ঘর ও বাহির একজনকেই সামলাতে হবে কেন!

মতামত

গাজী তানজিয়া 
07 March, 2023, 01:15 pm
Last modified: 07 March, 2023, 01:59 pm
কোন কোন পুরুষ তার অর্ধাঙ্গীকে সাহায্য করলেও বেশিরভাগই করেন না। আবার কোন কোন পুরুষ সাহায্য করতে চাইলেও তার পরিবারের সদস্যরা এটা নিয়ে হাসি-তামাশা করেন। এমনকি কোন কোন নারীকে শ্বশুরবাড়ি থেকে শর্ত দেওয়া হয় যে, স্বামী-সন্তান-সংসার সব সামলে যদি চাকরি করতে পারো তবেই শুধু চাকরি করতে অনুমতি দেওয়া হবে।

নারীকে 'ঈশ্বরী' বন্দনা করার অন্তরালে তাকে দিয়ে ঘরে-বাইরে কাজ করিয়ে নেয়ার মধ্যে বর্তমান সময়ের নারী কোন মাহাত্ম্য খুঁজে পাচ্ছে না, এটা একটা আশার বিষয়। সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায় থেকে যদি ধরি, কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শুরু করে যুগে যুগে এই পৃথিবীর সার্বিক উন্নয়নে নারীর ভূমিকা অপরিসীম। 'কৃষি' নারী ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য আলোকিত অধ্যায়। সভ্যতার শুরু থেকে নারীর সব কাজের মধ্যে কৃষি উল্লেখযোগ্য। পুরুষ যখন ছুটে চলেছে বন্যপ্রাণী শিকারের পেছনে, নারী তখন নিরবে বপন করেছে শস্যদানা। যা পরবর্তীকালে গোটা সমাজ ব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে সভ্যতার সূচনা করেছিল।

একদিন যখন পুরুষ আবিষ্কার করল তাদের বসতির আশপাশ ছেয়ে গেছে সবুজ বৃক্ষরাজিতে, তখন থেকেই সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল স্থায়ী জীবনের। কৃষিভিত্তিক সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ এখনো প্রায় সমান হলেও নারীর কাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়নি। ক্ষেতের ফসলের পরিচর্যায় কৃষকের সঙ্গে একজন কৃষাণীর সক্রিয় উপস্থিতি আমাদের অজানা নয়। ফসল ঘরে তোলার পরবর্তী প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল, যা সামাল দিতে হয় নারীকেই। সংসার সামলে ফসল ঘরে তোলার পুরো প্রক্রিয়ার দায় এবং দায়িত্ব অলিখিতভাবে নারী বহন করে চলেছে। কৃষাণীর অংশগ্রহণ ছাড়া ফসলের কোনো গতি করা সম্ভব নয়। কৃষাণী তার নিপুণ দক্ষতায় ফসলকে দেয় মূল্যবান সম্পদের রূপ। যে সম্পদে ভর করে শুধু কৃষকই বাঁচার স্বপ্ন দেখে না, তার উপর নির্ভর করে আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিও। কৃষিভিত্তিক সমাজ বাদ দিলে নারীর ভিন্ন কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়া একটা সময়ে খুব সহজসাধ্য ছিল না। তারা ঘরে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল ওই পুরুষেরই ষড়যন্ত্রে। পুরুষতন্ত্র চায়নি যে, লৈঙ্গিক সমতা আসুক। কারণ তাহলে পুরুষতন্ত্রের আরাম, আয়েশ, দাপটের জায়গা বা দমন নিপীড়নের যে কৌশল সেটি অনেকাংশেই কমে যাবে।

আর ঠিক তখন পিতৃতন্ত্র আর পুঁজিবাদের চুক্তি হিসেবে নারীদের দেখানো হয় ঘরে-বাইরে সমানভাবে পারদর্শী। পুরুষতন্ত্রকে এভাবে আশ্বস্ত করা হয় যে নারী বাইরে কাজ করলেও তার ঘর ঠিক থাকবে। তাই আধুনিককালে একা সংসার চালানো যখন পুরুষের জন্য একটু কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে, সেই প্রেক্ষাপটে নারী অনেকটা বাড়তি আবরণে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে হলেও বাইরে কাজ করার অধিকার আদায় করে নিয়েছে। নারী তার মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে স্থান করে নিয়েছে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে নারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক বলয়ের বিভিন্ন সূচকে অধিকাংশ কর্মজীবী নারী সমান্তরাল ভূমিকা রেখে চলেছে। একজন নারী ঘরের কাজ যতটুকু নিজের দক্ষতার সাথে গুছিয়ে নিচ্ছেন, একই সাথে কর্মক্ষেত্রেও যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ রাখছেন। আর এই সমানতালে নিজের যোগ্যতার প্রকাশ করতে গিয়ে কর্মজীবী নারীদের অনেক বেশি চাপ সামলাতে হয়। অন্যদিকে অফিস ও বাড়ি মিলিয়ে দায়িত্ব ও কর্তব্যের তালিকা থাকে বিশাল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিসে কাজ করে ঘরে এসে আবার করতে হয় রান্নাবান্না। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ইত্যাদি সামলানোসহ সংসারের আরো যাবতীয় কাজ। সন্তানের সুষ্ঠু লালন-পালনের দায়িত্বটা যেন অবধারিতভাবে মায়ের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি হিসাব অনুযায়ী, পুরুষের তুলনায় কর্মজীবী নারী দিনে কাজ করেন তিনগুণ। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। এবং বাংলাদেশের মোট নারীর ৫৭% কর্মজীবী।

এবার আসা যাক, ঘরের কাজ কে কতটুকু করে সে বিষয়ে। জরিপ অনুযায়ী পুরুষ ও নারী উভয়ই কর্মজীবী এমন পারিবারিক পরিবেশে ৮৫% ক্ষেত্রেই রান্নার কাজটি করতে হয় নারীকে। আর কর্মজীবী পুরুষকে রান্না করতে হয় মাত্র ২.৫ শতাংশ ক্ষেত্রে। কর্মজীবী ১০০ নারীর মধ্যে ৮৯ জনই কাপড় ধোয়ার কাজ নিজেই করেন। আর ১০০ জন কর্মজীবী পুরুষের ক্ষেত্রে এই কাজ করেন মাত্র ১২ জন। কর্মজীবী নারীদের 88 শতাংশ ঘর পরিষ্কার সহ বিভিন্ন জিনিস পরিষ্কার ও সংরক্ষণের কাজ করেন। যেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে এই হার ৭ শতাংশ। তবে কর্মজীবী পুরুষদের ৭৭ শতাংশই বাজার করে থাকেন কারণ এটাকে তারা 'পুরুষালি' কাজ মনে করেন। আর ২৬ শতাংশ কর্মজীবী নারী চাকরির পাশাপাশি সংসারের কেনাকাটার কাজটিও করে থাকেন। পরিবারের বৃদ্ধ, শিশু, অসুস্থ সদস্য ও অতিথিদের দেখভালও কর্মজীবী নারীকেই সামলাতে হয়। ৫৩ শতাংশ কর্মজীবী নারী নিয়মিত এ কাজ করেন। বিপরীতে পরিবারের এসব সদস্যের যত্ন নেয়ার কাজটি করে থাকেন ২১ শতাংশ কর্মজীবী পুরুষ। কর্মজীবী একজন পুরুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থের বিনিময়ে ৬ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট কাজ করেন। অপরদিকে একজন নারী অর্থের বিনিময় ছাড়া কাজ করেন প্রায় ১২ ঘণ্টা। যুদ্ধক্ষেত্রে বিরতি থাকলেও এই সংসার সামলানোর যুদ্ধে নারীর বিরতি বলে কিছু নেই।

একজন কর্মজীবী নারীকে প্রতিনিয়ত লড়ে যেতে হয়। দিনের পর দিন নারী ঘরে-বাইরে এত যে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন পরিবারে বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এর কতটুকু মর্যাদা পাচ্ছেন?

কোন কোন পুরুষ তার অর্ধাঙ্গীকে সাহায্য করলেও বেশিরভাগই করেন না। আবার কোন কোন পুরুষ সাহায্য করতে চাইলেও তার পরিবারের সদস্যরা এটা নিয়ে হাসি-তামাশা করেন। এমনকি কোন কোন নারীকে শ্বশুরবাড়ি থেকে শর্ত দেওয়া হয় যে, স্বামী-সন্তান-সংসার সব সামলে যদি চাকরি করতে পারো তবেই শুধু চাকরি করতে অনুমতি দেওয়া হবে।

ফলে সবসময় পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক পরিবারগুলো, যারা হাজার হাজার বছর ধরে মস্তিষ্কে গেঁথে দেওয়া পুরুষতান্ত্রিক মতবাদই বহন করছে, তাদের তুষ্ট করতে কর্মজীবী নারীকে দেখাতে হয় সে ঘর ও বাইরে সমান পারদর্শী।

আমাদের মতো অবিকশিত সমাজ বাদ দিলেও যুক্তরাজ্যের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জানিয়েছেন, যেসব পুরুষের উপার্জন তুলনামূলক কম, তারাই সাধারণত থালাবাসন ধোয়া ও ধুলাবালু পরিষ্কার করার মতো ঘরোয়া কাজকর্মে নিজ নিজ স্ত্রীকে সাহায্য করেন। 'ওয়ার্ক, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোসাইটি' সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, নিত্যদিনের ঘরোয়া কাজকর্মের অধিকাংশই নারীকে করতে হয়। তারা কত ঘণ্টা কাজ করেন এবং বিনিময়ে কী পান, সেসব বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগও মেলে না। তবে উপার্জনের ভিত্তিতে নারী-পুরুষের সমতার ব্যাপারে দম্পতিদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের বিষয়টি লক্ষণীয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশি অর্থ উপার্জনকারী পুরুষেরা ঘরোয়া কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারলেও নিষ্ক্রিয় থাকেন। তারা বরং অর্থ খরচ করে গৃহকর্মী রেখে দায় সারতে চান।

আবার যুক্তরাষ্ট্রের আরেক গবেষণায় দেখিয়েছে, পুরুষের তুলনায় নারীদের 'মাল্টি-টাস্কিং ক্যাপাবিলিটি' বেশি।

একসাথে কয়েকটা কাজ করাকে বলা হয় 'মাল্টিটাস্কিং', আর সেই কাজ করতে গিয়ে যে গোলমাল লাগে, গবেষকগণ তাকে বলছেন 'ইন্টারফিয়ারেন্স'। কিন্তু গবেষকগণ হঠাৎ করে এই ব্যাপারগুলোর এরকম নামকরণ করতে গেলেন কেন? ওই গবেষণায় বলা হচ্ছে, একাধিক কাজ করার ক্ষেত্রে কাজগুলোর মধ্যে যে ইন্টারফিয়ারেন্স তৈরি হয় তা পুরুষের তুলনায় নারীকে কম প্রভাবিত করে। অর্থাৎ একজন নারীর পক্ষে মাল্টিটাস্কিং করা সহজ, কিন্তু পুরুষকে এটা করতে গেলে প্রায়ই হয়তো আটকে যেতে হবে।

পেপারটিতে আরও বলা হয়, 'নারী ও পুরুষের এই বিশেষ আচরণগত পার্থক্যের ক্ষেত্রে হরমোনসমূহ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে'। তো উন্নত বিশ্বের গবেষকরা যেখানে নারীকে রোবট ভাবছেন বা রোবট প্রমাণের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন সেখানে বাঙালি পুরুষ, যাদের বেশিরভাগই কথায় কথায় বলে, 'ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত মা আমাদের মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে' তাদের আর কি দোষ! আর তাই তো এনজিও থেকে কর্পোরেট লেভেল সবাই 'পলিটিক্যাল কারেক্টনেসে'র তোয়াক্কা না করেই নারীকে মহিমান্বিত করার নামে তার মাল্টিটাস্কিং ক্যাপাবিলিটির ওপরেই জোর দিয়ে থাকে। তাদের কাছে নারী দশভুজা। অন্তত কাজ করিয়ে নেয়ার বেলায়। এখানে নারী যে একজন মানুষ, তিনিও যে একটা রক্ত মাংসের শরীর বহন করেন এ কথা যেন সবাই ভুলে বসে আছে।

আর অন্যদিকে যে পুত্র সন্তানটি তার মায়ের প্রতি এমন আচরণ দেখে বড় হচ্ছে সে যখন সংসার করবে তার স্ত্রীর ওপরেও এই একই নিয়ম প্রয়োগ করতে কুণ্ঠাবোধ করবে না; যদি না তাকে বোঝানো হয় যে, সংসারের কাজ শুধু নারীর একার কাজ নয়।

তবে আশার কথা এই যে, নারী যখন তার ওপর চাপিয়ে দেয়া বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তখন সে তার ক্ষমতায়নের ক্ষমতাকে আর মহৎ ভাবতে পারছে না। তাকে মহৎ বানানোর যে পুরুষালী ও কর্পোরেট ষড়যন্ত্র একে রুখে দিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাকে আজ বলতে শোনা যাচ্ছে, যে ঘর দুজনের, যে সংসার যৌথতার তাকে সামলানোর সিংহভাগ দায়িত্ব কেন একা নারীকেই বহন করতে হবে! 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.