শুধুমাত্র আইএমএফ নির্ধারিত শর্তের পিছনে ছুটলে অর্থনীতির সংকট বাড়বে

মতামত

11 October, 2023, 06:00 pm
Last modified: 11 October, 2023, 06:05 pm
আইএমএফ যে ২৫ বিলিয়ন ডলারের সংরক্ষণের সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছিল, তা যে মেনে চলা সম্ভব হবে না, সেটা আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা কেন বুঝতে পারেন নাই? কিংবা রাজস্ব আয়ের বিষয়ে যে শর্ত দেয়া হয়েছিল, কিংবা আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রে যে শর্ত– সেসব কতটুকু অর্জন সম্ভব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভেবে দেখা উচিত ছিল।

পদ্মাসেতুকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দীর্ঘদিন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে ছিল। প্রায় এক দশক সময় কাল ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিচালিত হয়েছে তাদের উপদেশ, আদেশ ও শর্তযুক্ত ঋণ-মুক্ত অবস্থায়, মোটামুটি ভাবে। সকল ঋণেই চুক্তি থাকে । কিন্তু, আইএমএফ ঋণের শর্ত কখনো কখনো দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ বিষয়ের বহু কিছুতেই হস্তক্ষেপ করার শামিল হয়ে যায় ।

বাংলাদেশের একটি আমদানি-নির্ভর দেশ। যার বৈদেশিক মুদ্রার মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো আয় (রেমিট্যান্স) ও পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয়। শুধু পোশাক শিল্পের আয় দিয়ে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ও ব্যবহার করতে হয়।

বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা। যাদের আয় থেকে দেশের উন্নয়ন ও অন্যান্য খরচ চলে– সেই প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে বহু বছর যাবত এ খাতের বহু কিছুতে অস্পষ্টতা রয়েছে। দেশের প্রধান প্রধান ব্যবসার প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেই অতীতে কিংবা বর্তমানেও বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর পেশার সঙ্গে জড়িত।

কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশ যেতে প্রতিটি শ্রমিককে যে ব্যয় করতে হয়, কখনো তা সাধারণত তাদের দুই বছরের আয়ের সমতুল্য। সাধারণত এরা দুবছরের চুক্তিতে নিয়োগ হয়ে থাকেন। কিন্তু, নিয়োগদাতারা চুক্তি না নবায়ন করলে এরা বিদেশে অবৈধ শ্রমিক হিসেবে থেকে যান, ফলে তাদের আয়ের সিংহভাগও বৈধ পথে দেশে পাঠাতে পারেন না। এই অবৈধ শ্রমিকরা ওই দেশের নিয়োগকারীদের কাছে সস্তায় শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হয়। প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার বিষয়গুলোতে আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ব্যাপক।

পোশাক শিল্প থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিরাট অংশই আবার খরচ হয় তার বিপরীতে কাঁচামাল আমদানিতে। গত বছরে আইএমএফ থেে ঋণ প্রাপ্তির সম্ভবনা সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই ডলার সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করা হয়। আর তা করতে গিয়ে ডলারের অবৈধ বেচাকেনার চাহিদা আরও বাড়ে। আমাদের বেশকিছু খাতে বৈধ প্রক্রিয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করা যেত; যেমন অতীতে অনেকেই হিসাববিহীন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতেন কিংবা বিদেশে সন্তানদের শিক্ষা খরচ বহন করতেন। ডলার সংরক্ষণ নীতির ফলে দুই ক্ষেত্রেই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। হয়তো তা যথার্থ। কিন্তু, তার ফলে বেআইনিপথে চাহিদা বেড়েছে; এবং যতই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হোক না কেন, ডলারের খোলাবাজারে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ হবে তার বাজার চাহিদার উপর। ভবিষ্যতে ডলারের উচ্চ মূল্য পাবার আশায় শ্রমিকরাও তাদের আয়ের সিংহভাগ কর্মরত দেশগুলোতে জমা করছেন। পোশাক শিল্পও একইভাবে তাদের আয়ের একটি অংশ বাইরে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। তাই সেপ্টেম্বর মাসে দেশে ডলার আসা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।

দেশে যতদিন বেআইনি আয় সৃষ্টি হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ডলারের হুন্ডি বাজার সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকবে। শিল্পের পর্যাপ্ত কাঁচামাল আমাদের নেই, এমন সময়ে রিজার্ভ সংরক্ষণের শর্তযুক্ত ঋণ নিয়ে কতোটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয়?- সেটি একটি বড় প্রশ্ন।

রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে গিয়ে দেশের স্বাভাবিক আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ব্যাপকভাবে। এর সাথে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে বিঘ্ন ঘটায় শিল্প উৎপাদনও মারাত্মকভাবে ব্যাহত। গ্যাস সরবরাহ কম থাকার ফলে দেশের প্রতিটি শিল্প কারখানায় লোডশেডিং এর আওতায়। শর্তযুক্ত ঋণ দেশের প্রবাসী আয়ের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। কারণ প্রকাশ্যে এসে পড়েছে আমাদের ডলার সংকট। ব্যাংকগুলো প্রয়োজন মতন আমদানি পত্র খুলতে পারছে না, দেশের শিল্প-কারখানার ধুঁকতে শুরু করেছে।

আইএমএফ যে ২৫ বিলিয়ন ডলারের সংরক্ষণের সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছিল, তা যে মেনে চলা সম্ভব হবে না, সেটা আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা কেন বুঝতে পারেন নাই? কিংবা রাজস্ব আয়ের বিষয়ে যে শর্ত দেয়া হয়েছিল, কিংবা আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রে যে শর্ত– সেসব কতটুকু অর্জন সম্ভব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভেবে দেখা উচিত ছিল।

আইএমএফের কেবলমাত্র ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য এই সমস্ত চুক্তি মেনে নেওয়ায় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চরম সংকটে পড়ছে। ডলারের সেই সীমারেখার কারণে ক্ষমতাশালী ব্যাংক মালিকরাই কেবলমাত্র আমদানির সুযোগ পাচ্ছেন, ফলে আরো বেশি সিন্ডিকেট সৃষ্টি হচ্ছে। পণ্যমূল্য বাড়ছে। আমাদের মাসিক আমদানি ব্যয় ও অন্যান্য খরচে গড়ে ২ বিলিয়ন ডলারের মতোন ঘাটতি। প্রতি মাসে সেই ব্যয় মেটানোর মতোন আমাদের প্রায় এক বছরের অর্থসংস্থান আছে– এ বিষয়টিকে মাথায় রেখে আমাদের পরিকল্পনা সাজিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। শুধুমাত্র আইএমএফ নির্ধারিত শর্তের পিছনে ছুটলে অর্থনীতির সংকট বাড়বে কিনা তা সকলের ভেবে দেখা দরকার। পরিশেষে আবারো বলা যায়, বেআইনি পন্থায় সম্পদ বাড়লে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দরকার বেআইনি আয়ের পথ বন্ধ করা। কিন্তু, উদ্বেগের বিষয় সমাজের প্রায় সকল স্তর থেকেই সর্বোচ্চ পর্যায়ে এই দুর্নীতির বিষয়ে স্বীকারোক্তি পাওয়া যাচ্ছে।
    

 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.