বাংলার বাঁওড়ের জীববৈচিত্র্য: জানার আগেই কি ধ্বংস হবে?
মতামত
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলদেশ ছোট দেশ হলেও এর জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার অনেক সমৃদ্ধ। আর এর একটি প্রধান কারণ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের বৈচিত্র্য। পুরো বাংলাদেশকে ২২টি বায়োইকোলজিক্যাল জোনে ভাগ করা হয়েছে এর ভূমিরূপ আর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অংশের উপর ভিত্তি করে।
জলাভূমি এদেশের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়। আর এই জলাভূমিকে কেন্দ্র করে রয়েছে বিচিত্র সব জলচর পাখ-পাখালির বসবাস। ২০১৫ বাংলাদেশের আইইউসিএন-এর লাল তালিকায় বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা ৩৯ প্রজাতির পাখির একটি বড় অংশের আবাসস্থল এই জলাশয়কেন্দ্রিক। আবার পরিযায়ী পাখিদের একটি বড় অংশের আগমন ঘটে এই জলাশয়গুলোকে কেন্দ্র করে। বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ, অমেরুদণ্ডী প্রাণী, মাছ, উভচর, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রাণীর একটি বড় অংশ বাঁওড়কেন্দ্রিক। তাই সব ধরনের জলাশয় সংরক্ষণ পাখি ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের জলাভূমির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হলো বাঁওড়। হাওরের সাথে সবাই পরিচিত হলেও, আমরা বাঁওড় সম্পর্কে তেমন অবগত নই। এমনকি বাঁওড়ের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না।
পৃথিবীর মোট স্থলভাগের ছয় শতাংশ এলাকা এই বাঁওড় (ইংরেজিতে Oxbow Lake)। বোঝাই যাচ্ছে পৃথিবীতে এই বাঁওড়ের গুরুত্ব কতটা। আর এই বাঁওড় হাজারো জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল। নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে অশ্বক্ষুরাকৃতির জলাশয় তৈরি হয়, যা বাঁওড় নামে পরিচিত। ঋতুর পরিবর্তনে পানির পরিমাণ কম-বেশি হয়। বাংলাদেশের গঙ্গা-নিম্নবর্তী অঞ্চলে ছোট-বড় মিলে ৮৭টি বাঁওড় রয়েছে। আর আমাদের দেশের মোট আয়তনের ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর এলাকা এই বাঁওড়ের অন্তর্ভুক্ত।
যশোর, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা এবং খুলনা অঞ্চলে এই বাঁওড়গুলোর অবস্থান। বালুহর, বেরগোবিনোদপুর, মরজাত, জয়দিয়া, ফাতেপুর উল্লেখযোগ্য বাঁওড় হিসাবে পরিচিত। এসব বাঁওড়ে যেমন রয়েছে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের বৈচিত্র্য, ঠিক তেমনি এই বাঁওড়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখপাখালি, স্তন্যপায়ী প্রাণীর সমাহার। রয়েছে শামুক, ঝিনুক, প্রজাপতিসহ বিভিন্ন অমেরুদণ্ডী প্রাণীর এক বিশাল সমাহার। পরিযায়ী পাখিদের এক গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল এই বাঁওড়গুলো।
বিগত ২০২০ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান, মো. মাহাবুব আলম এবং ফজলে রাব্বির অধীনে বাংলাদেশের ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, ফরিদপুরের বিভিন্ন বাঁওড়ে জীববৈচিত্র্যের উপর দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করার সুযোগ হয়েছে।
বর্ষায় কানায় কানায় পূর্ণ বাঁওড় শুষ্ক মৌসুমে অনেকটা শুকিয়ে যায়। বর্ষাকালে নানা প্রজাতির শাপলাসহ বিভিন্ন ভাসমান উদ্ভিদে পরিপূর্ণ থাকে বাঁওড়। ভাসমান পাতার ফাঁকে জলময়ূর, কলপিপি, ডাহুক, কোড়ার ছোটাছুটি এক অদ্ভুত মনোরম দৃশ্য। সবুজ ব্যাঙ, কোলা ব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ, মুরগি ডাকা ব্যাঙ, লাউ বিচি ব্যাঙ, কটকটি ব্যাঙ, ঝিঁঝি ব্যাঙসহ প্রায় ২০ প্রজাতির ব্যাঙের দেখা মেলে এই বাঁওড়গুলোতে।
আছে সরীসৃপ-জাতীয় প্রাণীও। বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর এবং নির্বিষ সাপ, গিরগিটি, অঞ্জন, গুইসাপ, তক্ষকসহ বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপের দেখা মেলে এখানে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, অবৈধভাবে কচ্ছপ ধরার কারণে কচ্ছপের সংখ্যা এবং মানুষ-সাপ সংঘাতের কারণে সাপের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছে এখানে।
শীতে পানি কমে গেলে, জলজ উদ্ভিদগুলোর নিচে তৈরি হয় পাখিদের খাদ্যের এক অপূর্ব ভান্ডার। ঝাঁকে ঝাঁকে আসে পাখিরা।
বাঁওড়ের পাখিদের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন প্রজাতির দেশি ও পরিযায়ী বুনো হাঁস। সরালি, বালিহাঁসের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে শীতে যখন পাখি কমে যায়, তখন সরালি আর বালিহাঁস দুটোই বাড়ে। ঝাঁকে ঝাঁকে শত শত সরালি উড়ে বেড়ায় এখানে।
তখন আসে পরিযায়ী বুনোহাঁস—যেমন: মৌলভী হাঁস, পিয়াং হাঁস, তিলী হাঁস, ভূতি হাঁসসহ আরও অনেকে। ডুবুরি বাঁওড়ের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ পাখি। ঝাঁকে ঝাঁকে ডুবুরি ভেসে বেড়ায় এখানে, আর শীতে সংখ্যায় বাড়ে অনেক বেশি। এছাড়া বড় পানকৌড়ি উল্ল্যেখযোগ্য এক পাখি। ডাহুক, ঝিল্লি, গুড়গুড়ি, পাতি পান মুরগি, পাতি কুট, চ্যাগা, কোড়া কালেমসহ বিভিন্ন পাখির জলজ উদ্ভিদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ।
বাঁওড়ের শিকারি পাখিদের মধ্যে আছে হ্যারিয়ার ঈগল, বাজ, মধুবাজ, চিল, পেঁচা, মাছ-মুড়াল, শিকরাসহ আরও নানান বৈচিত্র্যের পাখি।
এখানকার পাখিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির বগা-বগলা, শামুকখোল, কাস্তেচরার মতো পাখিরা। এদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি জলাশয়ের সুস্থতাই নির্দেশ করে। আছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙাদের বিচরণ।
জালময়ূরের চোখজুড়ানো ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ানো, জল পিপিদের উড়াউড়ি মিলিয়ে পাখিদের অপূর্ব এক স্বর্গরাজ্য এই বাঁওড় অঞ্চল।
জল ও স্থল মিলিয়ে প্রায় আড়াইশ প্রজাতির পাখির এক অপূর্ব সৌন্দর্য দক্ষিণের বিভিন্ন বাঁওড়ে। দিন-মাস-ঋতু বদলায়, সাথে সাথে পরিবর্তন হয় পাখিদের বৈচিত্র্যের। গ্রীষ্মে ডাকে কোকিল তার মায়বী কন্ঠে, অলস দুপুরে। নীল লেজ সুইচোরের গর্তে বাসা তৈরি করা থেকে ডিম পাড়া সব এই সময়েই। বর্ষায় বাঁওড় ফিরে পায় ভরা যৌবন। এভাবে দিন ঋতুর পরিক্রমায় চলে সৌন্দর্য আর জীবনের রঙের অপূর্ব মিতালি।
তবে পাখি শিকারের ফাঁদ, পাখি শিকার, অবৈধ বিক্রি এখানকার পাখিদের অন্যতম বড় সমস্যা, যা ক্রমাগত কমিয়ে দিচ্ছে পাখিদের সংখ্যা। এছাড়া দিন দিন বাড়ছে পর্যটকদের আনাগোনা। অসচেতনভাবে তারা বাঁওড়ের পাখিদের বিরক্ত করছে। কখনও কখনও শিকারও করছে।
বাঁওড়কে কেন্দ্র করে এখনও রয়েছে মেছোবিড়ালের উপস্থিতি। রয়েছে ছোট মাংসাশী স্তন্যপায়ী প্রাণী (পাতি শিয়াল, খেঁকশিয়াল, খাটাশ, বাগডাশ, ভাম, বেজি ইত্যাদি) বুনো খরগোশ, কাঠবিড়ালি, সজারু, বাদুড়, চামচিকাসহ অসংখ্য স্তন্যপায়ী প্রাণী।
বাঁওড়গুলো জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হিসাবে বিবেচিত বিশেষ করে জলচর পাখিদের। এদের সংরক্ষণে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। স্থানীয় মানুষদের এ বিষয়ে আরও সচেতন করতে হবে। বাঁওড়ের জলাশয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ যেন সুস্থ থাকে সেদিকে নজর রাখতে হবে। কারণ এই বাঁওড়ের জীববৈচিত্র্য যে শুধু পরিবেশ ও প্রতিবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তা নয়, রাখছে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদন।
বাংলাদেশের বাঁওড়ের জীববৈচিত্র্য সবার কাছে ততটা পরিচিত নয়। এখানে জীববৈচিত্র্য-সংক্রান্ত গবেষণাও একেবারে নগণ্য। কিন্তু মানবসৃষ্ট কারণে বাঁওড়ের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে জানার আগেই হয়তো হারিয়ে ফেলব বৈচিত্র্যে ঘেরা এই জীববৈচিত্র্যকে।
- লেখক: বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, সিইজিআইএস, বাংলাদেশ
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.