ভারতে নির্বাচনের আগে মাদ্রাসায় অর্থায়ন বন্ধে রায় কিসের লক্ষণ

মতামত

04 April, 2024, 07:00 pm
Last modified: 04 April, 2024, 07:03 pm
সংক্ষুব্ধরা হয়তো উচ্চ আদালতে যাওয়ার চেষ্টা করবেন, কিন্তু ততদিনে ভারতের সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যাবে। তখন হয়তো বিচারপতিদের কেউ তাদের পূর্বসূরিদের দেখানো পথে হেঁটে কোনো না কোনো ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেবেন, না হয় পছন্দের কোনো বড় দলে যোগ দিয়ে ক্ষমতার ‘স্বাদ’ নেবেন, অথবা ক্ষমতার আশপাশে থাকবেন।

ভারতের বিচার বিভাগ নানাসময় অতি চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করার মতো কিছু ঘটনা ঘটায়। পশ্চিমবঙ্গ হাইকোর্টের এক বিচারপতি নানাভাবে গণমাধ্যমের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তার সর্বশেষ পরিণতি হচ্ছে, তিনি বিচার বিভাগ থেকে পদত্যাগ করে বর্তমানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলে যোগদান করেছেন আগামী সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য। এ রকম ঘটনা ভারতের বিচার বিভাগে ইদানীং ঘটছে। সাবেক এক প্রধান বিচারপতি মেয়াদকাল শেষ করে বিজেপিতে যোগ দিয়ে বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য হয়েছেন।

সম্প্রতি এলাহাবাদ হাইকোর্ট উত্তরপ্রদেশের সমস্ত মাদ্রাসায় সরকারের অর্থ সহায়তার বিধান বাতিল করে একটি রায় প্রদান করেছেন। রায়ে বিচারপতিদ্বয় উল্লেখ করেছেন, ২০০৪ সালের যে আইনে মাদ্রাসাগুলোকে রাষ্ট্র অর্থায়ন করছে তা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিকত্বের পরিপন্থী; বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাবিরোধী। যদিও ভারতের সংবিধান প্রণয়নকালে শব্দটি সংবিধানে ছিল না। ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি সংবিধানে সংযোজন করেছিলেন।  তাছাড়া এ শব্দটির ব্যাখ্যা সংবিধানে পরিষ্কার করা হয়নি — যা খানিকটা আমাদের দেশের সংবিধানের মতোই।

এলাহাবাদ হাইকোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চের এ রায় ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাসীন বিজেপিকে আরও উৎসাহিত করবে। এ মাদ্রাসাগুলোতে প্রায় ২৬ লাখ ছাত্র-ছাত্রী এবং ১০ হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়োজিত আছেন। যদিও মাদ্রাসাগুলোর একটি বিরাট অংশ সরকারের নীতিমালার আওতার বাইরে। ধারণা করা হয়, প্রায় পাঁচ শতাধিক মাদ্রাসাকে সরকারিভাবে অর্থায়ন করা হতো। বিচারপতিরা মাদ্রাসার অর্থায়ন বেআইনি ঘোষণা করায় মাদ্রাসাসমূহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, এ রায় কীভাবে যোগী আদিত্যনাথের বিজেপি রাজ্য সরকার কার্যকর করে। রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে, মাদ্রাসার এ শিক্ষার্থীদের সাধারণ স্কুলগুলোতে সংযুক্ত করে নিতে হবে। মাদ্রাসা-শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ রায়ে স্পষ্ট করা হয়নি।

মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা সমাজের একটি চলমান ও পুরাতন প্রক্রিয়া। এ অবস্থায় এতগুলো মাদ্রাসা রাতারাতি বন্ধ করে দেওয়া অস্বাভাবিক কাজ, তা সকলেই বোঝেন। লোকসভা নির্বাচনের আগে এ পদক্ষেপের মাধ্যমে মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার কফিনে পেরেক ঠুকে দেওয়া হলো। কারণ এ রায়ের ফলে ভারত আরও বেশি বিভাজিত হবে। শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের নামে সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এড়িয়ে গেছেন।

তবে এ কথা ঠিক, মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা যেভাবে থিওলজি স্কুল (ধর্মীয় দর্শন) হিসেবে মাদ্রাসাগুলো চালিয়ে রেখেছেন, তা পৃথিবীর আর কোনো ধর্মে এখন আর নেই। ইসরায়েলে এ ধরনের কিছু সিনাগক (ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা প্রতিষ্ঠান) থিওলজি স্কুল হিসেবে পরিচালিত হতো। আদিকালে এ ভারতবর্ষেই সনাতন হিন্দুধর্মের বিকাশ এবং পালনের জন্য টোল ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যেগুলোতে সরকারি অর্থায়নের ব্যবস্থা তখনও ছিল না, এখনও আছে বলে কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। ইউরোপের দেশগুলোতে চার্চ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অর্থের সংকটে। অর্থাৎ সেখানেও রাষ্ট্র থেকে চার্চের জন্য কোনো অর্থায়নের ব্যবস্থা নাই।

বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার একই অবস্থা। এখানেও দুধরনের ব্যবস্থা — আলিয়া আর কওমি। আলিয়া মাদ্রাসাগুলো সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও কওমি মাদ্রাসার একটি বিরাট অংশ সরকারের শিক্ষাক্রমের বাইরে। তারা সরকারের নীতিমালা মানে না, তাদের নিজস্ব শিক্ষাবোর্ড রয়েছে। এ ধরনের মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশকে কোরআনে হাফেজ তৈরি করা হয়। এ হাফেজ তৈরির জন্য যে সমস্ত বক্তব্য আছে, সেগুলো কতটা ধর্মভিত্তিক তা বলা মুশকিল। সমাজে এমন একটি বিশ্বাস সৃষ্টি করা হয়েছে যে, হাফেজ সৃষ্টি হলেই বেহেশতের পথ সুগম হয়। ফলে এ বিশাল জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে পিছিয়ে আছেন। তাদের দৈনন্দিন জীবন একই ধারায় চলে।

আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার যতগুলো পদক্ষেপ ঘটেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সামরিক শাসন। এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যার অন্যতম শুক্রবারে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা, আলিয়া মাদ্রাসাগুলোকে এমপিওভুক্ত করা (বিষয়টি যথার্থ ছিল), মসজিদের বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করে দেওয়া, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করা। এ সবের মধ্য দিয়ে বিশাল এক জনগোষ্ঠীর মনতুষ্টি অর্জন করেছিলেন সামরিক শাসক এরশাদ।

এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণাটি ছিল রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির অংশ। আদালত কর্তৃক সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ার ফলে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি ফিরে এলেও অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থাকে। তবে ২০১১ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্মের বিধানকে নতুন রূপ দেওয়া হয়। সংবিধানের প্রথম ভাগে ২-এর খ-তে 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম; তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবে' বলে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের এ দ্বৈধ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিপন্থি কি না তা জানা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়।

পরিশেষে বলতে হয়, ভারতের এলাহাবাদ হাইকোর্টের এ রায় অবশ্যই ভারতীয় সংখ্যালঘুদের জন্য বিড়ম্বনা সৃষ্টি করবে। সংক্ষুব্ধরা হয়তো উচ্চ আদালতে যাওয়ার চেষ্টা করবেন, কিন্তু ততদিনে ভারতের সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যাবে। তখন হয়তো বিচারপতিদের কেউ তাদের পূর্বসূরিদের দেখানো পথে হেঁটে কোনো না কোনো ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেবেন, না হয় পছন্দের কোনো বড় দলে যোগ দিয়ে ক্ষমতার 'স্বাদ' নেবেন, অথবা ক্ষমতার আশপাশে থাকবেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এখন বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য। তিনি নাগরিকত্ব আইন সিএএ পাস করিয়েছিলেন। যার 'পুরস্কার' তিনি পেয়েছেন। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের কারণে ভারতে তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে সামাজিকভাবে। এলাবাদ হাইকোর্টের এ দুই বিচারপতি সমাজের সুদূরপ্রসারি ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে যে সিদ্ধান্ত দিলেন, তা এ উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংকট বৃদ্ধি করবে। প্রতিবেশি দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এ থেকে মুক্ত থাকবে না।


লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক


বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.