তাদের দুর্ভোগের জন্য কেউ দায়ী নয়

মতামত

02 August, 2021, 05:05 pm
Last modified: 08 December, 2021, 07:30 pm
পুরো ঘটনা যেভাবে ঘটেছে, তাতে সরকারের প্রশাসন ও আরএমজি খাতের নীতিনির্ধারকদের প্রজ্ঞা ও দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাস্তবতার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই।

তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা মহাখুশি। কারণ তাদের কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। আর কারখানা সচল রাখার জন্য 'কর্তব্যের ডাকে' সাড়া দিয়ে কর্মস্থলে ফিরেছেন নিরুপায় শ্রমিকরা।

গত শনিবার সড়কে অকথ্য দুর্ভোগ সয়ে, লকডাউনের বিধিনিষেধ ও প্রাণঘাতী ভাইরাসকে উপেক্ষা করে কারখানায় ফিরেছেন তারা।

বাস্তবচিত্র ভয়াবহ। দেশের সব প্রান্ত থেকে গাদাগাদি করে পণ্য পরিবহনের বাহন ও অটোরিকশায় করে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে ফিরেছেন শ্রমিকরা। কর্মস্থলে ফিরতে পেরে তারাও খুশি। রোববার সকালে কাজে যোগ দিতে না পারলে চাকরি হারানোর ও বেতন কাটা যাওয়ার আশঙ্কা ছিল তাদের।

সেই ভয় আপাতত কেটে গেছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এই অভূতপূর্ব স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও প্রাণ হারানোর আশঙ্কার চেয়ে জীবিকাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এ পরিস্থিতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, খাদ্য ও বেঁচে থাকার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সংস্থান করার জন্য এই শ্রমিকরা যে জীবিকার ওপর নির্ভরশীল, তাদের সেই জীবিকা কতটা অসুরক্ষিত ও ভঙ্গুর।

ছবি: সালাহউদ্দিন আহমেদ/টিবিএস

আমাদের সিংহভাগ কর্মীর জীবিকাই যদি এতটা ভঙ্গুর হয়, তাহলে আমাদের ব্যবসাও ঠিক ততটাই ভঙ্গুর। বড় কোনো ধাক্কা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের ব্যবসার নেই। সস্তা শ্রমের ওপর যে ব্যবসা টিকে থাকে, সেই ব্যবসা কেবল একটা কাজই দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে—শ্রমিকদের শোষণ।

প্রকৃত সত্য হলো, শ্রমিকদের জন্য আমাদের কারখানা মালিকদের ন্যূনতম সহানুভূতি কিংবা চিন্তা নেই। কিন্তু শ্রমিকরা ঠিকই মালিকদের নিয়ে ভাবেন। বিশ্বজুড়ে বড় বড় ব্যবসায়ীদের ইতিহাস ঘাঁটলে তাদের মধ্যে একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য পাবেন—শ্রমিকদের জন্য তাদের সহমর্মিতা।

কাজেই রাস্তায় লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের যাত্রার দৃশ্য দেখে কারখানা মালিকদের এই ভেবে আত্মতৃপ্তির ভোগার সুযোগ নেই যে, ব্যবসা বাড়ানো এবং টেকসই করার জন্য তাদের হাতে একটি অনুগত ও শক্তিশালী বাহিনী আছে।

এই শ্রমিকদের জীবিকা নির্বাহের অন্য কোনো উপায় নেই। কারণ অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে এই মানুষগুলোর জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার মৌলিক দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে জীবিকার উৎস রক্ষা করার জন্য এই নিরুপায় মানুষগুলো অমানবিক যাত্রায় নেমেছেন।

তাদের এই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের জন্য কারা দায়ী?

ঈদ-উল-আযহার আগে সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, ঈদ উদযাপনের জন্য এক সপ্তাহের শিথিল লকডাউনের পর, ২৩ জুলাই থেকে দুই সপ্তাহব্যাপী লকডাউনের সময় রপ্তানিমুখী আরএমজি খাতসহ সব কারখানা বন্ধ থাকবে।

শুরু থেকেই তৈরি পোশাক খাতকে কঠোর লকডাউনের আওতার বাইরে রাখার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছিলেন আরএমজি মালিকরা। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বারবার সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমনকি ২৭ জুলাই একটি বৈঠকের পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ৫ আগস্টের আগে কারখানাগুলো খোলার অনুমতি না দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের অবস্থান বদলাবে না।

সরকারের দৃঢ় ঘোষণার ওপর বিশ্বাস রেখে শ্রমিকরা তাদের ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের কর্মস্থল ছেড়ে ঈদ উদযাপনের জন্য গ্রামে চলে যান। ৫ আগস্টের পর তাদের কাজে ফেরার কথা ছিল।

কিন্তু আকস্মিকভাবে জুলাই শেষ হওয়ার আগের দিন, শুক্রবার বিকেলে সরকার ঘোষণা দেয় রপ্তানিমুখী কারখানাগুলো রোববার থেকে খোলা রাখা যাবে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে অনুযায়ী, অনেক কারখানার মালিক শ্রমিকদের মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে রোববারের মধ্যে কাজে যোগ দিতে বলেছেন।

শ্রমিকরা জানেন, এ নির্দেশ অমান্য করার পরিণতি ভালো হবে না—হয় তারা চাকরি হারাবেন, নইলে বেতন কাটা যাবে। কাজেই তারা শনিবার ভোরে পূর্ণ লকডাউনের মধ্যেও রাস্তায় নামার আগে দ্বিতীয়বার ভাবেননি। সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কর্মস্থলে পৌঁছতে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হন তারা।

পুরো ঘটনা যেভাবে ঘটেছে, তাতে সরকারের প্রশাসন ও আরএমজি খাতের নীতিনির্ধারকদের প্রজ্ঞা ও দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাস্তবতার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই।

আরএমজি মালিকদের শক্তিশালী প্রতিনিধি বিজিএমইএ'র নেতারা সরকারকে তার অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছেন। শ্রমিকদের কারখানায় ফেরত চেয়েছেন তারা—কিন্তু লকডাউনের মধ্যে শ্রমিকরা কীভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাজে যোগ দেবেন, তা নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র ভাবেননি। তারা 'অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী' যে, গণপরিবহন চলুক বা না চলুক, চাকরি বাঁচানোর জন্য শ্রমিকরা কারখানায় ফিরবেই।

ছবি: ইসরাইল হোসেন বাবু/টিবিএস

যেসব সরকারি নীতিনির্ধারকরা আরএমজি খাতকে লকডাউনের আওতা থেকে মুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারাও শ্রমিকদের কথা ভাবেননি। তাদের দুর্বল স্মৃতিশক্তি সম্ভবত ভুলে গেছে, গত বছর সাধারণ ছুটির আদলে দেওয়া শাটডাউনের সময় কারখানা বন্ধ থাকবে কি না, তা নিয়ে বিভ্রান্তির কারণে সড়কে ঠিক এ ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।

এবারও গণপরিবহনের অভাবে হাজার হাজার কারখানা শ্রমিক কর্মস্থলে ফিরতে রীতিমতো সংগ্রাম করছিলেন। পরিস্থিতির অবনতি হলে শেষতক শনিবার সন্ধ্যা থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত বাস চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে।

এই ঘটনা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করার দক্ষতার অভাবকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, তবু আরএমজি কারখানাগুলো খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক। ২৩ জুলাই থেকে দুই সপ্তাহের লকডাউন আরোপ করার পর থেকে দেশে প্রতিদিন ২০০-র বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, প্রতিদিন নতুন করে সংক্রমিত হচ্ছেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: কারখানা খোলার অনুমতি দেওয়ার সময় এসব তথ্য যদি বিবেচনায় আনা না হয়, তবে কারখানাগুলোকে আগে থেকেই কেন লকডাউনের বিধিনিষেধের আওতার বাইরে রাখা হয়নি?

ছবি: টিবিএস

শ্রমিকরা যেভাবে গাদাগাদি করে কর্মস্থলে ফিরেছেন, তাতে সামনের সপ্তাহগুলোতে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ শ্রমিকদের ভিড়ের মধ্যে ভাইরাসটি কীভাবে কতটা ছড়িয়েছে, তা কেউ জানে না। শ্রমিকদের এই যাত্রাকে মৃত্যুচুম্বন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।

কিন্তু নির্মম পরিহাস হলো—শেষ পর্যন্ত কারখানার মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষই খুশি। কারখানা বন্ধ থাকার কারণে ক্রয়াদেশ বাতিল হয়ে যেতে পারে বলে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন আরএমজি মালিকরা। এখন তাদের চাপ থেকে সরকারের নীতিনির্ধারকরাও মুক্তি পেয়েছেন।

সুতরাং, শনিবার শ্রমিকরা যে দুর্ভোগ সয়েছেন, তার জন্য কাউকেই দায়ী করা হবে না। সেই অধ্যায় এখন অতীত।


  • লেখক: উপ নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
  • মূল লেখা: When no one is responsible for your suffering
  • অনুবাদ: মারুফ হোসেন

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.