রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান কোন পথে ?

মতামত

30 July, 2023, 05:45 pm
Last modified: 30 July, 2023, 06:23 pm
দেশের চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার বাইরেও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আমাদের উদ্বিগ্ন করে রেখেছে। আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নিয়ে যা বলা হয়, প্রকৃত চিত্র তা থেকে ভিন্ন।

বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে চলমান বিতর্কের অংশ হয়ে পড়ছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো। যেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচন-পূর্ব পরিবেশ পর্যবেক্ষণের জন্য সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসেন। তারা নির্বাচনের পরিবেশ বুঝতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কথা বলেছে, যার অংশ হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের সাথেও বৈঠক করেছে। 

বৈঠক শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, বৃটেনের ওয়েস্টমিনিস্টার স্টাইলের সরকারের নির্বাচন কীভাবে সম্পন্ন হয়? সেখানে কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়? প্রকৃতপক্ষে বৃটেনের নির্বাচন হয় নির্বাচিত সরকারের অধীনে হয়। বৃটেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন ব্যবস্থা নেই।

ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা যে আলোচনাটা তুললেন, তার চতুর্দিকের আঙ্গিকগুলো সম্পর্কে নিশ্চয় তাঁর সুস্পষ্ট ধারণা আছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বৃটেন নেতৃত্বদানকারী দেশ। দেশটিতে এখানও কোন লিখিত সংবিধান নেই (তবে এর কিছু অংশ লিখিত রয়েছে)। প্রথা ও ঐতিহ্যের উপর দাঁড়িয়ে পরিচালিত হয় দেশটি। 

সেখানকার আইনের শাসন অনুকরণীয়। কোভিডকালীন লকডাউনের সময় নিজ বাসায় এক নৈশপার্টির আয়োজন করে বরিস জনসনকে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদ ছাড়তে হয়েছিল।

বৃটেনের ওয়েস্টমিনিস্টার ব্যবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন কোন নির্বাচনের সুযোগ নেই। পার্লামেন্টের উভয়কক্ষ যদি  একমত হয়ে অন্তর্বর্তীকালের নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়- কেবল তখনই তা সম্ভব। ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় যেমন, সরকারের উপর অনাস্থা প্রস্তাবে সংসদে ভোটাভুটির মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করা যায়, এমন ব্যবস্থা বৃটেনে নেই। সরকার ব্যবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচনের বিধান না থাকায়, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ফলে সরকারের পতন হয় না। দলের মধ্য থেকে নির্বাচিত অন্য যে কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে পারেন, যেমন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক।

বৃটেনের জনগণের পুরোপুরি আস্থা তাদের বিচার ব্যবস্থার ওপর। ফলে নির্বাচন হোক বা অন্যান্য যেকোনো সামাজিক ইস্যু – যখন বিচার বিভাগ কোন সিদ্ধান্ত দেয়, তা মেনে নেয় জনগণ। সেখানকার বিচার ব্যবস্থায় এখনও জুরি-ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট এর ক্ষেত্রে একক সিদ্ধান্তের পরিবর্তে জুরিদের মতামতের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হয়। কোন ধরনের বিতর্ক নেই বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তের বিষয়ে। সে তুলনায়, আমাদের অবস্থান কোথায়? 

বৃটেনের জায়গায় যেতে হলে অনেক কিছুই সংস্কার করতে হবে। বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে পরিপূর্ণ স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে, পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন ইমরান খানকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছে। সেখানকান নির্বাচন কমিশনকে সে ক্ষমতা দেওয়া আছে। 

বাংলাদেশের প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দল পরস্পর-বিরোধী এক অনড় অবস্থা তৈরি করে। ঘোর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে দেশ। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ১৯৯৫ ও ২০০৬ সালের নির্বাচনের আগে আজকের ক্ষমতাসীনরা বিতর্কের অন্য প্রান্তে ছিলেন। রাজপথে জোর আন্দোলন করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার দাবি আদায় করেছিলেন। বহু মানুষ জীবন দিয়েছে। আন্দোলনের সময়ে মানুষ কাজ হারায়। গভীর সংকটে পড়ে ব্যবসায়ীরা। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি হয়। তারপরও মানুষ আশায় বুকবাঁধে, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যদি কোন উন্নয়ন ঘটে।

রাজনৈতিক অনড় অবস্থানের পরিণতি এদেশের মানুষ ২০১৪ ও ১৮ এর নির্বাচনের সময় প্রত্যক্ষ করেছে। ব্যাপক জান-মালের ক্ষতির মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচন – দেশের ভেতরে বা বাইরে কম গ্রহণযোগ্যতা পায়। সেই দায়ভার ক্ষমতাসীনদের বহন করতে হচ্ছে – যা বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে আমাদের নির্বাচনকালীন সরকার, নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে আদ্যপান্ত নিয়ে কথা বলবার অবাধ সুযোগ করে দিয়েছে। 

দেশের চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার বাইরেও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আমাদের উদ্বিগ্ন করে রেখেছে। আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নিয়ে যা বলা হয়, প্রকৃত চিত্র তা থেকে ভিন্ন। আইএমএফ সরকারের দেওয়া হিসাব মানেনি। আইএমএফ এর দেওয়া পদ্ধতি অনুযায়ী একটা হিসাব আমরা পাই, যা সরকারের দেওয়া হিসাব থেকে অনেক কম। 

তীব্র ডলার সংকটে পড়া পাকিস্তানকে ৩০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার বিষয়ে আইএমএফ সম্মত হয়েছে। তাদের এক মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মত ডলার সেদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ছিল না। ৩ বিলিয়ন ডলারের এই ঋণ হয়ত পাকিস্তানকে সাময়িক স্বস্তি দিবে। কিন্তু, সাধারণ মানুষ এর সুফল কতটা পায়- তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ এগিয়ে এসেছে। চীন তার লগ্নীকৃত সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার ফেরত দেওয়ার সময়সীমা বাড়িয়েছে। বর্ধিত সময়ের সুদের বোঝা যদিও আরো বাড়তে থাকবে। দেশটির অভ্যন্তরে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রায় সকল পণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী।

বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের সংকট আবার ২০০৬ এর জায়গায় ফিরে এসেছে। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়লেও, মৌলিক জ্বালানি নিরাপত্তায় আমরা পিছিয়েছি অনেক। আমাদের তেল-সম্পদ নেই, এক অজানা কারণে গ্যাস অনুসন্ধান বন্ধ দীর্ঘদিন। নানান জটিলতায় খুব সীমিত আকারে কয়লা উত্তোলন হয়। প্রায় শতভাগ আমদানি-নির্ভর জ্বালানি দিয়ে চলছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। তীব্র সংকটের মুখে আছে সাধারণ উৎপাদন ব্যবস্থা। বিঘ্নিত হচ্ছে দেশের শিল্প খাতের বৃহত্তম অংশ টেক্সটাইল। এ খাতে উৎপাদন ব্যবস্থা গভীর বিপর্যয়ে। একদিকে তুলা আমদানির ক্ষেত্রে ডলার, সংকট অন্যদিকে তেল-গ্যাসের অভাবে মিলগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তাই এই মুহূর্তে নিরপেক্ষ নির্বাচন-ই একমাত্র নয়, পাশাপাশি আরো অনেক বিষয়- দেশের জন্য বেশ জরুরি।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.