অর্থ ব্যবস্থাপনার ৫০, ৩০, ২০ নীতি, যা আপনাকে দ্রুত সচ্ছল করবে।
অর্থ ব্যবস্থাপনার ৫০, ৩০, ২০ নীতি মেনে চললে আশা করি আপনি আপনার অর্থ দ্রুতগতিতে বাড়তে দেখবেন। আমি আলোচনা করব অর্থ ব্যবস্থাপনার পঞ্চাশ, তিরিশ, বিশ নীতি সম্পর্কে। আমি জানি আপনারা অনেকেই এই নীতি সম্পর্কে আগেও শুনেছেন। তবু আমি মনে করি এই নীতির প্রকৃত অর্থ কী এবং কীভাবে এই নীতি ব্যবহার করা যায়, সেই বিষয়গুলো ভালোভাবে জানলে ও মেনে চললে আপনি আপনার ফিনান্সিয়াল টার্গেট অর্জন করতে পারবেন সহজে।
পঞ্চাশ, তিরিশ, বিশ নীতিটি খুব জনপ্রিয় একটি নীতি তাদের জন্য যারা সময়ের অভাবে নিজেদের খরচগুলোর হিসাব রাখতে পারছেন না। খরচের হিসাব রাখার জন্য, অর্থ সঞ্চয়ের জন্য এবং অর্থ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সহজ ও সাবলীল পদ্ধতি হচ্ছে এই নীতি। আপনার খরচকে আপনি তিন ভাগে ভাগ করবেন। এক ভাগ হচ্ছে আপনার প্রয়োজন বা নিডস, দ্বিতীয় ভাগ হছে আপনার ওয়ান্টস আর তৃতীয় ভাগ হচ্ছে মূলত আপনার সঞ্চয়।
একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটাকে একটু পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। ধরুন, একজন ভদ্রলোক যার সামগ্রিক মাসিক আয় মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা, তিনি এই নীতি ব্যবহার করে যেভাবে তার আয়কে ভাগ করবেন সেটা হলো, পঞ্চাশ ভাগ বা ২৫ হাজার টাকা যাবে তার প্রয়োজন বা নিডসের পেছনে, তিরিশ ভাগ বা ১৫ হাজার টাকা যাবে তার ওয়ান্টসের পেছনে আর বিশ ভাগ বা ১০ হাজার টাকা যাবে তার সঞ্চয় বা ঋণ পরিশোধের পেছনে ব্যবহার। তার মতো আপনাদেরকেও আপনাদের মোট আয়কে এভাবেই তিন ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। এবার চলুন একটু গভীরে ধাপে ধাপে আলোচনা করা যাক।
ধাপ এক, আপনার প্রয়োজনকে সীমাবদ্ধ করে ফেলুন। এই ক্যাটাগরিতে শুধু সেইসব জিনিসই আসবে (নিডস) যেগুলো ছাড়া আপনি কোনোভাবেই চলতে পারবেন না। যেমন খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, বাবা-মায়ের পেছনে খরচ ইত্যাদি। মৌলিক চাহিদার বাইরে বিশেষ কোনোকিছু এই ক্যাটাগরিতে আসবে না। আপনার যদি এই খাতের জন্য বাজেট তৈরি করা না হয়ে থাকে, তবে এখনই উত্তম সময় বাজেট তৈরি করার। ওয়ারেন বাফেট বলেন, 'যদি আপনার এই খাতের খরচ পঞ্চাশ ভাগের বেশি হয়, তাহলে ধরে নেবেন কোথাও আপনার অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। যা আপনাকে অনুসন্ধান করে কমাতে হবে।'
ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভালোভাবে আপনার খরচগুলো পর্যবেক্ষণ করুন। দেখুন, কোন নির্দিষ্ট খাতে আপনার ব্যয় সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। সেগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করুন। ওই নির্দিষ্ট কাজে খরচ কমানোর বিকল্প পথ খুঁজে বের করুন। অপ্রয়োজনীয় খরচগুলো বাদ দেওয়ার চেষ্টা করুন। দেখবেন, এই খাতে আপনার খরচ ক্রমশ কমে এসেছে। আপনার খরচ পঞ্চাশ শতাংশের মধ্যে থাকলেই আপনি দ্বিতীয় ধাপে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন।
ধাপ দুই, এই ধাপে আপনার ওয়ান্টসগুলোর পেছনে আপনি খরচ করতে পারবেন। সেজন্য ওয়ান্টস কী সেটা বুঝতে পারা আপনার জন্য জরুরি। ওয়ান্টস হচ্ছে সেইসব জিনিস যেগুলো আপনার মৌলিক চাহিদা নয় কিন্তু আপনার জীবনে ভ্যালু অ্যাড করে। যেমন টেলিভিশন, ঘড়ি, ব্র্যান্ডেড জিনিসপত্র, গাড়ি ইত্যাদি। আপনার আয়ের তিরিশ শতাংশ যাবে এই খাতে। আপনার মনে হচ্ছে, আপনার চাহিদাগুলো পূরণ করার জন্য আপনার কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ রয়েছে। আপনি হয়তো মনে মনে নতুন একজোড়া জুতা কিংবা নতুন একটা ফোন কেনার কথা ভাবছেন। আপনি হয়তো একটা নতুন ফোন ছাড়া চলতে পারছেন, কিন্তু কিনতে চাইছেন। এগুলো হচ্ছে আপনার ওয়ান্টস। দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে এইসব খরচ আসবে। আশা করি এবার বুঝতে পেরেছেন। মাঝে মাঝে আপনার নিডস ও ওয়ান্টসের মধ্যে পার্থক্য বের করতে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু একটি অতি সাধারণ থিওরি মেনে চললে সেই সমস্যাও আশা করি হবে না। আর সেটা হলো রুল অভ থাম্ব, অর্থাৎ যেকোনো জিনিস সম্পর্কে আপনার আগে ভাবতে হবে যে আপনি এটা ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবেন কি না। যদি বেঁচে থাকতে পারেন, তবে সেটা আপনার ওয়ান্টস নয়।
তৃতীয় ধাপ, আপনার আয়ের বিশ শতাংশ যাবে সেভিংস ও ঋণ পরিশোধের জন্য। যদি আপনার ঋণ থেকে থাকে তাহলে আপনি ঋণ পরিশোধ করবেন। এই খাতে সাধারণত ইমারজেন্সি ফান্ড, নতুন বাসা কিংবা গাড়ি কেনার জন্য সঞ্চয় অথবা অবসর জীবনের জন্য অর্থ সঞ্চয় করা ইত্যাদি আসবে এবং ঋণ পরিশোধ করতে যে অতিরিক্ত টাকা লাগবে সেটাও আসবে। যদি আপনার মনে হয় যে বিশ শতাংশ এই খাতের জন্য কম, তাহলে আপনি আপনার ওয়ান্টস-এর লিস্ট থেকে কিছু আইটেম কমিয়ে সেই টাকা এখানে ব্যবহার করতে পারেন।
এখন কথা হচ্ছে, কোন ধরনের ঋণ এই খাতে আসবে? মন্দ ঋণের মিনিমাম রিকয়ার্ড পেমেন্টের বেশি যা কিছু আছে, সব এই ক্যাটাগরিতে আসবে। যেমন ধরুন, অ্যাডিশনাল ক্রেডিট কার্ড পেমেন্ট। দেনা দ্রুত পরিশোধ করার জন্য কিস্তির অতিরিক্ত যে টাকা পরিশোধ করা লাগে, সেটাই এই খাতে আসবে। মিনিমাম ঋণের কিস্তি এই ক্যাটাগরিতে আসবে না, সেটা প্রয়োজন বা নিডসের অন্তর্ভুক্ত। কারণ মিনিমাম কিস্তির অতিরিক্ত যা কিছু আপনি দেন, সেটা না দিলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু দিলে আপনার ঋণ দ্রুত পরিশোধ হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে মিনিমাম কিস্তির অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে আপনার ক্রেডিট হিস্ট্রিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা মোটেই কাম্য নয়।
এই পঞ্চাশ, তিরিশ, বিশ নীতিটি আমাদের খরচের হিসাব রাখতে, অতিরিক্ত খরচের লাগাম টেনে ধরতে ও অর্থ ব্যবস্থাপনায় খুবই কার্যকর। এই পদ্ধতি বিশেষত যারা মিডল ইনকাম রেঞ্জের মানুষ তাদের জন্য। কারণ ধনীরা সাধারণত নিজেদের প্রয়োজনের পেছনে যুক্তিসংগত পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। আর্থিকভাবে অনেক বিপর্যস্ত মানুষও ফিনান্সিয়াল এক্সপার্টদের পরামর্শ অনুযায়ী এই নীতি অবলম্বন করেন এবং তারা ঋণাত্মক অবস্থা থেকে পুনরায় তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হন। তাই আর দেরি না করে আপনিও আজ থেকে এই নীতি নিজের জীবনে ব্যবহার শুরু করে দিন।
- লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট; ইউটিউবার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশীপ ইন্টারন্যাশনাল