বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যখন ভারতীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘হিরো’!
'বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা'- বাংলা চলচ্চিত্রের এই অসাধারণ গানটি যেন পশ্চিম বাংলার বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনে ঘটেছে। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বেশ কিছুকাল যাবত পশ্চিম বাংলার নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে নানান নির্দেশনা দিয়েছেন; তার নির্দেশনায় বাংলার মানুষের কাছে বেশ আগ্রহও সৃষ্টি হয়েছে। অনেক চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে এসেছে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে। পশ্চিম বাংলার সরকারের শিক্ষামন্ত্রীসহ অপর তিনজন সাংসদ এখন কারাগারে। এর পুরো কৃতিত্বই এই অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের।
তাঁর একক বেঞ্চের বিভিন্ন নির্দেশাবলী কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট (ইডি) ও সিবিআই (সিবইআই) খুঁজে বের করেছে বহু টাকার পাহাড়। জনগণের কাছে এই দুর্নীতির খবর পৌঁছালে জনগণ উল্লোসিত হয়েছে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এই কার্যক্রম তাকে দুর্নীতি বিরোধী 'হিরোতে' পরিণত করেছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান জানাতে তিনি কখনো সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন, কখনো পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, টেলিভিশন লাইভে কথা বলছেন- যা সাধারণত রাজনৈতিক নেতারা করে থাকেন। প্রশ্ন উঠেছে, একজন কর্মরত বিচারপতি এগুলো করতে পারেন কিনা? গত কয়েকমাস পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে বিষয়টি খুবই আলোচিত। পশ্চিমবাংলা সরকারের বড় নেতা ও মন্ত্রী শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে কারাগারে রয়েছেন। মন্ত্রীর জিম্মা থেকে বিপুল পরিমাণ অঘোষিত টাকা উদ্ধার করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। একই অভিযোগে সাংসদ ও অন্যান্য নেতারাও বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এরই মধ্যে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ভিন্ন আর একটি মামলা বিচারপতি অভিজিতের আদালতে আসলে তিনি যেভাবে বিষয়টি গণমাধ্যমে নিয়ে আসেন, তাতে তাঁর (বিচারপতির) নিরপেক্ষতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।
বিচারপতি এই অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবন শুরু হয়েছিল পশ্চিমবাংলা প্রাদেশিক নির্বাহী বিভাগের ভূমি মন্ত্রণালয়ের চাকরির মাধ্যমে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সেই চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। আমাদের দেশের ভূমি মন্ত্রণালয়ের মতন পশ্চিম বাংলার এই মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। পশ্চিমবাংলার ভূমি বিভাগে সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যাপক দুর্নীতি পর্যবেক্ষণ করেন তাদের কর্মজীবনে। ফলে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে আইনজীবী হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টের জীবন শুরু করেন। এটি তাঁর ব্যক্তিগত সততার একটি উদাহরণ। আইনজীবী জীবনে তিনি বামপন্থী আইনজীবীদের সংস্পর্শে আসেন এবং এক সময় সিপিএম সরকারের প্রাক্তন রাজ্য অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে কাজ করেন। কলকাতা হাইকোর্টের মামলা পরিচালনা করার মাধ্যমেই তিনি সুপ্রিম কোর্টের নজরে আসেন। ভারতীয় হাইকোর্ট সমূহে বিচারক নিয়োগ করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ অপর দুই বিচারপতির কলেজিয়াম ব্যবস্থা। তাদের প্রস্তাবিত নাম থেকেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে কলকাতা হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
বিচারপতি হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে নানান ধরনের নির্দেশ তিনি দিয়ে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ প্রদান করা। কেন্দ্রীয় সরকারের আনুগত্যের অংশ হিসেবে কাজ করে এমন সংস্থার উপরে নির্ভর করে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নানান নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সেই সমস্ত নির্দেশনার ফলে রাজ্যে সরগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল।
এই দুর্নীতি মামলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ভারতের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন। ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনে, লোকসভা আসনের দিক থেকে তৃতীয় সর্বোচ্চ আসনধারী রাজ্য পশ্চিমবাংলা, যার লোকসভা আসন সংখ্যা ৪২টি। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি হয়েছিল এই রাজ্যে। এবার তারা আরো মরিয়া। ফলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিভিন্ন নির্দেশনাকে 'অতি তৎপরতা' বা 'অতি উৎসাহ' হিসেবে দেখছেন। তারা এমনও বলছেন, একটি/দুইটি বিচার দিয়ে সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করা যায় না- যার জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। কিন্তু বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর নিজস্ব চিন্তায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছেন, তা আসন্ন নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীনদের জন্য নির্বাচনের খোলা মাঠ তৈরি হচ্ছে। এর বড় কারণ হলো, সর্বভারতীয় বিজেপি বিরোধী জোট গঠন যেমন দুর্বল হবে, তেমনি রাজ্যে বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলো পথ হারাবে এবং বিজেপি উত্থানের পথ সুগম হবে।
ইতোমধ্যে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, অন্তত দুটি মামলা বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস থেকে সরিয়ে নিতে হবে। দুটিই আলোচিত মামলা। একটি নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলা এবং অন্যটি তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে দূর্নীতির মামলা। এছাড়া, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলাগুলোর বিষয়ে পশ্চিমবাংলা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকেই দায়িত্ব প্রদান করেছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এই বিচার পরিচালনা করবেন কি-না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।
শুক্রবার দিনভর নানান নাটকীয়তা চলছিল দিল্লির সুপ্রিম কোর্ট ও কলকাতার হাইকোর্টের মধ্যে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় হাইকোর্টের রেজিস্টারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের কাছে কি তথ্য প্রদান করা হয়েছে, তা তাকে জানানোর জন্য। তিনি মধ্যরাত, বারোটা পনেরো মিনিট পর্যন্ত নিচ এজলাসে উপস্থিত থাকবেন বলে জানিয়েছিলেন। বিচারিক আদেশ প্রদান করেছিলেন। সন্ধ্যারাতে সেই আদেশকে পশ্চিমবাংলা হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ স্থগিত করে দেয়। এরপরে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তার অফিস কক্ষ ত্যাগ করে। ত্যাগ সময় 'জয় হোক সুপ্রিম কোর্টের' গণমাধ্যমের কর্মীদের সামনে এমনি একটি বাক্য রাজনীতিবিদদের মতনই উচ্চারণ করেছেন।
তিনি গণমাধ্যমের সামনে আরো উল্লেখ করেছেন, আমার পরিবর্তে অন্য কোনো বিচারপতি আসলেও তিনিও হয়তো একইভাবে মামলা পরিচালনা করবেন, আর আমি আজীবন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব। গণমাধ্যমের কর্মীদের এ কথা জানিয়ে, কর্মস্থল ত্যাগ করে গৃহ অভিমুখে রওনা দেন তিনি।
আপাতদৃষ্টিতে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের পদক্ষেপ গুলো যথার্থ বলেই মনে হবে, তার কারণ হচ্ছে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় প্রচলিত নিয়ম নীতিগুলো অনুসরণ করছিলেন না। এছাড়াও, আছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের বিচারক নিয়োগের আইন সংক্রান্ত মতদ্বৈধতা। ফলে ভারতীয় বিচার বিভাগের সামগ্রিক ঐক্যবদ্ধতা ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি, অন্যথায় ভারতের গণতন্ত্র নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ববাদীদের কাছেই পরাজিত হবে।
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।