‘পণ্য বর্জন নয়, উপমহাদেশের উন্নয়ন নিহিত বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্কে’

মতামত

30 March, 2024, 04:55 pm
Last modified: 30 March, 2024, 05:00 pm
মতামত কলামের লেখক বলেছেন, ‘দেশের মানুষের একটি ক্ষুদ্র অংশকে উসকে দিয়ে– দেশের সমস্ত মানুষকে জিম্মি করার এই রাজনীতি কবে বিদায় হবে, সেটি এখন বড় প্রশ্ন।’

বাংলাদেশে নতুন এক উপসর্গের নাম ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন। এই আন্দোলনে গণমাধ্যমের শীর্ষ কর্মকর্তারাও যুক্ত। এই ধরনের চিন্তা কোন উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত তা বলা মুশকিল। তবে নির্বাচন বর্জনকারী শীর্ষ একটি রাজনৈতিক দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক জনসম্মুখে ভারতের পণ্য পুড়িয়ে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। তবে কালবিলম্ব না করে দলটির শীর্ষ নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, এটা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত নয়। 

এমন একটি ইস্যু নিয়ে দেশের একটি অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল জনসম্মুখে উপস্থিত হতে পারে- তা কল্পনাতীত। দেশের কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সকল পণ্যের প্রয়োজনীয়তা এবং চাহিদা মোতাবেক বাজারজাত করার হিসেব-নিকাশের দিকে না তাকিয়েই— তারা এই অর্বাচীন আন্দোলনে নিজেদের যুক্ত করেছেন। এদের সাথে যারা যুক্ত হয়েছেন সম্ভবত তাদের কাছেও মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদার কোনো তথ্য নেই। বিষয়টি কেবলমাত্র পরিধানের শাড়ি ও শাল-চাদরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। শাল এবং শাড়ি ভারতীয় পণ্য হিসেবে যারা ব্যবহার করেন, তারা সকলেই সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষ।

বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই কৃষিপণ্যের জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীল। যার পরিমাণ এখন ১ কোটি ১০ লক্ষ টন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও এই ঘাটতি ছিল ১০ লক্ষ টনের মত। স্বাধীনতার এত বছর পর জমির পরিমাণ তো আর বাড়েনি, বেড়েছে জনসংখ্যা, বেড়েছে চাহিদা। মানুষের প্রয়োজনীয় পণ্যের প্রবাহ, বাজার সচল রাখা ও পণ্যের সহজলভ্যতার জন্য ভারত ছাড়া আমাদের বিকল্প কোথায়? আন্দোলনকারীরা একবার ভেবে দেখেছেন। আমাদের প্রয়োজনীয় পণ্য কম সময়ে ও স্বল্পমূল্যে পৃথিবীর আর কোথা থেকে আমরা আমদানি করতে পারি? এসকল চিন্তা না করে আমাদের দেশের কিছু সৌখিন জাতীয়তাবাদী মানুষের এই উদ্ভট রাজনৈতিক চিন্তায় সাধারণ মানুষ সাড়া দিবে না। সাধারণ মানুষ অর্থনীতির এই সাধারণ সূত্রটি বোঝেন। আমার প্রয়োজনীয় পণ্যটি সহজে ও স্বল্প মূল্যে যেখান থেকে পাব, আমি সেখান থেকেই কিনবো।

একজন গণমাধ্যম কর্মীর লেখায় দেখলাম, ভারতকে 'আধিপত্যবাদী' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শব্দটি বহুল উচ্চারিত, পুরাতন ও প্রচলিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যে রপ্তানি পণ্য সেটা হলো আমাদের তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাকের প্রধান উপাদান সুতা ও তুলা। তুলা প্রায় শতভাগ আমদানি-নির্ভর। আমাদের দেশে তুলা চাষ হয় না বললেও চলে। বাংলাদেশের সুতা উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে আমদানিকৃত তুলার উপর নির্ভরশীল। ভারত অন্যতম তুলা উৎপাদনকারী দেশ। এখন আমাদের যদি ভারত থেকে তুলা আমদানি না করে ইরান, উজবেকিস্তান বা আফ্রিকার কোন দেশ বা আরো পশ্চিমের কোন দেশ থেকে তুলা আমদানি করতে হয়– তাহলে আমদানির সময় ও ব্যয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে– তা এই আন্দোলনকারীরা ভেবে দেখেছেন? বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় আমাদের পোশাক শিল্পের টিকে থাকায় লড়াইয়ের কথা একবারও ভেবেছেন? এই প্রতিযোগিতায় আমরা টিকে থাকতে না পারলে আমরা দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হব। এটা কখনই কাম্য হতে পারে না।

ভারত প্রায়শই তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা বিবেচনায় কিছু নিত্যপণ্যের ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই ধরনের ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে আমাদের বাজারে। পেঁয়াজ তার বড় উদাহরণ। কূটনৈতিক তৎপরতায় কিছু বিষয়ে সুরাহা করা গেলেও সবসময় যে ফলাফল আনা সম্ভব হয়, তেমনটি নয়। ভোগ্যপণ্যের বাইরেও আমাদের শিল্পের কাঁচামালের জন্য আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। তুলা ছাড়াও বহু কাঁচামাল ভারত থেকে আমাদের আমদানি করতে হয়।

আমাদের ডলারের সাথে টাকার বিনিময় হার ঊর্ধ্বমুখী। টাকার সাথে আমদানি ব্যয় মারাত্মকভাবে বেড়েছে। আমদানিকৃত পণ্যের দাম আকাশচুম্বী। আমাদের দেশের আমদানিকারকরা যেটুকু সুবিধা পায়– তা ভারত থেকে আমদানি করার ফলে। ভারতের সাথে পণ্য বিনিময় নিজস্ব মুদ্রায় করার আলোচনাও চলছে। এর ফলে বাংলাদেশের ডলারের চাহিদার উপরে একটি লাগাম টানা সম্ভব হবে। বিশ্বব্যাপী ডলারের কর্তৃত্বের বিপরীতে আমরা যদি অন্তত প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বৈদেশিক লেনদেনের প্রথা চালু করতে পারি– তা আমাদের অর্থনীতির জন্য অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। এই প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও শুরু হয়েছে। রাশিয়া ও  চীনসহ পৃথিবীর আরও কিছু দেশের সাথে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে।

আমাদের দেশের গণমাধ্যমের একাংশ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও এই রাজনৈতিক দলটিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কৌশল অবলম্বন করেছিল। নির্বাচন বর্জনের আন্দোলনকে নানাভাবে উৎসাহিত করেছে। বিরোধীদলগুলো বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এমন একটি আবহাওয়া তৈরি করেছে সবসময়। তাদেরই একাংশ আবার এই ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনকে সমর্থন যোগাচ্ছে। 

এই আন্দোলনের সাথে যারা জড়িত তাদের অনেকেই  নির্বাচনের আগে পশ্চিমা দেশগুলোর দূতাবাসগুলোর তৎপরতার সাথে যুক্ত থাকতে দেখা গেছে। পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের প্রকাশ্য ভূমিকায় বিরোধী রাজনৈতিক দলটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, নির্বাচনের পূর্বেই সরকারের পরিবর্তন হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্টসহ অনেক দেশ এখন নির্বাচনের পর বাংলাদেশের সরকারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নসহ বন্ধুত্বের কথা বলছে।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ গণমাধ্যম পারস্পারিক সম্পর্কের সমতা রক্ষার পক্ষে মত দিচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি দলকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার বিরোধিতা করছে। তেমনি একটি সময় এই অর্বাচীন আন্দোলন যারা করেছেন– তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব সুস্পষ্ট হয়। দেশের মানুষের একটি ক্ষুদ্র অংশকে উসকে দিয়ে– দেশের সমস্ত মানুষকে জিম্মি করার এই রাজনীতি কবে বিদায় হবে, সেটি এখন বড় প্রশ্ন।

আঞ্চলিক সহযোগিতা এখন বিশ্বের অন্যতম উন্নয়ন কৌশল। ইউরোপের দেশগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল লড়াইতে লিপ্ত থেকেও– আজ ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করে পরস্পরের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা সার্ক গঠন করেছিলাম, কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কের তিক্ততার কারণে সেই সার্ক পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের লড়াই গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশদুটি ব্যাপক সামরিক ব্যয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, যার ফল ভোগ করছে সাধারণ মানুষ। নিরাপত্তার নামে সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা এই অঞ্চলের একটি বিশেষ ঘটনা। 

পাকিস্তান ও ভারতের মত দুর্বল অর্থনীতির দেশ পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র তৈরি ও সংরক্ষণ করছে। নিরাপত্তার নামে বিত্তশালী দেশগুলোর কাছ থেকে আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত সামরিক সরঞ্জামাদি ক্রয় করছে তারা।
এই অঞ্চলের নিরাপত্তা কেবলমাত্র সামাজিকভাবেই হতে পারে। পরস্পরের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে হতে পারে। যে শিক্ষা আমরা নিতে পারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর কাছ থেকে। পরিশেষে পণ্য বর্জনকারীদেরকে সুস্থ মাথার রাজনীতির আহবান রইলো।


লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক 


বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.