সীতাকুণ্ডে বারবার বিস্ফোরণ কেন?

মতামত

06 March, 2023, 12:30 pm
Last modified: 06 March, 2023, 12:39 pm
প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ কেবল মানুষ নয়; প্রাণ-প্রকৃতিসহ সামগ্রিক প্রাকৃতিক ও সামাজিক জীবনকে তছনছ করে দেয়। জীবনের জন্যই উৎপাদন, আর এই উৎপাদন যদি বারবার জীবনকে বিপন্ন করে তোলে, তাহলে দেশের সামগ্রিক বিকাশ হবে প্রশ্নবিদ্ধ। 

২০২২ সালের ৪ জুন বিস্ফোরিত হয়েছিল সীতাকুণ্ড। বিএম ডিপোর হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরণের নিদারুণ ক্ষত ও দাগ মুছেনি এখনো। নয় মাস না যেতেই আবারো বিস্ফোরিত হল সীতাকুণ্ড। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কদমরসুল (কেশবপুর) এলাকায় 'সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেডের' প্লান্টে ৪ মার্চ, ২০২৩ তারিখে ঘটলো আবার বিপজ্জনক বিস্ফোরণ। ঘটনায় নিহত ছয় এবং আহত শতাধিক। ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সাত সদস্যের এক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সীমা অক্সিজেন প্লান্টের দায়িত্বশীল কারো বক্তব্য নিতে পারেনি গণমাধ্যম, তারা পালিয়ে গেছেন। 

বিস্ফোরণের পর ফায়ার সার্ভিসের কুমিরা, সীতাকুণ্ড ও আগ্রাবাদের নয়টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে অংশ নেয়। র‌্যাব, সেনাবাহিনী, পুলিশ, নৌবাহিনী, বিভিন্ন সংস্থা ও সাধারণ মানুষ উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। প্রতিটি বিস্ফোরণই বিপজ্জনক, একটির সাথে আরেকটির কোনোভাবেই তুলনা করা যায় না। কিন্তু এবারের বিস্ফোরণে বহুদূরের জনজীবনও নিরাপদ ছিল না। বিস্ফোরণে প্রায় দুই কিলোমিটারের বেশি এলাকা কেঁপে ওঠে। আশেপাশের বহু বাড়ির কাচের জানালা ভেঙে পড়ে। ঘটনাস্থল থেকে বহু দূরে ৩০০ কেজি ওজনের লোহার খণ্ড উড়ে এসে মাথায় আঘাতে একজন নিহত হন। 

সীমা অক্সিজেন কারখানায় কেন বিস্ফোরণ ঘটেছে, তা স্পষ্ট নয়। 'গ্যাস সিলিন্ডার নীতিমালা ১৯৯১' অনুযায়ী, অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপনের জন্য বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হয়। সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে কীনা কেউ জানে না। এমনকি এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাটি নিয়মিত পরিদর্শনের আওতায়ও ছিল না। কিন্তু সীমা অক্সিজেন কারখানাটিতো আর চলনবিল বা চিম্বুক পাহাড়ে অবস্থিত নয়। সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে এই সীমা অক্সিজেন প্লান্টের অবস্থান। কারখানার উত্তরে নয়মাস আগের অগ্নিদগ্ধ বিএম কনটেইনার। রাসায়নিক কারখানা বোঝাই এই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বাস করেন শত শত শ্রমিক। এরা সকলেই বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন জীবিকার কারণে। কৃষক থেকে হয়েছেন ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার শ্রমিক। তো এই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল, যেখানে এর আগে বিস্ফোরণ ঘটেছে সেখানকার প্রতিটি কারখানার বিষয়ে রাষ্ট্র কেন মনোযোগী হলো না? কেন এতদিনেও এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বিশেষ ব্যবস্থাপনার অংশ হলো না? 

বিএম ডিপোর পর সীমা কারখানার এই বিস্ফোরণ প্রমাণ করেছেন ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার বিষয়ে আমরা দায়িত্বশীল নই। এমন কারখানাগুলোর লাইসেন্স থেকে শুরু করে উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় কোথাও আমাদের নজরদারি ও জবাবদিহিতা নেই। অবশ্যই এ বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে সামগ্রিক বিবেচনায় আনা জরুরি। আমরা আশা করবো, সীমা কারখানা বিস্ফোরণের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। ঘটনায় নিহত ও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর পাশে মানবিক মর্যাদা নিয়ে দাঁড়াবে রাষ্ট্র। রাসায়নিক বোঝাই ঝুঁকিপূর্ণ সীতাকুণ্ডের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে রাষ্ট্র পরিবেশবান্ধব সংবেদনশীল নীতিমালা গ্রহণ করবে। আমরা কোনোভাবেই চাইনা বিএম ডিপো কিংবা সীমা অক্সিজেন একের পর এক বিস্ফোরণে দগ্ধ চুরমার হবে ঐতিহাসিক সীতাকুণ্ড। সীতাকুণ্ডের উৎপাদন অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রাণ-প্রকৃতি ও জনজীবনের নিরাপত্তা রাষ্ট্রকেই সুরক্ষিত রাখতে হবে। 

নিমতলীর রাসায়নিক বোঝাই গুদামঘর, তাজরীন গার্মেন্টস, সেজান জুস কারখানা, বিএম ডিপো থেকে সীমা অক্সিজেন। একের পর এক প্রশ্নহীন আগুন। নিমিষেই অঙ্গার টাটকা জীবন। চুরমার সংসার, বিশৃঙ্খল পরিবার। তদন্ত হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ করে, মামলা হয়, ক্ষতিপূরণ কিছু দেওয়া হয় কিংবা কিছু ধড়পাকড় হয়; কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক কিছুই হয় না। তাজরীন, রানা প্লাজা, নিমতলী, সেজান কারখানা কী সীতাকুণ্ড ডিপো বিস্ফোরণে প্রশ্নহীন প্রাণহানিকে অনেকেই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলেন। তবে কাঠামো বিশ্লেষণে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক সংগঠন, দুর্নীতি, অবহেলা, উদাসীনতা, দায়হীনতাকেই মূলত আলাপে টানতে দেখা যায়। বিশ্বায়িত বাজার, কর্পোরেট বাহাদুরি কিংবা  নয়াউদারবাদী ভোগবাদ উল্লিখিত কাঠামোয় আড়াল হয়ে থাকে। অথচ এসব বিস্ফোরণ এবং প্রাণহানির অতলে পোক্ত হয়ে আছে আমাদের নয়াউদারবাদী কর্পোরেট ভোগবাদ। সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপো বা সীমা অক্সিজেন কারখানা বিস্ফোরণের মূলে আছে কর্পোরেট বিশ্বায়িত বাজারের নিয়ন্ত্রিত ভোগবাদ। সীতাকুণ্ড বিএম ডিপো বিস্ফোরণে নিদারুণভাবে নিহত হয়েছিলেন ৪১ জন, এবার সীমা অক্সেজেনের আগুনে পুড়ে প্রাণ দিয়েছেন ৬ জন। এইসব বিস্ফোরণে কারা অঙ্গার হয়? গ্রামগঞ্জের মেহনতি গরিব মানুষ। 

নয়াউদারবাদী বাজারকে আর কর্পোরেট ভোগবাদকে চাঙ্গা রাখতে এই গরিব মানুষের জীবন সবসময় এক একটি নির্দয় সংখ্যায় পরিণত হয়। আমাদের মনে রাখা জরুরি, ঝুঁকিপূর্ণ উৎপাদন কর্মরত নিহত প্রতিটি জীবন কোনো সংখ্যা নয়, এক একজন স্বতন্ত্র মানুষ। কেন গরিব মানুষের কর্মস্থল প্রশ্নহীনভাবে ঝুঁকিপূর্ণ থাকে? কেন গরিবের কর্মপরিসর অনিরাপদ ও বিপদজনক হয়ে থাকবে চিরকাল? অথচ এমন কারখানাগুলোই দেশের গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন খাত এবং উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি। তাহলে এসব কর্মক্ষেত্র কেন মানবিক, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব হবে না? একের পর এক অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণ ঘটবে আর আমরা ক্ষতিপূরণ কিংবা গাফিলতির মোড়কে কাঠামোগত বৈষম্যকে ঢেকে রাখবো। ব্যবস্থাপনা ও নীতিপ্রশ্নের মূল আলাপে টানবো না। এভাবে সীতাকুণ্ডকে দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যতের জন্য সামগ্রিকভাবে নিরাপদ করে তোলা সম্ভব কী? 

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রামকে এখন অনেকই পরিচয় করান 'বন্দরনগরী'। আর এই বন্দর আজ বিস্ফোরণের বিপদে বোঝাই। বিএম ডিপো বিস্ফোরণের পর জানা যায়, বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুত এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতিমালা ছাড়াই বন্দরে গড়ে ওঠেছে একের পর এক ডিপো ও কারখানা। 

১৯৮৪ সালে সি-ফেয়ারর্স লিমিটেড নামে বেসরকারি আইসডি চালুর ভেতর দিয়ে বেসরকারি ডিপোর কাজ শুরু হয় এবং ২০২১ পর্যন্ত গড়ে ওঠে ১৯টি ডিপো। ২০২০ সালেও এখানে অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং সেই অগ্নিকাণ্ডের পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগুন লাগা শেডে ১৯৮৭ সালে আমদানি করা পণ্যও ছিল। বিএম ডিপো বিস্ফোরণ থেকে আমরা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করিনি, এমনকি এসব বিষয়ে হয়তো আমাদের কলিজায় একটুও দাগ কাটে না। তাহলে আমরা সতর্ক থাকলাম না কেন? কেন আবার আরেকটি সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটতে দিলাম? দাহ্য বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুদ, ব্যবহার, উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনায় আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি ও কাঠামোগুলো কতোটা কীভাবে মানছি বা আমাদের আরো কীভাবে নিজেদের নিরাপত্তা জোরদার করা যায় সেইসব বিষয়ে দ্রুত রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ও অঙ্গীকার জরুরি। 

সীমা অক্সিজেন বা বিএম ডিপো নয়;  চট্টগ্রাম বন্দরে এর আগেও বহু রাসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটেছে। ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালে মিথানলভর্তি ড্রামে বিস্ফোরণ ঘটে, ৪জন শ্রমিক গুরুতর আহত হন ও দগ্ধ হন অনেকেই। ২০২০ সালের ১৫ জুলাই রাতে বিস্ফোরণ ঘটে এবং ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি গাড়ি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কেবল বন্দর নয়, দেশের রাসায়নিক মজুদাগার কি কর্পোরেট কারখানা সর্বত্রই ঘটছে বিস্ফোরণ ও প্রাণহানি। পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে অগ্নিবিস্ফোরণ ঘটে ২০১০ সালের ৩ জুন। আগুনে নিহত হয় ১২৪ জন মানুষ। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় আগুন লেগে ১১৭ জন গার্মেন্টস শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বিস্ফোরণ ও ভবন ধসে ৩৫ জন নিহত হয়। ঢাকার কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় 'প্রাইম পেট এন্ড প্লাস্টিক ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের' কারখানায় ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর অগ্নিকান্ডে ২১ জন নিহত হয়। পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে রাসায়নিক বোঝাই এক ভবন বিস্ফোরিত হয় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৬৭ জন, দগ্ধ আরো ৪ জন হাসপাতালে মারা যান। ৭ জুলাই, ২০২১ সালের রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপে অবস্থিত 'হাসেম ফুড বেভারেজ কোম্পানির' ছয়তালা কারখানাটিতে আগুন লাগে। পুড়ে মারা যায় ৫২ জন শ্রমিক। 

প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ কেবল মানুষ নয়; প্রাণ-প্রকৃতিসহ সামগ্রিক প্রাকৃতিক ও সামাজিক জীবনকে তছনছ করে দেয়। জীবনের জন্যই উৎপাদন, আর এই উৎপাদন যদি বারবার জীবনকে বিপন্ন করে তোলে, তাহলে দেশের সামগ্রিক বিকাশ হবে প্রশ্নবিদ্ধ। 


 

বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.