যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা আমাদের যে শিক্ষা দেয়

মতামত

05 October, 2023, 07:30 pm
Last modified: 05 October, 2023, 07:37 pm
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা আর স্পিকারের ক্ষমতার মধ্যে একটি ভারসাম্য আছে।‌ প্রতিনিধি পরিষদের এই ক্ষমতা হচ্ছে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা। আবার মার্কিন প্রেসিডেন্টেরও প্রতিনিধি পরিষদের কোন আইনের ওপর ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাবে পরাজিত হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ২১৬ এবং বিপক্ষে ২১০ ভোট পড়ে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ফ্লোরিডার রিপাবলিকান ম্যাট গায়েটজ এই অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। স্পিকারের বিরুদ্ধে গায়েটজের অভিযোগ, ইউক্রেনে অর্থ সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে মার্কিন প্রশাসনের সাথে স্পিকার গোপন সমঝোতা করেছেন।

গায়েটজের এই প্রস্তাব ডেমোক্রেট সদস্যরা লুফে নেন এবং তার সাথে যুক্ত হন গায়োটজসহ আটজন সদস্য যারা কট্টর ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত। আটজনের একটি ছোট গ্রুপই নিজ দলের স্পিকারের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দেন। গত জানুয়ারিতে স্পিকার নির্বাচনের সময় ম্যাট গায়েটজসহ আরও কয়েকজন কেভিন ম্যাককার্থিকে সমর্থন জানাতে অপারগতা প্রকাশ করায়, একটা লম্বা ভোটাভুটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ম্যাককার্থি স্পিকার নির্বাচিত হয়েছিলেন।

স্পিকারের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য হলেও, এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সচলতা রক্ষা পেয়েছে। অর্থাৎ, সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছে। এটি শেষ মুহূর্তের সমঝোতার ফসল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই দুই দল পরস্পরের সাথে চরম বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্বেও- শেষ মুহূর্তে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক বেতনভাতা চালু রাখার স্বার্থে স্পিকার হোয়াইট হাউজের সাথে এক সমঝোতায় এসেছেন। ট্রাম্পের অনুসারীরা এ বিষয়ে একমত হতে পারেননি। ম্যাককার্থি কি জানতেন, দেশের অর্থনীতির ধারা অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টার কারণে তাকে বিদায় নিতে হবে? আমরা জানি না, তবে বাইডেন প্রশাসনকে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অচলাবস্থা থেকে ম্যাককার্থি উদ্ধার করেছেন। ম্যাককার্থি এই অপরাধের (!) জন্য যেমন দলীয় অনাস্থার সম্মুখীন হলেন; অন্যদিকে উদ্ধার পাওয়া বাইডেন প্রশাসন সুযোগ কাজে লাগাতে কুন্ঠাবোধ করেনি। আস্থাভোটে পরাজিত হওয়ার পর ম্যাককার্থি বলেছেন, 'আমি যা বিশ্বাস করি, তাই করেছি'।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে অনেকদিন যাবত বেশ সরগরম অবস্থা দেখছি। সরকার সমর্থকরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে না গেলে কী হয়? যাদের সম্পদ সেখানে আছে, বাজেয়াপ্ত হলেই বা কী হবে? এমনি সব কথা। অন্যদিকে বিরোধীপক্ষ মহানন্দে। মার্কিন ভিসানীতি তাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিবে। তারা ক্ষমতার মসনদে বসার দিনক্ষণ তৈরিতে ব্যস্ত! প্রতি সপ্তাহে ক্ষমতায় বসার নতুন তারিখ দেখতে পাই। অনঢ় এই দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দু'পক্ষরেই পারস্পারিক বিশ্বাসভঙ্গের এত উদাহরণ রয়েছে, যে এখন কেউ আর কাউকে নূন্যতম বিশ্বাস করে না। পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এর তালিকা খুবই দীর্ঘ। কে কতটুকু দায়ী? কার দায়িত্ব কতটুকু, এসব বিষয় গত ৩০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বর্তমান প্রজন্মের কাছে বহু কিছুই অজানা তথ্য হিসেবে বেরিয়ে আসবে। গত ৩০ বছরের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ আমার দেশে এখনো তৈরি হয়নি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা, দেশটির বিভিন্ন আইন কানুন, কিভাবে দেশটি চলে- এসব বিষয়ে নিয়ে কখনো কাউকে আলোচনা করতে দেখা যায় না। প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকারকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী বলা যেতে পারে। রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় সেখানে প্রতিনিধি পরিষদ (নিম্ন কক্ষ) এর নেতা হন স্পিকার নিজ দলের ভোটের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রীর শাসিত গণতান্ত্রিক ব্রিটিশ মডেলে পার্লামেন্টের নেতা হচ্ছেন- প্রধানমন্ত্রী আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থায় সেখানে নেতা হচ্ছেন- স্পিকার।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আর স্পিকারের ক্ষমতার মধ্যে একটি ভারসাম্য আছে।‌ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের এই ক্ষমতা হচ্ছে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা। আবার মার্কিন প্রেসিডেন্টেরও প্রতিনিধি পরিষদের কোন আইনের ওপর ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০-এর অনুচ্ছেদের মতন কোন উপধারা না থাকারই ফসল। এমনি বহুবিধ বিষয় আছে যা আমরা দূর থেকে অনুধাবন করতে পারি না। কিন্তু, যারা সমাজ সচেতন বিভিন্ন গণমাধ্যমে কথা বলেন, তাদেরকে মার্কিন গণতান্ত্রিক চর্চার শক্তিশালী ভিত্তি সেই দেশটির সংবিধান এবং তার বিভিন্ন ধারা-উপধারার বিষয়ে কখনো উল্লেখ করতে দেখি না।

যদিও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি তাদের বৈদেশিক নীতির সবটাই তাদের জাতীয় স্বার্থকে লক্ষ্য রেখে পরিচালিত হয়, এটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ তাই করে থাকে। কিন্তু, কখনো কখনো মার্কিন এই পররাষ্ট্রনীতিগুলো এত বেশি একপেশে, যা পৃথিবীর বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে তা অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে।

মার্কিন পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য সংখ্যা রাজ্যগুলোর জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। মোট সদস্য সংখ্যা ৫৫৪, যাদের সময়কাল দু'বছর। প্রতি দু'বছর পরপর প্রতিনিধি সভার নির্বাচন হয়, যাকে মধ্যবর্তী নির্বাচন বলে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় চার বছর পর পর। সেই অর্থে প্রেসিডেন্টের মধ্যবর্তী নির্বাচন। উচ্চকক্ষ সিনেটের সদস্য সংখ্যা রাজ্যের ভিত্তিতে মোট ১০০ টি রাজ্যের দুজন করে ১০০ জন সিনেটর। আবার সিনেটের কার্যকাল ৬ বছর। প্রতি দুই বছর অন্তর সিনেটের এক-তৃতীয়াংশ সদস্যের পুনঃনির্বাচন হয়। উচ্চকক্ষ সিনেটের সংখ্যা নির্ধারিত। সিনেট কোন আইন প্রণয়ন করে না; কিন্তু সকল আইন ও রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশের অনুমোদন দেয়। প্রতিনিধি পরিষদ স্বাধীনভাবে প্রয়োজনীয় যেকোন আইন পাস করতে পারে, কিন্তু তাতে সিনেটের অনুমোদনের দরকার রয়েছে। আবার সিনেট অনুমোদন দেওয়ার পরও রাষ্ট্রপতি ভেটো প্রয়োগ করতে পারেন। সেকারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানকে বলা হয়- ভারসাম্যের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে এককভাবে কেউই নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী নয়।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সবচেয়ে কলঙ্কিত দিক হচ্ছে- ১৯৭৫ এর হত্যাকাণ্ড। কয়েক বছর আগে প্রথম আলোর প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের এ সংক্রান্ত এক গবেষণা বইয়ে ৭৫' এর ঘটনায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এর সম্পৃক্ততা প্রকাশ পেয়েছিল। এছাড়াও, পৃথিবীর আরও বহু দেশের বহু ঘটনার পিছনে মার্কিনীদের প্রত্যক্ষ সংযোগ দেখা গেছে।

জ্বালানি তেল আবিষ্কার এর পর থেকে ও তার প্রয়োজনীয়তা বাড়ার পর থেকেই– জ্বালানি তেল ভূরাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। জ্বালানি তেলকে কেন্দ্র করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য তার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে আসছে অব্যাহতভাবে। তাদের পর্দার অন্তরালের কূটনীতিতে আজ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শত্রু দুই দেশ– সৌদি আরব ও ইসরাইল এক ধরনের বন্ধুত্বের রাস্তায় হাঁটছে। ইসরাইল-বিরোধী অন্যান্য দেশগুলোর কাছ থেকে ইসরাইলের সমর্থন আদায় করা এবং ইসরাইলের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করার ব্যবস্থা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এশিয়ার মুসলিম দেশগুলো এখনও সে রাস্তায় হাঁটেনি। তবে আগামীতে যে এশিয়ার মুসলিম দেশগুলো সৌদি পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কেবলমাত্র একজন রাষ্ট্রপতি অপসারণের লক্ষ্যে ভোটাভুটি হওয়ার প্রাক্বালে পদত্যাগ করেছিলেন। মার্কিন ইতিহাসে প্রথম ইম্পিচমেন্টের সম্মুখিন হন প্রেসিডেন্টে আ্যন্ড্রু জনসন (১৮৬৫- ১৮৬৯)। এর প্রায় দেড়শ' বছর পর অভিসংশনের সম্মুখীন হন বিল ক্লিনটন এবং সর্বশেষ ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৮৬১ সালে আব্রাহাম লিংকন যুগান্তকারী দাস ব্যবস্থা বিলোপ করার পদক্ষেপ নেন। এত বড় পরিবর্তন মার্কিন অভিজাতরা মেনে নিতে পারেননি। দেশ গৃহযুদ্ধে পতিত হয়। আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান আব্রাহাম লিংকন। লিংকন নিহত হওয়ার সময়ে উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন আ্যন্ড্রু জনসন। পরে তিনি প্রেসিডেন্ট হন। ১৮৬৮ সালে ডেমোক্রেটিক দলের এই প্রেসিডেন্ট মাত্র এক ভোটে অভিসংশিত হওয়া থেকে রক্ষা পান।

রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যখন ঢাকার বুকে মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে বিভিন্ন বিবৃতি দিচ্ছেন, তখন ভারতের রাস্তায় নাগরিকত্ব আইনের বিতর্কে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। নিষিদ্ধ করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা কিংবা মিছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা গণতন্ত্র সেক্ষেত্রে নিশ্চুপ! কারণ, তাদের অন্য স্বার্থ সেখানে অনেক বড়। এই অঞ্চলের ভূ- রাজনীতিতে ভারত এখন নেতৃত্ব দেওয়ার কাছে পৌঁছে গেছে। আগামীতে যদি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারে ভারত, তাহলে হয়তো তাদের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভ করা সহজ হবে। চীন ভারতের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণে আগামীতে তাও ঘটতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ভারতের সংবিধান অথবা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ গঠনতন্ত্র দেশগুলোকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিচ্ছে। একটি দুর্বল সংবিধান কখনো গণতান্ত্রিক চর্চাকে শক্তিশালী করে না, কিংবা সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নকেও সহায়তা করে না। বাংলাদেশের সংবিধান এককেন্দ্রিক সংবিধান। আমাদের সংবিধান রচনাকাল থেকেই ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে। ক্ষমতার সবটাই এককেন্দ্রিক, যার প্রতিফলন আমরা প্রতিসময় দেখছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র থেকে আমরা কিছু শিখছি না। বহির্বিশ্বের তার আত্মকেন্দ্রিক আচরণকে নিয়েই আমরা ব্যস্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা থেকে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেরই অনেক কিছু শেখার আছে।
    

 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.