রকাশ করেছে। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, কিশোরী ও তরুণীদের ওপর সংগঠিত হয়রানি-নিপীড়নের ঘটনার ৮২ শতাংশই পথঘাট, গণপরিবহন, বাস স্টপেজ, রেলস্টেশনসহ জনসমাগম স্থলে ঘটছে। তার মধ্যে মামলা হচ্ছে ৩ শতাংশেরও কম।

এই যে গণপরিবহন, সেও তো নারীর জন্য নিরাপদ নয়। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গণপরিবহনে নারী নির্যাতনের সংখ্যা বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এর মধ্যে বেশি হচ্ছে ধর্ষণের ঘটনা; দলবদ্ধ ধর্ষণও আছে। এসব তথ্য-উপাত্তই বলে দিচ্ছে গণপরিবহনে মেয়েরা কতটা নিরাপত্তাহীন।

এছাড়া আছে নিয়মিত যৌন হয়রানি। বাসে, টেম্পু বা হিউম্যান হলারে চড়ে যাতায়াত করে কিন্তু গায়ে পুরুষ হাত দেয়নি বা শরীরে পুরুষাঙ্গ ছোঁয়ানোর অভিজ্ঞতা হয়নি, এরকম ঘটনা খুব কম আছে একজন নারীর জীবনে। এসব ঘটনায় নারী এতটাই সংকুচিত হয়ে থাকে যে কারো সাথে শেয়ারও করতে লজ্জা পায়। অনেকে ভয়ও পায় পরিবারে এই নিগ্রহের কাহিনী বললে হয়তো তার কাজ করা বা পড়াশোনা বন্ধই হয়ে যাবে।

আমাদের দেশে নারী নির্যাতন বাড়ার অনেক কারণ আছে, কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে বিচারহীনতা বা বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা। ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ২৫টি ধর্ষণ মামলার বর্তমান অবস্থা, ধর্ষণ মামলা পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণগুলো তুলে ধরে বেসরকারি সংস্থা 'মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' ২০২১ সালে জরিপ করেছিল। তাতে দেখা গেছে, এই সময়ের মধ্যে দায়েরকৃত ২৫টি ধর্ষণ মামলার মধ্যে, গ্রেপ্তারের পর ২৪ ঘণ্টা হতে ১৫ দিনের মধ্যেই অভিযুক্ত ২৫ জন আসামি জামিন পেয়েছে। অধিকাংশ আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে মামলাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।

অনেকেই প্রশ্ন করেন, অব্যাহত প্রতিবাদ ও মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকার পরেও কেন দেশে ধর্ষণের হার বাড়ছে? বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, নানা ধরণের আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদিচ্ছার অভাব এইজন্য দায়ী। এমনকি ভিকটিম ও সাক্ষীকে সুরক্ষা দেয়ারও কোন আইন বাংলাদেশে নেই। এই কারণে কোন মামলা দায়েরের পর নির্যাতনের শিকার নারী ও সাক্ষীও অসহায় বোধ করেন।

২০১৭ সালে চলন্ত বাসে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার শিকার চাকরিজীবী রূপা খাতুনের ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ২০১৮ সালে টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল চার আসামির ফাঁসি ও একজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিলেও চাঞ্চল্যকর মামলাটি হাইকোর্টে এসে জটে পড়ে যায়। প্রায় চার বছরে হাইকোর্টে একবারও শুনানি হয়নি (সূত্র-প্রথম আলো)।

একটা করে নারী নির্যাতন বা নারীকে অসম্মানিত করার ঘটনা ঘটে আর আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই, কষ্ট পাই, ক্ষোভ প্রকাশ করি। কিন্তু মামলার কোন সুরাহা হচ্ছে না বা অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটছে না। বিভিন্ন পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে যে, অপরাধী অব্যাহতি পাচ্ছে বলেই অপরাধের হাত শক্তিশালী হচ্ছে, নারীর অবস্থান সমাজে অধঃস্তন বলে নারী খুব কমই বিচার পাচ্ছে, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের মতো অজামিনযোগ্য অপরাধ হলেও আসামি ঠিকই বেরিয়ে আসছে, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়, ঘুষ-দুর্নীতি এবং নারীর প্রতি বড় ধরণের অপরাধ হলেও সমাজ সেগুলোকে অপরাধ হিসেবে মনে না করে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয় যেমন যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন ইত্যাদি। আর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় উদাসীন দৃষ্টি ও নারী অধিকার সংগঠনগুলোর দুর্বলতা। এখন যা কিছু প্রতিবাদ হচ্ছে, তা সামাজিক মাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে।

দেশে অব্যাহতভাবে ধর্ষণের ঘটনা, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের সঙ্গে নিষ্ঠুরতা, যৌন হয়রানি, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর প্রতি দোষ দেয়ার প্রবণতা বা ভিকটিম ব্লেইমিং এবং সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরণের কুরুচিকর মন্তব্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হলেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোন নড়নচড়ন দেখা যায় না।

২০১৯ সালে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে স্বর্ণলতা পরিবহনে নার্স শাহিনুর আক্তারকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। ওই বছরের ২২ আগস্ট ৯ জনকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল হয়, এর মধ্যে ৬ জন গ্রেপ্তার ছিল। ঘটনার আড়াই বছরে মামলার আর কোন আপডেট নেই।

২০২১ এর নভেম্বরে মানিকগঞ্জে যাওয়ার উদ্দেশে এক কলেজছাত্রী ধামরাই থানা রোড থেকে কালামপুর এন্টারপ্রাইজের একটি বাসে ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে, ছাত্রী চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে পড়েছিল। পুলিশ চালককে একমাত্র আসামি করে মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করে। তবে চালক এখন জামিনে মুক্ত হয়েছে কি না, তা জানা নেই।

গাজি-কালু-চম্পাবতীর প্রেমকাহিনীর গল্প অনুযায়ী, জিন্দা পীর গাজি প্রেমে পড়ে ব্রাহ্মণের মেয়ে চম্পাবতীর। তাকে বিয়ে করে ভাই কালুর সাথে হেঁটে যাওয়ার সময় লোকে নানা কথা বলতে থাকে। এতে লজ্জিত হয়ে গাজি বিয়ে করা নতুন বৌ চম্পাবতীকে হাতের ধুলো ছিটিয়ে এক শেওড়া গাছে পরিণত করে এবং দুই ভাই সেখান থেকে চলে যায়।

এখনও বিষয়টা একই আছে তবে জিন্দা পীরের মত ক্ষমতা নাই তাই মেয়েদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে গাছ না বানিয়ে, কেটে টুকরো করে বস্তায় ভরে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে, অথবা ধর্ষণের পর পরিবহণ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলা দেয়া হচ্ছে, ভিকটিম ব্লেইমিং হচ্ছে অথবা পরিবারে গায়ে গরম ছ্যাঁকা দেওয়া হচ্ছে।

দেশ যতোই আধুনিক হোক বা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করুক, তাতে দেশের ৫০ ভাগ নারী জনগোষ্ঠীর সুখী হওয়ার মতো কোন কারণ দেখছি না। এত অর্জন সব কেমন যেন ফিকে হয়ে যায়, যখন আমি এবং আমার সন্তান কেউই এই সমাজে নিরাপদ থাকি না, বিচার পাই না।

  • লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.