শাস্তি ব্যবস্থায় তৃতীয় লিঙ্গ; জেলখানায় যে সেলে থাকেন তারা

মতামত

মো. সাইফুল ইসলাম
29 May, 2023, 04:45 pm
Last modified: 29 May, 2023, 04:53 pm

এজলাসে ওঠার আগে ফোনটা অবিরাম বাজছে। সাধারণত এই সময়টাতে কারো ফোন রিসিভ করি না। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করি। দেখলাম কলার আমার সাবেক কর্মস্থলের প্রবেশন অফিসার। বেঞ্চ সহকারীকে ফোনটা দিয়ে বললাম, কলার যেন বিকেলে ফোন করে। বেঞ্চ সহকারী কথা বলে জানালেন, প্রবেশন অফিসারের সাথে একজন আসামী আছেন যিনি আমার সাথে কথা বলতে চান। বিকেলে ফোন দেবেন বলেছেন।

সম্প্রতি উত্তর-পশ্চিমের একটি জেলা থেকে আমার রাজশাহীতে বদলি হয়েছে। এখানে আসার প্রায় দুই মাস হলো। বদলির দু'মাস পর কী কথা থাকতে পারে একজন অপরাধীর সাথে! বিষয়টি আমলে না নিয়ে দ্রুত এজলাসে উঠলাম। বিচারকাজ শেষে আমিই কল ব্যাক করলাম। 

—হ্যালো...আসসালামু আলাইকুম! 
—ওয়ালাইকুম আসসালাম, স্যার। X থেকে প্রবেশন অফিসার বলছি। সাদু আপনার সাথে কথা বলতে চায়। 
-—না, না, একজন অপরাধীর সাথে বিচারক ফোনে কথা বলতে পারেন না। 
—এক মিনিট কথা বলবে স্যার। একটা সুখবর আছে। আপনার কাছে দোয়া নিতে চায়...

মনে পড়ে গেল দেড় বছর আগের কথা। মেয়েদের মতো লম্বা চুলওয়ালা সাদুর বিরুদ্ধে ভারতীয় মদ বিক্রির অভিযোগ। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড হয়েছে। 

মেয়েদের মতো বড় চুল হলেও সাদু মেয়ে নয়, আবার ছেলেও নয়। আমরা তাদের বলি হিজড়া, অকুয়া, চিন্নি ইত্যাদি। আর আধুনিক যুগে বলি তৃতীয় লিঙ্গ, ট্রান্সজেন্ডার।

জ্ঞান হওয়ার পর সাদু দেখেছে সে সবার চেয়ে আলাদা। শুধুমাত্র শারীরিক আকৃতির কারণে সাদুকে ছোটবেলা থেকে স্কুলে, গ্রামে পদে পদে কটাক্ষ, তাচ্ছিল্য ও উপহাস সহ্য করতে হয়েছে। বয়ঃসন্ধিকালে সে জেনেছে সরকারি জরিপে তার জেলায় তার মতো আরও ৩৬ জন হিজড়া আছে। 

রায়ের আগে আসামী পরীক্ষার দিনে তার বক্তব্য গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। সেদিন সাদু একটা সাদা পাঞ্জাবী আর জিন্সের প্যান্ট পরেছেন। গায়ে একটা রঙিন শাল জড়ানো। দেখে মনে হচ্ছে কলেজপড়ুয়া মেয়ে। তবে তিনি এতদূর পড়েননি। বয়স যখন ছয়, তখন বাবাকে হারিয়েছেন। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর আর পড়া হয়ে ওঠেনি।
 স্কুলজীবনে প্রথম প্রথম বুলিং করলেও একসময় বন্ধুরা তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ক্রমাগত সামাজিক বঞ্চনা আর নিগ্রহের শিকার হতে হতে এক সময় হিজড়া দলে যোগ দেন সাদু। গ্রামে গ্রামে পালাগান করে, বিভিন্ন স্থানে মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন।

সাদু ভাগ্যবান। অন্য হিজড়াদের মতো তার মা তাকে পরিত্যাগ করেননি। মায়ের আদর-ভালোবাসা পেয়েছেন। মা অসুস্থ হওয়ায় তিনি এখন হিজড়া আস্তানা ছেড়ে মায়ের সাথে থাকছেন।

জিজ্ঞেস করলাম, "চাঁদাবাজি করেন কেন? মানুষ তো খুব বিরক্ত হয়।" সাদু বললেন,"মোক কাইয়ো কাম দেয় না। তাই খুজি-মাংগি খাই।"

তাই তো! আমরা সবাই তাদের অপরাধটা দেখি। কিন্তু কেন সে অপরাধটা করছে, তা ভাবি না। 

বিচারকালে তিন মাস কারাগারে ছিলেন সাদু। তাই কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলাম, কারাগারে পুরুষ সেল নাকি নারী সেল, কোনটিতে ছিলেন তিনি।

আমাদের কাছে বিষয়টি সাধারণ হলেও সাদুর কাছে মোটেও সুখকর নয়। সাদু প্রশ্ন এড়িয়ে যান। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, "স্যার, অগুলা কথা কন না আর...!" 

সাদুর দীর্ঘশ্বাস আমাকে গভীর ভাবনায় ফেলে দিল। 

২.
তৃতীয় লিঙ্গের অপরাধীরা কারাগারে কতটা বৈষম্যমূলক আচরণ ও হয়রানির শিকার হয় তার একটা বিবরণ পেয়েছিলাম কিরণ গাওলীর 'কিরণ-ই-দাস্তান' নামক বইয়ে। তিনি ভারতের নাগপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালে এই ডায়েরি লিখেছিলেন।

গ্রেফতারের পর ট্রান্সজেন্ডার কিরণ ভেবেছিলেন অন্য নারী অপরাধীর মতো তাকেও মহিলা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু তাকে কারাগারের মহিলা সেলে না রেখে পুরুষ সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। 

তার ভাষায়, "আমি একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তারা কীভাবে কল্পনাও করতে পারে যে একজন মহিলা পুরুষ কারাগারে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে?"

কিরণ কারাগারে থাকাকালে সাজাপ্রাপ্ত বন্দী, বিচারাধীন বন্দী, তার সাথে গ্রেফতার হওয়া অন্যান্য হিজড়া এবং জেলের কর্মচারীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে তাকে শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের অভিযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সুবিচার না পেয়ে লিখেছিলেন:

"যতবার আমরা আমাদের অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিলাম এবং মহিলাদের বিভাগে স্থানান্তরিত করার দাবি জানিয়েছিলাম, কারাপ্রধান আমাদের বলতেন যে কারাগারের নিয়মে এমন কোনো বিধান নেই। কিন্তু কোন নিয়মে আমাদের পুরুষ কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল?"

এভাবে হিজড়া অপরাধীরা যেটুকু সময় কারাগারে থাকছেন, পৃথকভাবে না থাকার কারণে প্রতি মুহূর্তে বন্দী হিসেবে তাদের অধিকার লংঘিত হচ্ছে। এক অপরাধের শাস্তি দিতে শত শত অপরাধের জন্ম হচ্ছে।


ভারতে ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়াদের অধিকার সুরক্ষায় ২০১৪ সালে একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। National Legal Services Authority v. Union of India, (2014) 5 SCC 438 (পরবর্তীতে নালসা মামলা লেখা হয়েছে) মামলায় মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট ভারতের তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়কে নারী বা পুরুষ নয়, নিজস্ব পরিচয় ধারণ করার অধিকার দিয়েছিলেন। আদালত 'ট্রান্সজেন্ডার', 'থার্ডজেন্ডার' নামে তাদেরকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নথিতে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন। 

নালসা মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায়ে আরও বলেন, সংবিধানে নাগরিকদের জন্য যে মৌলিক অধিকারের উল্লেখ রয়েছে তা তৃতীয় লিঙ্গের জন্যও প্রযোজ্য। এছাড়া শিক্ষা এবং চাকরির ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য অনগ্রসর শ্রেণী বিবেচনায় পদ সংরক্ষণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল।

নালসা মামলার রায়ের ধারাবাহিকতায় ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ২০১৯ সালে দ্য ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস (প্রোটেকশনস অব রাইটস) অ্যাক্ট পাশ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১০ জানুয়ারি হিজড়া কারাবন্দিদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের কারাগার সমূহে ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য পৃথক ঘের বা কারাকক্ষ করার নির্দেশনা দেন। তবে এটি করতে গিয়ে তাদের যেন সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন না করা হয় বা সামাজিকভাবে কলঙ্কিত না করে সে বিষয়েও দৃষ্টি রাখতে কারা কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। 

শুধু ভারতে নয়, এই উপমহাদেশের পাকিস্তানেও ২০১৮ সালে Transgender Persons (Protection of Rights) Act, 2018 পাশ হয়েছে এবং সম্প্রতি লাহোর হাইকোর্ট পাঞ্জাব সরকারকে প্রদেশজুড়ে সব কারাগারে ট্রান্সজেন্ডার বন্দীদের জন্য পৃথক সেল স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। 


কারাগারে ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের নজির বিভিন্ন দেশে আছে। ট্রান্সজেন্ডারর বন্দীদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ইতালি ২০১০ সালে প্রথম পৃথক কারাগার করার ঘোষণা দেয়। এটি ইতালির ফ্লোরেন্সের টাস্কান শহরের কাছে পোজালেতে অবস্থিত, যার ধারণক্ষমতা ৩০ জন। এটি এখন সারা বিশ্বে রোল মডেল। সম্প্রতি স্কটল্যান্ডেও ইতালির মতো এরূপ কারাগার করার দাবি করছেন সে দেশের মানবাধিকার কর্মীরা।

ভারতের নালসা মামলার মতো আমাদের দেশে হিজড়াদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের কোনো রায় আমি খুঁজে পাইনি। সেই মামলার মতো নির্দেশনার প্রয়োজনও হয়নি। বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালে তাদের 'তৃতীয় লিঙ্গ' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য পৃথক আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু কারা আইন, ১৮৯৪-এর ২৭ ধারানুসারে কারাগারে লিঙ্গের ভিত্তিতে নারী-পুরুষের জন্য পৃথক রাখার নির্দেশনা থাকলেও আজ পর্যন্ত কারাগারে হিজড়াদের জন্য আলাদা করে রাখার বিধান হয়নি। 

আধুনিক যুগে শাস্তির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরাধীকে সংশোধন করা। এই সংশোধন কারাগারে এবং কারাগারের বাইরে উভয় স্থানেই সম্ভব। পরিকল্পিত পুনর্বাসন কর্মসূচি অপরাধীকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করে সমাজের মূলধারায় ফেরাতে পারে। তবে কারাগারে হিজড়া অপরাধীকে রাখতে হলে অবশ্যই নারী ও পুরুষের মতোই পৃথকভাবে রাখতে হবে এবং আলাদা রেখেই প্রশিক্ষণ, বিনোদনমূলকসহ বিভিন্ন পুনর্বাসন কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে; যেন তারা নিজেদের বিচ্ছিন্ন না ভাবে।


সাদুর মামলার রায় প্রকাশ্য আদালতে ঘোষণা করা হলো। কিন্তু আমাদের তো ইতালির মত পৃথক ট্রান্স প্রিজন নেই। তাই ভাবছিলাম লঘু দণ্ডে দণ্ডিত সাদুকে কারাগারে না পাঠিয়ে শর্তসাপেক্ষে বাড়িতেই সংশোধনের সুযোগ, অর্থাৎ প্রবেশন সুবিধা দেওয়া যায় কি না। কিন্তু সাদুর অভিযোগপত্র উল্টে দেখলাম, তার বিরুদ্ধে আরও একটি মাদকের মামলা আছে। 

প্রবেশন আইন বলছে, একাধিক মামলা থাকা প্রবেশন প্রদানে প্রতিবন্ধক নয়। মাননীয় বিচারপতি ইমান আলী আব্দুল খালেক বনাম হাজেরা বেগম, ৫৮ ডিএল আর ৩২২ মামলায় অভিমত দেন যে, কেবল প্রথমবার অপরাধী (First offender) প্রবেশন পাবে, এটা ভুল ধারনা। এই বিধি-নিষেধ শুধু কন্ডিশনাল ডিসচার্জ পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

দণ্ডিত সাদুকে শর্তসাপেক্ষে এক বছরের জন্য কারাগারের পরিবর্তে প্রবেশনে মুক্তি দিলাম। শর্তগুলোর মধ্যে প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো ভিক্ষাবৃত্তি বা চাঁদাবাজি করা যাবে না। অন্যান্য শর্তগুলো হলো নতুন অপরাধ করা যাবে না, মাদক ব্যবসা করা যাবে না, মাদক সেবন করা যাবে না, দুইবার ডোপ টেস্ট করতে হবে, আদালতের নির্দেশমতো সরকারি বা বেসরকারি কর্মমুখী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে এবং শর্ত ভঙ্গ করলে স্থগিত সাজা ভোগের জন্য প্রস্তুত থাকবে।

তিন মাস পর অগ্রগতি প্রতিবেদন শুনানি। প্রতিবেদনে দেখলাম, সাদু এখন চাঁদাবাজি করেন না। পাড়ায় পাড়ায়, বাসে-ট্রেনে ভিক্ষা করেন না। 

জিজ্ঞেস করলাম, "তাহলে কী করেন এখন?" তিনি জানালেন, "মুই এলা মাটি কাটার কাজ করোছো। দিন ৩০০ টাকা মজুরি পাও।"

শুনে ভীষণ ভালো লাগলো। মনে হলো এটাই আমার বিচারিক জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। 

কিন্তু পরের তারিখে হতাশ হয়ে গেলাম। প্রবেশন অফিসার নেগেটিভ রিপোর্ট দিয়েছেন। বলেছেন, সাদু প্রবেশনের শর্ত ভঙ্গ করেছেন। তিনি ঈদের আগে আবারও মানুষের কাছে হাত পেতেছেন। চাঁদা তুলেছেন। 

প্রকাশ্য আদালতেই জিজ্ঞেস করলাম, অভিযোগ সত্য কি না। সাদু বললেন, "জি স্যার, কেছ সইত্য!"

আমি তাকে বললাম, "এমন করলে কিন্তু আপনার প্রবেশন আদেশ বাতিল হয়ে যাবে। কারাগারে শাস্তি ভোগের জন্য যেতে হবে।" 

এর উত্তরে তিনি যা বললেন, তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। "যদ্দিন মাটি কাটার কাম আছিলো তদ্দিন সেই কাম কচ্ছু। এলা মোর কোনো কাম নাই। কিন্তু মোর মাও আছে। মুই আছো। হামাক তো বাছির নাগিবে (বাঁচতে হবে) ।"

সাদুর এই কথা শোনার পর কীসের তার প্রবেশন বাতিল করব, একেবারে ১,২০০ ভোল্টের ধাক্কা খেলাম। প্রবেশন আইন ও বিধিমালা অনুসারে প্রবেশনারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রবেশন অফিসারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। প্রবেশন অফিসার সেটা করতে পারেননি। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে ভিক্ষা তোলার জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া সমীচীন নয়।

এবার প্রবেশন অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, তার জীবনমান উন্নয়নের জন্য কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? তিনি কোনো জবাব দিতে পারলেন না। নথি পর্যালোচনায় দেখলাম, সাদু মামলা চলাকালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন ৬ সপ্তাহের সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। 

প্রবেশন অফিসারকে নির্দেশ দিলাম, সাদুকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে। অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতি থেকে একটা সেলাই মেশিন উপহার দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বললাম। সেই সমিতির সভাপতি জেলা প্রশাসক। সেখানে কিভাবে আবেদন করতে হয় সেটা সাদুকে শিখিয়ে দিলাম। পাশাপাশি প্রবেশন অফিসারকেও। 

৬.
ইতোমধ্যে আমার সেই জেলা থেকে রাজশাহী বদলি হয়েছে। রাজশাহী আসার কয়েকদিন পর জানলাম সাদুকে জেলা প্রশাসক ডেকেছিলেন। বলেছেন, ভিক্ষা করা ছেড়ে দিলেই তাকে সেলাই মেশিন দেওয়া হবে। সাদু যেকোনো বন্ড দিতে প্রস্তুত। 

আজ সাদু সেই সেলাই মেশিন পেয়েছেন। গত ৯ মাসে তার বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা হয়নি। ডোপ টেস্টের ফলাফল অনুসারে প্রবেশনে মুক্তির পর আর মাদক সেবন করেননি। আজ সকাল থেকে তিনি সেখানকার প্রবেশন অফিসে বসে আছেন আমার সাথে কথা বলার জন্য। এজলাস থেকে নেমেই প্রবেশন অফিসারকে ফোন করেছি। তিনি সাদুকে ফোনটা ধরিয়ে দিলেন।

—আসসালামু আলাইকুম স্যার! 
— ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন আপনি?
—আলহামদুলিল্লাহ! ভালো আছো স্যার। 
—এখনও ভিক্ষা করেন নাকি?
—না স্যার। অফিস থাকি সেলাই মেশিন পাছু। এলা থাকি আর মাইনষেরঠে হাত পাতির নাগিবে না।

হঠাৎ মনে হচ্ছে আমার মোবাইলের ভলিউম কমে গেল। একটু পরে সাদু বললেন, —হামার জন্য দোয়া করিবেন স্যার।"

—নিশ্চয়ই দোয়া করব সাদু। আপনার জীবন অপরাধমুক্ত হোক। একটা সেলাই মেশিন থেকে ১০টা সেলাই মেশিন হোক। একটা কথা মনে রাখবেন, যে নিজেকে পরিবর্তনের চেষ্টা করে তাকে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং সাহায্য করে। 

পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে মানুষকে সংশোধন করা। আর এই সংশোধনের জন্য প্রয়োজন সদুপদেশ, সুযোগ আর সহানুভূতিশীল আচরণ। সাদুর মতো সারা জীবন ঘৃণিত, অবহেলিত ও বৈষম্যের শিকার প্রান্তিক মানুষগুলো যখন সামান্য সুযোগ ও সহানুভূতি পাবে, তখন নিশ্চয়ই তারা শুধরে যাবে। 


  • মো. সাইফুল ইসলাম: অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী
  • বি. দ্র.: সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। অপরাধীর নাম-ঠিকানা পরিবর্তন করা হয়েছে
  • [নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।]

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.