সৃজনশীল ধান বিজ্ঞান কি খুলে দিচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত?

মতামত

18 February, 2024, 03:30 pm
Last modified: 18 February, 2024, 04:21 pm
এই দুই ধানের চাষেই সার বলতে সামান্য গোবর ব্যবহার করলেই চলে। উর্বর জমিতে বীজতলা তৈরি করলে কোনো রকম সারই দরকার হয় না। অনুর্বর ও স্বল্প উর্বর জমিতে প্রতি বর্গমিটারে ১.৫-২.০ কেজি গোবর বা কম্পোষ্ট সার প্রয়োগ করতে হয়। চারা গজানোর পর গাছ হলুদ হয়ে গেলে দু’সপ্তাহ পর প্রতি বর্গ মিটারে ১৪-২৫ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়।

ভোরের কাক হয়ে হলেও কার্তিকের নবান্নের দেশে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে স্পষ্টভাবে বলাই হয়েছে 'ওমা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি/আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।' অন্নের জন্য বাঙালির আর্তি হাজার বছরের। চর্যাপদের প্রথম কবিতা শুরুই হয় 'হাঁড়িত ভাত নাহি'-র বিলাপ থেকে। তবে আশার বিষয় এই যে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে ধান বিজ্ঞানীরা তাঁদের সৃজনশীলতা, মেধা ও পরিশ্রমের সাহায্যে আমাদের দেশিয় প্রেক্ষিতের উপযোগী নানা জাতের ধান আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছেন, যা উত্তর বাংলা থেকে দক্ষিণ বাংলা পর্যন্ত অসংখ্য প্রান্তিক কৃষকের মুখে ফুটিয়েছে হাসি এবং দেশে বাড়াচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য স্ব-নির্ভরতা। সেই সাথে বিভিন্ন দেশিয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠন তাদের স্ব স্ব কর্ম এলাকায় উদ্দিষ্ট উপকারভোগী কৃষকদের এসব ধানের চাষে উদ্বুদ্ধ করে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্ব-নির্ভরতা অর্জনের গতিকে ত্বরান্বিত করছে।

এক-দুই দশক আগেও প্রতি বছরই বিশেষত: উত্তরাঞ্চলে প্রতি বছরই অক্টোবর মাসের দিকে বা বাংলা কার্তিক মাসে 'মঙ্গা' দেখা দিত। 'মঙ্গা' ছাড়াও এই মৌসুমি দুর্ভিক্ষের সময়কে 'আকাল'-ও বলা হয়। সে সময় মানুষের হাতে কোনো কাজ থাকত না; আবার ঐ সময়ে ক্ষেতের ধানও পাকত না। ফলে মানুষ গ্রামে কোনো কাজ না পেয়ে কাজের সন্ধানে শহরে চলে আসত। এ সময় প্রাণে বাঁচার তাগিদে মানুষ ঘরের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি বিক্রি করে পেটের ভাত যোগাত। আবার অনেকে জমি-জমা বন্ধক রাখত। উত্তরের এই আকাল নিয়ে দুই বাংলাতেই বহু কালজয়ী সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জন্ম নিয়েছে। চিরায়ত লোকসঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সংগৃহীত উত্তর বাংলার লোক গানে 'মঙ্গা আলো মঙ্গা আলো রে/কা করুম মুঞি/নাকের বেসর ব্যাচিবু মুঞি/ ভাত দেব ছাওয়ালেরে' জাতীয় পংক্তি আমরা জানতে পারি। 'মঙ্গা' বা আকালের এই সমকে 'মরা কার্তিক'-ও বলা হতো। সাধারণত প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর বা আমন ফসল রোপণ করার পরে এবং মার্চ-এপ্রিল বা বোরো ফসল রোপণ করার পরে এই স্বল্প-স্থায়ী তবে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্পন্ন দুর্ভিক্ষের দেখা দিত।

তবে এ বিষয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই 'বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট' এগিয়ে এসেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বড় ধরনের সাফল্য দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশে চাষের উপযোগী ৩৭টি উচ্চফলনশীল আধুনিক জাতের ধান উদ্ভাবন। সেগুলোর মধ্যে ১৩টি বোরো ও আউশ উভয় মৌসুমের, ৭টি বোরো মৌসুমের, ৫টি আউশ মৌসুমের এবং ১২টি রোপা আমন মৌসুমের উপযোগী।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত আধুনিক ধানের জাতসমূহ বর্তমানে বাংলাদেশের বোরোর (শীতকালীন ধান) প্রায় ৯০%, আউশের (গ্রীষ্মকালীন ধান) ২৫-৩০% এবং রোপা আমন ধানের (বর্ষাকালীন ধান) ৫০-৫৫% এলাকায় আবাদ করা হয়। এসব নতুন জাতের ধান দেশের মোট ধানের জমির প্রায় ৫৬% অংশে আবাদ করা হয় যা দেশের মোট বার্ষিক ধান উৎপাদনের প্রায় ৭৪%। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে 'বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট' কর্তৃক নতুন যত ধানের চাষ ও উৎপাদন প্রযুক্তিসমূহের ফলে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন ১৯৭২-৭৩ সালে ৯৯ লক্ষ ৩০ হাজার মেট্রিক টন থেকে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ মেট্রিক টনে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত সাম্প্রতিক সময়ে বিনা ধান-১৭ লবণাক্ত এলাকা ছাড়া দেশের সব রোপা আমন অঞ্চল বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুরা, পাবনা, রাজশাহীসহ ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে এবং লবণাক্ততা ও বন্যা কবলিত এলাকাসহ  দেশের জোয়ারভাটা কবলিত অঞ্চলে বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকা বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম জেলায় বিনা-২৩ ধানের চাষ সাধারণ কৃষকের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা দূর করেছে।

না, শুধু কাগজ-কলমের শক্ত শক্ত পরিসংখ্যানের কথায় পাঠক বিরক্ত হতে পারেন। দেশের প্রান্তিকতম নানা এলাকায় কীভাবে বাংলাদেশের ধান বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত সাম্প্রতিকতম দুই ধানের জাত বিনা-১৭ ও বিনা-২৩ ধান অসংখ্য কৃষকের উপকারে আসছে, সে বিষয়ে বরং চলুন সাতক্ষীরার শ্যামনগর এলাকার পশ্চিম ধানখালি গ্রামের তিন প্রান্তিক কিষাণীর মুখের কথা জেনে নিই। এই প্রবন্ধের সাথে সংযুক্ত ভিডিও চিত্রে যে তিন গ্রাম্য কিষাণীকে দেখা যাচ্ছে ধানের খড় থেকে বিচালী কাটতে এবং দ্বিতীয় ভিডিওতে তিন কিষাণীর একজনকে দেখা যাচ্ছে বিনা-২৩ ধান কুলায় করে ঝাড়তে। এঁরা প্রত্যেকেই সুইডিশ দূতাবাসের অর্থায়িত 'বায়ো-ডাইভার্সিটি ফর রেজিলিয়েন্ট লাইভলিহুড' প্রকল্পের উপকারভোগী এবং 'সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্সেস স্টাডি (সিএনআরএস)' নামে একটি জাতীয় পর্যায়ের উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে। এই দুই ভিডিও চিত্রে অনিমা রাণী মন্ডল, বীথিকা রাণী মন্ডল এবং কল্যানী রাণী মন্ডল নামে তিন কিষাণী জানাচ্ছেন যে কীভাবে লবণাক্ততা প্রধান তাঁদের এলাকায় বিনা-২৩ রোপণ করার কারণে গত নভেম্বরের ১৮-১৯ তারিখে হওয়া অগ্রহায়ণ মাসের ঝড়ের আগেই বিনা-২৩ ধান রোপণ করায় তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় ১৫-৩০ দিন আগে ফসল পেয়েছেন। ফলে অতীতে যেমন অগ্রহায়ণ বা অঘ্রান মাসে ঝড়-বৃষ্টি হলে চাষীর সারা বছরের পরিশ্রম পণ্ড হতো, এখন আর তা হয় না। বন্যা ও জলাবদ্ধতা কি লবণাক্ততাতেও বিনা-২৩ ধান নষ্ট হয় না।

বিনা-২৩ ধান প্রসঙ্গে এই তিন কিষাণী বলেন, 'ধান ভাল হইয়িছে। ২০-২২ মণ বিঘা প্রতি পাইয়িছি। ঝড়ের আগেই ধান উঠি গিইয়েছে- ধান মলাও হইয়ি গেছে।' বিনা-২৩ ধান অঘ্রানের ঝড়ের ১৫-৩০ দিন আগেই কৃষকের গোলায় উঠে যায় বলে তখন জমিতে সর্ষে, গম, আলু, পেঁয়াজ, বাঁধাকপি, পুঁই শাক সহ নানা ধরনের শাক-সবজিও ফলানো যায়।

কিষাণী অনিমা রাণী মন্ডল বলেন, 'এক ফসলী দেশের মানুষ আমরা- এখন দু'টো/তিনটে ফসল করা যায়।' ভাতের স্বাদ কেমন সে প্রশ্নের উত্তরে বলেন, 'যে ক'টা ধান সে ক'টা চাল। আজ সকালে রান্ধলি পর কাল সকালিও (সকালেও) খাতি পারবেন।'

বিনা-২৩ ধানের উদ্বৃত্ত ফলনের সুবাদে কৃষকেরা ধান খেয়ে-পরেও বাড়তি ধান বাজারে বিক্রি করতে পারেন। যেমন, এই প্রবন্ধের সাথে সংযুক্ত ভিডিও চিত্রের কিষাণীরা জানাচ্ছেন যে বিনা ধান-২৩ চাষের ফলে ধান কিছু খাবার পরেও তারা ৬০ কেজি চালের এক বস্তা বাজারে ১৯০০ টাকায় বিক্রি করতে পারেন। ধান বিক্রি করার পর তার খড় থেকে বিচালী কেটে গরু সহ গবাদি পশুর খাবার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।

উল্লেখ্য, এই তিন কিষাণীই ১৯৯৪ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে আসা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান সিএনআরএস-এর বিফরআরএল প্রকল্পের উপকারভোগী। প্রকল্পটি সুইডিশ দূতাবাসের অর্থায়নে ২০২৩ এর এপ্রিলে যাত্রা শুরু করেছে এবং সাতক্ষীরা, খুলনা, মাগুরা ও নড়াইল জেলার ৩০ হাজার প্রান্তিক কৃষক ও জেলে, বনজীবী, নারী, বিশেষ সুবিধা সম্পন্ন জন-গোষ্ঠি ও মুন্ডা আদিবাসীরা এই প্রকল্পের অন্বিষ্ট জন-গোষ্ঠি। প্রান্তিক কৃষক এবং এমনকি নারী কৃষকদের ভেতর আধুনিক ও আমাদের এলাকার জলবায়ুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নানা জাতের ধান চাষ এবং সেসব ধানের বীজ সরবরাহে প্রকল্পটি কাজ করে থাকে।

এই তিন কিষাণী বলেন, 'সিএনআরএস থেকে আর কৃষি অফিস থেকে মানুষ-জন সবসময়ই আমাগের সাথে যোগাযোগ করেন।'

খনার বচনে বলে, 'যদি বর্ষে আগনে/রাজা যায় মাগনে।' এর অর্থ- অগ্রহায়ণ বা অঘ্রান মাসে বৃষ্টি হলে রাজাও 'মাগন' বা ভিক্ষায় যান। খনার এই বচনই প্রমাণ করে যে অতীতে এই কৃষি-প্রধান অঞ্চলের মানুষ অঘ্রাণে বৃষ্টি হয়ে সারা বছরের পরিশ্রমের ধান নষ্ট হলে কতটা বিপন্ন বোধ করত! আজ কিন্তু বিনা-২৩ বা বিনা-১৭ ধানের ফলে কৃষকের সেই বিপন্নতা আর নেই!

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শামছুন্নাহার বেগম বলেন, '২০১২ সালে বিনা ধান-১০, ২০১৫ সালে বিনা ধান-১৭ ও ২০১৯ সালে বিনা ধান-২৩ উদ্ভাবনের পাশাপাশি বাজারে আনতে আমরা সক্ষম হই। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, মৃত্তিকা ও পানির স্বভাব বুঝে বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে কৃষক-বান্ধব নানা জাতের ধান উদ্ভাবনে আমাদের প্রতিষ্ঠান বহু বছর ধরে কাজ করে আসছে।'

বর্তমানে সারা দেশে ৯৫ হাজার ৭৮৯ হেক্টর জমিতে বিনা-১০, ৩ লাখ ৭৭ হাজার ১৭৭ হেক্টর জমিতে বিনা ধান-১৭ ও ১৮ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে বিনা ধান-২৩ চাষ করা হচ্ছে বলে এই কৃষিবিজ্ঞানী অবহিত করেন। 

তাঁর সাথে দীর্ঘ টেলিফোন আলাপে আরো জানা যায়, বিনা ধান ১৭ খরা সহিষ্ণু (৩০% পানি কম প্রয়োজন), স্বল্পমেয়াদী (জীবনকাল ১১২-১১৮ দিন) ও অধিক ফলনশীল, চাষে কম সার প্রয়োজন হয়, আলোক অসংবেদনশীল ও উন্নত গুণাগুণ সম্পন্ন আমন ধানের জাত হলেও বিনা ধান-২৩ দেশের জোয়ার-ভাটা, লবণাক্ততা ও বন্যা কবলিত এলাকার জন্য উপযোগী আমন মৌসুমে চাষোপযোগী। লবণাক্ত ও উপকূলীয় এলাকার জন্য উপযোগী বিনা ধান-২৩ স্বল্পমেয়াদী (জীবনকাল ১১৫-১২৫ দিন) ও অধিক ফলনশীল।

'এই ধান পুরো পেকে যাওয়া বা পরিপক্ক অবস্থায় ৮ ডিএস/মি মাত্রার লবণাক্ততা ও ১৫ দিন পর্যন্ত জলমগ্নতা সহ্য করতে পারে। এই ধানের চাল মাঝারি চিকও এবং চাষের জন্য উপযুক্ত জমি ও মাটি হলো মাঝারি-উঁচু থেকে নিচু জমি।'

শামসুন্নাহার আরো জানান, জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি অন্যান্য উফশী রোপা আমন জাতের মতই এবং প্রতি জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের (১-৩০ আষাঢ়) মধ্যে বীজতলায় বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।

জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি অন্যান্য উফশী রোপা আমন জাতের মতোই। প্রতি হেক্টর জমি চাষের জন্য ২৫-৩০ কেজি বা এক একর জমির জন্য ১০-১২ কেজি বীজ প্রয়োজন।

অন্যদিকে বিনা-১৭ ধানের চাষাবাদ পদ্ধতিও অন্যান্য উফশী রোপা আমন জাতের মতই হয়ে থাকত এবং এই ধানও বপনের ক্ষেত্রে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের (১-৩০ আষাঢ়) মধ্যে বীজ তলায় বীজ বপনের জন্য আদর্শ। প্রতি হেক্টর জমি চাষের জন্য ২৫-৩০ কেজি বা এক একর জমির জন্য ১০-১২ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়।

এই দুই ধানের চাষেই সার বলতে সামান্য গোবর ব্যবহার করলেই চলে। উর্বর জমিতে বীজতলা তৈরি করলে কোনো রকম সারই দরকার হয় না। অনুর্বর ও স্বল্প উর্বর জমিতে প্রতি বর্গমিটারে ১.৫-২.০ কেজি গোবর বা কম্পোষ্ট সার প্রয়োগ করতে হয়। চারা গজানোর পর গাছ হলুদ হয়ে গেলে দু'সপ্তাহ পর প্রতি বর্গ মিটারে ১৪-২৫ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়।

শামসুন্নাহার আরও বলেন, 'বিনা-১৭ ধানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ফলন নিশ্চিত করতে হলে পুষ্ট ও রোগবালাই মুক্ত বীজ ব্যবহার করা প্রয়োজন।'

তার মত হলো- 'এই দুই ধানের ক্ষেত্রেই সেচের খুব একটা প্রয়োজন হয় না। তবে প্রয়োজন হলে সেচ দিতে হবে। ধান পাকার ১০-১২ দিন আগে জমির পানি শুকিয়ে ফেলা ভাল।'

এই দুই ধানের জাতেই রোগ বালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণও কম হয়। এই দুই ধানের জাতের ভেতর বিনা ধান-১৭-এর ফলন গড় হেক্টর প্রতি ৬.৮ টন এবং সর্বোচ্চ ৮.০ টন ও বিনা-২৩ জাতের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৫.৩ টন এবং সর্বোচ্চ ফলন ৫.৮ টন হয়ে থাকে।

শুধু জাতীয় পর্যায়ের শীর্ষ ধানবিজ্ঞানী শামসুন্নাহার নন, সাতক্ষীরার শ্যামনগরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মুন্সী মাসুমের মতো তৃণমূল পর্যায়ের কৃষিবিদও বলেন, 'বিনা-২৩ সাতক্ষীরা সহ বৃহত্তর খুলনা এলাকার জলাবদ্ধ ও লবণাক্ত ভূ-প্রকৃতি ও পানির জন্য খুবই উপযুক্ত। এই ধান পানিতেও পচে না, নির্দিষ্ট সময়ের আগে হয়। ধান কাটা হয়ে গেলে সরিষা আবাদ করলে লবণাক্ততা কমে যায়। সেই সাথে আরো নানা শাক-সব্জি করা যায়।'

এ প্রসঙ্গে উন্নয়ন সংস্থা সিএনআরএস-এর নির্বাহী পরিচালক মোখলেছুর রহমান (পিএইচডি) বলেন, 'তৃণমূলে এখন অগ্রহায়ণের ঝড়ের আগেই গোলায় তুলতে পারা এই ধানগুলোকে 'আগাম ধান' বলে এবং আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আমরা চেষ্টা করছি আমাদের উপকারভোগী কৃষকদের এসব নতুন জাতের ধানের সাথে পরিচিত করাতে, যাতে প্রতি বছর একটি মাত্র ফসল চাষ এবং সেই ফসলও নানা মৌসুমি দুর্যোগে নষ্ট হয়ে কৃষকদের নিত্য দুর্বিপাকে থাকতে না হয়।'

তিনি বলেন, 'দেশের সব কৃষি ও পরিবেশ বিষয়ক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানেরই উচিত এ জাতীয় ধানের চাষে তাদের উপকারভোগী জন-গোষ্ঠিকে উদ্বুদ্ধ করা।'

অন্তর্জালে প্রকাশিত নানা তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কিছুটা খর্বাকৃতির আলোক নিরপেক্ষ জাত উদ্ভাবনে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে অনুসরণ করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা অধিক ফলনের জন্য আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ধারণা থেকে সরে আসেন এবং স্থানীয় কৃষি বাস্তুসংস্থানিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য IR8 (আইআর৮) প্লান্ট-টাইপকে পুনর্গঠন করেন। স্থানীয় কৃষি বাস্তুসংস্থানিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে এবং কৃষকদের আর্থ-সামাজিক চাহিদা পূরণ করতে অপেক্ষাকৃত ছোট বৃদ্ধিচক্র ও মৃদু আলোকদিবস সংবেদনশীলতা সম্পন্ন ধান গাছ উদ্ভাবন করা হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত বেশ কিছু আধুনিক জাতের ধান অন্যান্য দেশে যেমন ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়।

এ ইনস্টিটিউটের রসায়নবিদগণ নিয়মিতভাবে চালের স্বাদ, রান্নাগুণ, ধান ভানার পর প্রাপ্ত চালের অনুপাত (milling outturn), ঘ্রাণ, আমিষ ও অ্যামাইলেজের পরিমাণ ইত্যাদি মূল্যায়ণ করে প্রত্যাশিত গুণাগুণসম্পন্ন জাত উদ্ভাবনে উদ্ভিদ-প্রজননবিদদের সহায়তা করেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ-প্রজননবিদরা প্রায় ৫ হাজার স্থানীয় জার্মাপ্লাজমসহ প্রায় সাড়ে ৭ হাজার জার্মাপ্লাজম সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছেন। সম্প্রতি হাইব্রিড ধান উদ্ভাবন ও উৎপাদন কৌশলের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

শেষ করছি কবি অরুণ মিত্রের সেই বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি পংক্তি: '..খরায় মাটি ফেটে পড়ছে/আর আমি হাঁটছি রক্তপায়ে/যদি দু-একটা বীজ ভিজে ওঠে/হা: হা: নিসর্গের বুকে আমি হাড় বাজাচ্ছি/আর মাদারির মত হেঁকে বলছি/এই আওয়াজ হয়ে যাবে একমাঠ ধান' দিয়ে।

আমাদের সৃজনশীল ধানবিজ্ঞানী বৃন্দ ও নানা প্রতিষ্ঠানের নিরলস পরিশ্রমে আজ আর 'বীজ ভেজাতে' কৃষকের 'রক্ত পায়ে' হাঁটার দরকার নেই।

 


লেখকদের পরিচয়: 
অদিতি ফাল্গুনী: যোগাযোগ ব্যবস্থাপক, বিফরআরএল-সিএনআরএস।
মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, প্রকল্প পরিচালক
বায়ো-ডাইভার্সিটি ফর রেজিলিয়েন্ট লাইভলিহুড (বিফরআরএল-সিএনআরএস)।
আনিসুল ইসলাম, পরিচালক, সিএনআরএস।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.