গলদটা কোথায়: একদিকে বাজারের ফর্দ ছোট হচ্ছে, অথচ বাড়ছে মাথাপিছু আয়
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/05/26/shahana_huda.jpg)
আজকাল মানুষের এমন অবস্থা হয়েছে যে, রাত-দিন মাথায় বাজারের ফর্দ, দ্রব্যমূল্য ও পরিবারে অর্থের যোগান এসবই ঘুরপাক খাচ্ছে। অসহনীয় গরমের পাশাপাশি নিত্যপণ্যের বাজারের চড়ামূল্য সাধারণ মানুষকে অস্থির ও একই সাথে অসহায় করে তুলেছে। ঠিক এরকম একটি অস্থির পরিস্থিতিতে পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে— আমাদের মাথাপিছু আয় সামান্য বেড়ে ২৭৮৪ ডলার হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ২৭৪৯ ডলার। শতাংশের হিসাবে এই বৃদ্ধি ৫.৭৮ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫.৮২।
মাথাপিছু আয়ের এই গড় হিসাব নিয়ে অনেকের ভেতর প্রশ্ন আছে। সবারই জানতে ইচ্ছা করে বাংলাদেশের ঠিক কতজন মানুষের আয় ২৭৮৪ ডলার মানে প্রায় ৩৩৪,০৮০ টাকা? অর্থনৈতিক সাফল্য নির্ধারণে জিডিপি ও প্রবৃদ্ধি হারকে সূচক হিসেবে ধরতে কারো কারো আপত্তি আছে। আমাদের মতো অনেকে বুঝতেই পারে না যে— যার বার্ষিক আয় ১০০ কোটি টাকা, যার ৬০ লাখ টাকা, যার ২৪ লাখ, যার ৩৬ হাজার এবং যার তেমন কোনো আয়ই নাই, তাদের সবার আয় গড় করে মাথাপিছু আয়ের এই হিসাবটা হয় কীভাবে? একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে মাথাপিছু আয় নির্ণয়ের এই পদ্ধতি কতটা যৌক্তিক তা এখনো বুঝতে পারিনি।
যদিও 'এই সামান্য আয় বৃদ্ধির' শানে-নযুল বোঝাও আমাদের কর্ম নয়, তবে স্পষ্টতই বুঝতে পারছি এতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের আয়ে বাড়তি কোনো বরকত আসবে না, সংসারের টানাটানিও কমবে না। কারণ বাজারে পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে বাড়ছে না আয়। টানা ২৪ মাস ধরে দেশে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। একদিকে, মাথাপিছু আয় সামান্য বাড়ছে, অন্যদিকে, মানুষের বাজারের ফর্দ দিনে দিনে ছোট হচ্ছে। এ এক অদ্ভূত হিসাব-নিকাশের রাজনীতি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মাথাপিছু আয় ও জিডিপির পরিমাণ উল্লেখ করে দায় সারে। অথচ এই অর্থ কাদের ও কতজনের ঘরকে আলোকিত করছে, সে খবর তারা দিতে পারে না। কারণ তারা এর হিসাবই করে না। প্রান্তিক মানুষের চাহিদা ও প্রাপ্তির ব্যবধান, তাদের প্রতি চরম বৈষম্য ও অবহেলা থাকে এই প্রতিবেদনে। অগণিত মানুষের জীবনের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, শান্তি ও টনাপোড়েনের কোনো হিসাব থাকে না। জিডিপি দিয়ে এগুলো নির্ণয় করা হয় না।
দেশে আয়-বৈষম্য যে কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এর উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক দুটি রিপোর্টের কথা। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে ২৪ হাজার কোটি টাকার ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। তবে, প্রকৃত লেনদেন নিবন্ধন অধিদপ্তরে রেকর্ড হওয়া পরিসংখ্যানের চাইতে তিন থেকে চারগুণ বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।
মানে গত ৯ মাসে দেশে ফ্ল্যাট কেনাবেচা হয়েছে ৭২ হাজার কোটি থেকে ৯৬ হাজার কোটি টাকার। মন্দার সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দেশের রিয়েল এস্টেট খাতে। এখানেই শেষ নয়, আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা সংস্থা স্ট্যাটিস্টা মার্কেট ইনসাইটস-এর তথ্যমতে, ২০২৪ সাল শেষে বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট বাজার ২ দশমিক ৬৮ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গ্রাহকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর হাজার হাজার নতুন অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে রাজধানীতে। এ পরিস্থিতি এমন কিছু 'গ্রে এরিয়াকে'ই বুঝায় যেখানে ব্যক্তির উপার্জনকে গোপন করার উপায় হিসেবে বিনিয়োগকে ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, চাহিদার ঊর্ধ্বগতি এবং তা টিকিয়ে রাখতে সন্দেহজনক নানান আর্থিক কূটকৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরে, যেমন— ঢাকার রিয়েল এস্টেটের উত্থান কেবল আবাসন চাহিদার কারণে নয়, বরং ব্যাপক দুর্নীতিরও প্রতিফলন। কালো টাকা সাদা করার একটি বড় সুযোগ বিলাসবহুল আবাসন ও জমি কেনা। তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়ালো যে অধিকাংশ মানুষের পক্ষে প্রতিদিনের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানো কষ্টকর হলেও, কোটি কোটি টাকার রিয়েল স্টেট ব্যবসা কিন্তু জমজমাট। (সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড)
শুধু কি দেশেই জমি-বাড়ির ব্যবসা ডালপালা মেলছে? না, এদেশে কালো টাকার মালিকের সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে, 'দুবাইয়ে বাড়ি কেনার আগে-পরে যেসব বিষয় মাথায় রাখবেন' শিরোনামে প্রথম আলো একটি স্যাটায়ারধর্মী রিপোর্ট করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে ২০২২ সালে ৫৩২ জন বাংলাদেশি বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনেছেন। দেশের মানুষ যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পেরেশান, ঠিক তখন এ রকম খবর এসেছে। দেশের কোনো কোনো মানুষ কী পরিমাণ কালো টাকার মালিক হলে দুবাইতে গিয়ে বাড়িঘর কেনেন, সুইস ব্যাংকে টাকা রাখেন, কানাডায় বেগমপাড়া বানান, তা বোঝাই যাচ্ছে।
জিডিপি মানেই যে উন্নতি, সেটা আমি বা আমার মতো সাধারণ মানুষ বুঝতে না পারলেও, অনেকেই এটাই ঠিক বলে পোষণ করেন, বিশেষ করে ধনী কমিউনিটি ও সরকার। তবে বিশ্লেষকদের একটি অংশ প্রবৃদ্ধির এই হিসাব নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। বাংলাদেশ যেমন সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী কয়েকটি দেশের একটি, তেমনি সর্বোচ্চ আয়-বৈষম্যের দেশগুলোরও একটি। সেক্ষেত্রে জিডিপির প্রকৃত অর্জন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। দুইভাবে প্রবৃদ্ধির মান বুঝতে পারা যায়— এর একটি আয় বৈষম্য, যা বাংলাদেশে ক্রমাগত বাড়ছে। অন্যটি কর্মসংস্থান, যা উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও তেমন বাড়ছে না।
কিছু মানুষের হাতে এত টাকা যে, দেশে টাকা রাখার জায়গা পাচ্ছে না। অন্যদিকে, অসংখ্য মানুষের হাতে প্রতিদিনের সংসার চালানোর টাকা নেই। খোলাবাজারে টিসিবির ট্রাক থেকে কম দামে পণ্য কিনতে মানুষের লম্বা লাইন ও সেখানে মধ্যবিত্তের ভিড় বাড়ছে। বাজারে মাছ না কিনে মাছের কাঁটা কেনার লোক বাড়ছে। ফকিন্নির বাজারেও ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে। এ থেকে প্রশ্ন জাগে, মাথাপিছু আয় আসলে বাড়লো কাদের? কতজনের বাড়লো? কীভাবে বাড়লো?
দেশের জনসংখ্যার মধ্যে রয়েছে খুব দরিদ্র মানুষ থেকে শুরু করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। যে কারণে একদিকে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়ছে ধনী ও অতি ধনী মানুষ। দুর্নীতি, লুণ্ঠন, সম্পদের অসম বণ্টন সমাজে দুটি বিপরীত অবস্থান সৃষ্টি করেছে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ও ধনী মানুষের এই বৈষম্যপূর্ণ জনসংখ্যার সমষ্টি দিয়ে জাতীয় আয়কে ভাগ দিলে একটি ফল পাওয়া যাবে ঠিকই, তবে তা দেশের বাস্তব চিত্র নয়, বরং খুব কনফিউজিং একটি চিত্র পাওয়া যায়।
মানুষ সবচাইতে বেশি বিপন্নবোধ করেন খাদ্যের দাম বেড়ে গেলে। কারণ অর্থনীতিবিদরা বলেন, খাবার কিনতেই আয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ করেন গড়পড়তা মানুষ। গরিব মানুষকে খাবার কিনতে আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত খরচ করতে হয়। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ মানুষই খাবারের দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিসটিংগুইসড ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, "ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সঙ্গতি না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী খাবার কিনতে সাধারণ মানুষের সমস্যা হচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, এমনকি বিবিএসের পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, দেশে পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।"
বিবিএসের হিসাবে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এমন কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটির মতো। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম হলে নিম্ন আয়ের মানুষেরা বেশি চাপে থাকেন। তাদের সংসার চালাতে খরচ কাটছাঁট করতে হয়। এতে জীবনযাত্রার মান দ্রুত কমে যায়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন মানুষের ভালো থাকা, সুখে থাকাকে গণনা করছে— শুধু প্রবৃদ্ধির ও জিডিপির হিসাব নয়। দেশে নিঃসন্দেহে প্রচুর অবকাঠামোগত উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু দেশের মানুষের মানবিক মূল্যবোধ বা মানসিকতার তেমন কোনোই উন্নতি ঘটছে না। শিক্ষাসহ সংস্কৃতির মান অধোগামী। বেকারত্ব বাড়ছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে, কিশোর গ্যাংসহ মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। এরকম একটি সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে যখন বৈষম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থা জড়িত হয়, তখনই জনরোষ মাথাচাড়া দেয়। এই জনরোষ যখন সোজা পথে প্রকাশিত হওয়ার পথ না পায়, তখনই গুপ্ত পথে অপরাধ বাড়তে থাকে এবং দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হয়।
প্রাচীন গ্রিক বিয়োগান্তক নাটকের রচয়িতাদের মধ্যে একজন হলেন— সোফোক্লিস, তিনি বলেছিলেন, "প্রতারণা করে সফল হওয়ার চেয়ে সম্মানের সাথে ব্যর্থ হওয়া ভাল।" কথাটা শুনতে ভালো, কিন্তু মানতে দেখছি না। আমাদের চারপাশের পরিস্থিতি এর উল্টো। আমরা অনেকেই সৎপথে দুটি টাকা আয় করে সম্মানজনকভাবে বাঁচবো বলে সকাল-সন্ধ্যা পরিশ্রম করি, কিন্তু দিনে দিনে বাড়ছে প্রতারণা করে সফল হওয়া মানুষের সংখ্যা। তবে কি সততা আমাদের দুর্বল করে রেখেছে?
বন উজাড়, পাহাড় কাটা ও নদী দখলের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্যের জমি বা সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ। এদেশের সর্বভুক মানুষগুলো গোগ্রাসে খাওয়া থামাতে পারছেনা। তবে এই খাওয়াতে সাধারণ মানুষের কোনো অংশগ্রহণ নেই। এক শ্রেণির ধনী, লুটেরা, অসৎ ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা ও ক্ষমতাধর মানুষ দেশের সম্পত্তি গোগ্রাসে গিলছে।
যখন খবরে দেখি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে; যখন শুনি ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এতকিছুর পরেও যখন জানতে পারি দুবাইতে বাংলাদেশিরাই সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী এবং তাদের বিনিয়োগের জোরে সে দেশের অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠছে, তখন সোফোক্লিসের কথা পরিহাস বলে মনে হয়।
- লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।)