'বিলিয়ন ডলার হাইস্ট': এরপর কোন ইস্যু সিনেমা হয়ে আসবে?

মতামত

22 July, 2023, 01:50 pm
Last modified: 22 July, 2023, 01:57 pm
দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে এখন আশঙ্কা হচ্ছে আবার কোন ইস্যু নিয়ে, কোন পরিচালক ঝাঁপিয়ে পড়বেন সিনেমা নির্মাণ করতে। ইউনিভার্সাল পিকচার্স যেমন পুরো একটা প্রামাণ্যচিত্র বানিয়ে ফেলেছে, তেমনি হয়তো দুবাইয়ের গোল্ডেন ভিসা বা বিশ্বের ধনী তালিকায় বাংলাদেশিদের নাম নিয়ে কোন মুভি তৈরি হয়ে যেতে পারে। এরকম মুভি কি বাংলাদেশের জন্য গৌরবের হবে, নাকি লজ্জার?
বিলিয়ন ডলার হাইস্ট-এর পোস্টার

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘটনা হলিউডে জায়গা করে নিল! এতে কিন্তু আমাদের খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। দেশের ভয়াবহ যে চুরির ঘটনা আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম, হলিউড সেই ঘটনাকেই বেছে নিয়েছে তথ্যচিত্র বানানোর জন্য। হলিউডি মুভি মানে বিশ্বের সকল মানুষের সামনে তা নানামাধ্যমে প্রদর্শিত হবে। আমাদের পুরোনো লজ্জা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এই অপরাধের সাথে বাংলাদেশের নাম বারবার উচ্চারিত হবে, যা আমাকে এবং আমার মতো অসংখ্য সৎ মানুষকে নিঃসন্দেহে লজ্জিত করবে।

একদল হ্যাকার বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করেছিল সেই ২০১৬ সালে। হ্যাকারদের সামান্য একটি ভুল টাইপের কারণে আরও বেশি অর্থ হাতিয়ে নেওয়া থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই বিস্ময়কর গল্পটি এবার উঠে এসেছে সিনেমার পর্দায়। 

ইতোমধ্যেই এই চুরিদারির সিনেমা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত 'বিলিয়ন ডলার হাইস্ট' তথ্যচিত্রটি আমাদের মনে করিয়ে দিবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা কতটা বাস্তব ছিল এবং সেই ঘটনা কিভাবে সাইবার অপরাধীদের পথ দেখিয়েছিল। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা সারা বিশ্বকে এতটাই ধাক্কা দিয়েছিল যে এর পরপরই সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞরা খুব সতর্ক হয়ে উঠেছিলেন। কীভাবে হ্যাকাররা 'সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন ব্যাংকিং সিস্টেম' ব্যবহার করতে সক্ষম হয় তা 'বিলিয়ন ডলার হাইস্ট' তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে। নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরির ঘটনা ঘটে। চুরি হওয়া রিজার্ভের অন্তত ৮১ মিলিয়ন ডলার ম্যানিলাভিত্তিক আরসিবিসির অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে ফিলিপাইনের ক্যাসিনোগুলোতে সেগুলো ব্যয় করা হয়।

এরকম একটি বড় ধরনের অপরাধ বাংলাদেশে ঘটার পরও তেমনভাবে কেউ দায়ী হয়নি বা কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়নি। যদিও 'বিলিয়ন ডলার হাইস্ট' সিনেমার পরিচালক বলেছেন এ ধরনের সাইবার অপরাধ মহামারি বা গণবিধ্বংসী অস্ত্রের চাইতেও ভয়াবহ। কিন্তু আমরা চুপচাপ পার করেছি ৭ বছর। একটা মামলা করেছি, কিছু টাকার খোঁজ পেয়েছি। কিন্তু মূল তথ্য কেউ জানতে পারেনি। 

আমরা জানতে পারিনি এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি কম্পিউটারের দখল কীভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দুনিয়ার অপর প্রান্তে বসে থাকা অপরাধীদের কাছে চলে গেল। শুধু ধরে নেওয়া হয়েছে, এই কাজে ব্যবহৃত কম্পিউটারটির নিরাপত্তা অত্যন্ত দুর্বল ছিল। দেখা যাক এই সিনেমা বিশ্ববাসীর সামনে নতুন কোন তথ্য দিতে পারে কিনা।

বাংলাদেশে হঠাৎ হঠাৎ এমনই সব ঘটনা ঘটে, যা বিশ্বকে অবাক করে দেয়। ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরির ঘটনা এতটাই সাড়া জাগালো যে হলিউডি মুভি তৈরি হয়ে গেল। জানতে ইচ্ছা করছে এরপর কোন ইস্যু নিয়ে সিনেমা তৈরি হতে পারে? 

হয়তোবা এরপর সিনেমা তৈরি হবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাড়ি কেনায় বাংলাদেশিদের বিপুল বিনিয়োগ নিয়ে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২১ সালে জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশিরা দুবাইয়ে ২৮৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে জমি-বাড়ি কিনেছেন। দুবাইয়ে অন্যান্য যেসব দেশের মানুষ জমি-বাড়ি কিনেছেন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা সবার আগে। প্রশ্ন জাগে- কিভাবে এটা সম্ভব হয়েছে? কেমন করে বাংলাদেশের মতো ঋণনির্ভর একটি দেশের কিছু মানুষ বিশ্বের ধনী তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছেন?

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সিএডিএস) তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে সম্পত্তি কিনেছেন ৪৫৯ জন বাংলাদেশি। যারা দেশের মানুষকে ঠকিয়ে এসব সম্পদ কিনেছেন তাদের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও আমলা। 

গত এক দশক ধরে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১৪.৩ শতাংশ হারে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা সংস্থা। এক্ষেত্রে বিশ্ব তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে। সংস্থাটি বলেছে যাদের সম্পদের পরিমাণ ৫০ লাখ ডলারের বেশি, তাদের নামই এখানে এসেছে। 

বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজরা নিজ দেশের বারোটা বাজিয়ে এত টাকা পাচার করেছেন যে, বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দার মধ্যেও দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট খাতের বিদেশি প্রপার্টি ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা ছিল শীর্ষে। এদিক থেকে নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, চীন ও জার্মানির মতো দেশগুলোর বাসিন্দাদের পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশিরা। আশঙ্কা করা যায়, হয়তো ভবিষ্যতে এই ঘটনা নিয়েও কোন মুভি তৈরি হবে। 

বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার রোধে কোনো ব্যবস্থা নেয়না সরকার। অডিট আপত্তি উঠলেও পাত্তা দেওয়া হয়না। কোনরকম জবাবদিহিতা না থাকায় এইদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা অনায়াসে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। সরকার যেহেতু এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না, তাই ধরে নেওয়া যায় এর সাথে যে চক্রটি জড়িত, তারা সরকারের চাইতেও শক্তিশালী।

দেশের ব্যাংক পরিচালক, আমলা, রাজনীতিবিদ, পোশাক ব্যবসায়ী, ঠিকাদারসহ দেশের বড় ও মাঝারি অনেক পুঁজিপতিই এখন আমিরাতের গোল্ডেন ভিসাধারী। তাদের মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল অংকের পুঁজি পাচার হয়েছে। এই অর্থ বৈধ পথে দেশ থেকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে তা অবৈধ পথেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। 

২০১৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত 'গোল্ডেন ভিসা' পদ্ধতি চালু করেছে, যেখানে কেউ ২০ লাখ দিরহাম (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৬ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করলে বা আমিরাতের কোনো ব্যাংকে জমা রাখলে তাকে দশ বছরের জন্য কোনো প্রশ্ন ছাড়া আমিরাতে অবাধে প্রবেশের ভিসা প্রদানের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এ গোল্ডেন ভিসার সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সংখ্যক ব্যবসায়ী সাড়ে তিন বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার পাশাপাশি দুবাইয়ে পুঁজি পাচারকে আকর্ষণীয় বিষয় হিসেবে বেছে নিতে শুরু করেছেন। 

আরব আমিরাত বহুদিন থেকেই বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বড় পুঁজিপতিদের কাছে আকর্ষণীয় ব্যবসা ক্ষেত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। আমিরাত থেকে বাংলাদেশে প্রেরিত রেমিট্যান্সের সিংহভাগ হুন্ডি ব্যবসায়ীরাই দখলে নিয়ে নিয়েছেন বহুদিন ধরে। এর মানে হুন্ডি ব্যবস্থার সহায়তায় বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের নানা দেশে পুঁজি পাচারকারীদের একটা বড় অংশই আমিরাত-বাংলাদেশ রুটে হুন্ডি ব্যবসা পরিচালনাকারীদের 'সার্ভিস' নিতে দীর্ঘদিন ধরে অভ্যস্ত। 

এ পর্যায়ে উল্লেখ্য যে, কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন প্রায় অর্ধেক রেমিট্যান্স এখন হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে আসছে। কিন্তু যে হুন্ডি ডলার বিদেশেই রয়ে যাচ্ছে সেগুলো প্রধানত কিনছে পুঁজি পাচারকারীরা। এই হুন্ডি ডলারের সহায়তাতেই বিদেশে গড়ে উঠছে প্রবাসীদের ঘরবাড়ি, ব্যবসাপাতি, টরন্টোর বেগমপাড়া কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমগুলো। অবশ্য গত সাড়ে তিন বছরে দুবাই ক্রমেই বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য পুঁজি পাচারের ক্ষেত্রে 'মারাত্মক বিপজ্জনক' হয়ে উঠছে। এই মন্তব্যগুলো করেছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম।

অসাধু ব্যবসার মাধ্যমে বাংলাদেশের কিছু মানুষ ফুলেফেঁপে উঠলেও, দেশ কিন্তু বিপদের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, অনেক দেশে মূল্যস্ফীতির নিম্নগতি হলেও, বাংলাদেশে এই চাপ কমার কোনো লক্ষণ নেই। এরমধ্যেই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে টাকা ধার দিতে নতুন টাকা ছাড়ছে, যেটি মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দেওয়ার একটি কারণ হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি জুলাই মাসের প্রথম ১৮ দিনের তথ্যে দেখা গেছে, সরকারি ব্যয়ের চাহিদা মেটাতে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বাজারে ছেড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

পত্রিকার রিপোর্ট বলছে রাজস্ব ঘাটতির যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল, আদতে ঘাটতি হয়েছে তারও বেশি- প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। প্রত্যাশা অনুযায়ী, বৈদেশিক সহায়তা না পাওয়ার কারণে বাজারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকার সরবরাহ বাড়াতে হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা ধার নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। 

যদিও অর্থনীতিবিদরা টাকা ছাপানোকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বিপরীত পন্থা বলে মনে করছেন। তারা টাকা না ছাপিয়ে এই অবস্থায় সরকারকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু পরামর্শ গ্রহণ করার মতো মানসিক অবস্থা কি কর্তৃপক্ষের রয়েছে? 

দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে এখন আশঙ্কা হচ্ছে আবার কোন ইস্যু নিয়ে, কোন পরিচালক ঝাঁপিয়ে পড়বেন সিনেমা নির্মাণ করতে। ইউনিভার্সাল পিকচার্স যেমন পুরো একটা প্রামাণ্যচিত্র বানিয়ে ফেলেছে, তেমনি হয়তো দুবাইয়ের গোল্ডেন ভিসা বা বিশ্বের ধনী তালিকায় বাংলাদেশিদের নাম নিয়ে কোন মুভি তৈরি হয়ে যেতে পারে। এরকম মুভি কি বাংলাদেশের জন্য গৌরবের হবে, নাকি লজ্জার?

অলংকরণ: টিবিএস
  • লেখক: যোগাযোগকর্মী 

বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.