শুধু ইউক্রেন নয়, মিয়ানমারের বিষয়েও সমান সক্রিয় হতে হবে আইসিসিকে

মতামত

18 March, 2023, 03:50 pm
Last modified: 28 March, 2023, 09:20 pm
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, ইউক্রেনে ঘটা অপরাধ তদন্তে আইসিসি যতটা তৎপর, মিয়ানমারের ক্ষেত্রে ততটা সক্রিয় নয়। এতে করে অনেকেরই প্রশ্ন, তাহলে কি পশ্চিমাদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়েই বেশি চিন্তিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)?

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের দুই বছর পেরিয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে দুর্নীতির অভিযোগে উৎখাত করে ক্ষমতায় বসেছে সামরিক জান্তা। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশটির সামরিক প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বে চলছে মিয়ানমার। এই দুই বছরের বেশি সময়ে গণতন্ত্রের দাবিতে জনগণের আন্দোলন-বিক্ষোভ কঠর হাতে দমন করেছে সামরিক সরকার। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যমতে, জান্তার দমন-পীড়নে এ পর্যন্ত অন্তত ২,০০০ নিহত ও ১৫,০০০ বেশি লোক গ্রেপ্তার হয়েছে; বাস্তুচ্যুত হয়েছে অন্তত আরও ১ মিলিয়ন। এরপরেও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) তেমন কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি জান্তাপীড়িত দেশটিতে।

সেনা অভ্যুত্থানের পর ২০২১ সালের এপ্রিলে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী ও ২০২০ সালের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মিলে গঠন করে ন্যাশনাল ইউনিটি গভার্মেন্ট (এনইউজি)। জান্তার বিরুদ্ধে তারা সরকার গঠন করে আইসিসির ম্যান্ডেট গ্রহণের ঘোষণা দেয়। আইসিসিও স্বীকৃতি দেয় ওই ঘোষণার। এনইউজি মূলত আইসিসিকে মিয়ানমারে জান্তা সংঘঠিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্তের জন্য অনুরোধ করেছিল। কারণ সেদেশের আদালতে যে বিচারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, তা ভালো করেই জানেন রাজনৈতিক নেতারা। আর এজন্যই ৫৫ মিলিয়নের দেশ মিয়ানমার এখন বিচারের আশায় তাকিয়ে আছে আন্তর্জাতিক সংস্থার দিকে। 

তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, ইউক্রেনে ঘটা অপরাধ তদন্তে আইসিসি যতটা তৎপর, মিয়ানমারের ক্ষেত্রে ততটা সক্রিয় নয়। এতে করে অনেকেরই প্রশ্ন, তাহলে কি পশ্চিমাদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়েই বেশি চিন্তিত আইসিসি?

সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন সরাসরি সংঘাতের বয়স এক বছর পেরিয়েছে। সংঘাত শুরুর মাত্র কয়েক দিনের মাথায় আইসিসি প্রতিনিধি সেখানে গিয়ে ঘটনার তদন্ত শুরু করে। এমনকি, যুদ্ধপরাধের দায়ে শুক্রবার (১৭ মার্চ) রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরয়ানাও জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। অথচ মিয়ানমারের সংঘাত এরচেয়ে দ্বিগুণ সময় পার করলেও এখনও সেখানে আইসিসির কোনো তৎপরতা নেই। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যেহেতু এনইউজির ঘোষণায় আইসিসি স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই আইসিসির অবশ্যই উচিত সেখানে ইউক্রেনের মতো তদন্তকারী দল পাঠিয়ে সত্য খুঁজে আনা এবং অপরাধীদের বিপক্ষে সুষ্ঠু বিচার ঘোষণা করা। এতে করে আন্তর্জাতিক এই সংস্থার স্বচ্ছতা বাড়বে এবং এটি ভুক্তভোগী দেশগুলোর আস্থার জায়গায় পরিণত হবে।

তবে এখানে একটি প্রশ্ন আসতে পারে। সেটি হলো, জান্তার বিপরীতে দাঁড়ানো এনইউজি সরকার আইসিসিতে বিচারের জন্য মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে কিনা। ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য ডিপ্লোমেটে প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণ অনুসারে, এই প্রতিনিধিত্ব করার এখতিয়ার রয়েছে ন্যাশনাল ইউনিটি গভার্মেন্টের। বিশ্লেষণের লেখক জন ডগার্ড, ক্রিস গুনেস, টমি থমাস, ইউয়ুন ওয়াহিউনিংরাম এবং রালফ ওয়াইল্ডের মতে, ডমেস্টিক ল বা দেশের আইন অনুযায়ী, এনইউজি মিয়ানমারের বৈধ সরকার। কারণ ২০০৮ সালের সংবিধান অনুসারে, ২০২০ সালে গণতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের ভোটের মাধ্যমে এই প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। সুতরাং, জান্তা দ্বারা দমন-পীড়নের শিকার হলেও তাদের অবৈধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই; তাদের সরকার গঠন সম্পূর্ণ বৈধ।

অন্যদিকে, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে জান্তা, যা দেশটির সংবিধানের ৭১(ক) এবং ৪১৭ নং অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই অনুচ্ছেদগুলোতে রাষ্ট্রপতির বরখাস্ত এবং জরুরি অবস্থা জারির জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু অনুবিধান অনুযায়ী তা মানা হয়নি। উল্টো রাষ্ট্রপতিসহ গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিতদের জেলে ঢুকিয়ে জনগণের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করেছে সামরিক বাহিনী।

ফলে বিশ্লেষকরা বলছেন, সামরিক বাহিনীর এভাবে ক্ষমতা দখল সম্পূর্ণ অবৈধ।

২০২১ সালের শেষে জাতিসংঘ তার সাধারণ পরিষদ থেকে জান্তা প্রতিনিধিকে বাদ দিয়ে এনইউজির প্রতিনিধিকে মিয়ানমারের পক্ষে সভায় প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেয়। জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত জানিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাও (আইএলও)।

ফলে আইসিসিকে এখন এনইউজির ঘোষণাকে অবশ্যই বৈধভাবেই গ্রহণ করতে হবে। সেখানে ঘটে যাওয়া এবং ঘটতে থাকা অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে হবে। 

মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতন তদন্তে ২০১৭ সালে জাতিসংঘ গঠন করেছিল দ্য ইউএন ইনভেস্টিগেটিভ ম্যাকানিজম ফর মিয়ানমার। এরকমই একটি তদন্ত কমিটি অবৈধ জান্তা সরকারের বিরুদ্ধেও গঠন করা উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এবং এর মাধ্যমে মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের জন্য বিচার নিশ্চিত করা উচিত বলে অভিমত তাদের। ন্যায় বিচারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় আছে দেশটির জনগণ। তাই রাষ্ট্র, জাতিসংঘ এবং আইসিসির উচিত এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.