বাংলার জলাভূমির বন্যপ্রাণীরা কি ভালো আছে?
মতামত
বন্যপ্রাণী-সংক্রান্ত গবেষণায়, অফিসের কাজে ছুটে বেড়াতে হয় সারা বাংলাদেশে। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আর কাজগুলো বেশির ভাগই জলাভূমিকে কেন্দ্র করে।
কাজের অংশ আর আগ্রহ মিলে প্রশ্ন করতে হয় মাঝেমধ্যে: ওখানকার বন্যপ্রাণীর অবস্থা কেমন? আগে কেমন ছিলো? কারা এখন নেই? একটি উত্তর প্রায়ই ঘুরেফিরে আসে: 'আগের মতন আর কিছুই দেহি না।'
মায়াময় ধরিত্রীর সৌন্দর্যের একটি বড় অংশ নীল জলাশয়। আর এই জলাশয়ে নৈসর্গিক মোহনীয়তা ডালি সাজিয়ে বসে জলচর বন্যপ্রাণী বা জলাশয়কে আবাসস্থল হিসাবে ব্যবহার করা বন্যপ্রাণীর কল্যাণে। মানবসৃষ্ট কারণে এখন অনিরাপদ বন্যপ্রাণীরা, বিশেষ করে জলাশয়কে কেন্দ্র করে যারা জীবনধারণ করছে।
বাংলাদেশে রয়েছে ৬৪ প্রজাতির উভচর, ১৭০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৭০০-র বেশি পাখির প্রজাতি এবং ১২৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। আর এ দেশে জলাধার বা জলাভূমিলে কেন্দ্র করে বন্যপ্রাণীর একটি বড় অবস্থান আছে।
বাংলাদেশের ৬৪ প্রজাতির উভচরের পুরোটাই আমাদের জলাশয়ের উপর নির্ভরশীল। এছাড়া সরীসৃপদের মধ্যে কচ্ছপ, কাছিম, গুইসাপ, বিষধর ও নির্বিষ সাপ, ঘড়িয়াল, কুমিরও জলাশয়নির্ভর। জলাশয়নির্ভর প্রাণীর মধ্যে আরও আছে ত্রিশ প্রজাতির বুনোহাঁস, চার প্রজাতির ডুবুরি, পনেরো প্রজাতির প্যারাপাখি, ঝিল্লি, কালেম, কোড়া, কুট, সারস, ডাহুক-জাতীয় পাখি, আট প্রজাতির শামুকখোল, মানিকজোড়, মদনটাক-জাতীয় পাখি, চার প্রজাতির কাস্তেচরা, চামচঠুঁটি-জাতীয় পাখি, আঠারো প্রজাতির বগলা, দুই প্রজাতির গগনবেড়, ছয় প্রজাতির সাপপাখি, পানকৌড়ি, বুবি। আছে ৮৩ প্রজাতির সৈকত পাখি। পাশাপাশি রয়েছে মাছরাঙা, খঞ্জন ও শিকারি পাখিরা, যাদের খাদ্যের প্রয়োজন মেটায় জলাভূমি।
প্রতিবছর জলাভূমিকে কেন্দ্র করে বিপুলসংখ্যক পরিযায়ী পাখি এ দেশ ভ্রমণে আসে। বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ, জালের মত ছড়িয়ে আছে সাতশোর বেশি নদী। ফলে তৈরি হয়েছে জলাভূমির এক অপূর্ব ভান্ডার। খাল, বিল, হাওর-বাওড়, নদ-নদী, সমুদ্র, উপকূল, চরাঞ্চলে পরিপূর্ণ এ দেশ প্রকৃতিগতভাবেই হয়ে উঠেছে জলচর পাখির আশ্রয়স্থল।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে মেছোবাঘ, ভোঁদড়সহ বিভিন্ন জলজ স্তন্যপায়ী জলাশয়ের ওপর নির্ভর করে। এক কথায় বলতে গেলে, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীর একটি বড় অংশই রয়েছে জলাশয়জুড়ে।
কিন্তু এদের অবস্থা কী বর্তমানে?
বাংলাদেশের সংরক্ষিত এলাকার পরিমাণ খুবই সীমিত, আর জলাশয়কেন্দ্রিক সংরক্ষিত এলাকা একেবারে নগণ্য। অথচ এখানেই বসবাস করে বহু বিপন্ন প্রাণী।
কিন্তু এ দেশে জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের খাদ্যসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের নানা খাতও। যার চাপ পড়ছে জলাভূমির ওপর এবং ক্রমেই ভরাট হচ্ছে জলাশয়। এতে বিলীন হচ্ছে পরিবেশের গুণগত মান ও পাখির আশ্রয়স্থল।
গত পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের জলাভূমির বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণার প্রেক্ষিতে দেখেছি, নগরায়নের প্রভাবে জলাভূমিগুলো ক্রমশ ভরাট হয়ে নির্মাণ হচ্ছে নিত্য-নতুন আধুনিক বাড়িঘর ও কলকারখানা। মানুষের বসবাসের বন্দোবস্ত ঠিকঠাক হলেও আবাসস্থল হারাচ্ছে এই বন্যপ্রাণীরা।
এ দেশে শহর এলাকার জলাভূমিগুলোর অবস্থা একেবারেই নাজুক। পাখিসহ সব বন্যপ্রাণী তাদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। একসময় রাজধানী ঢাকায় ছিল বড় বড় জলাশয়। সেসবে নিরাপদে উড়ে বেড়াত নানা প্রজাতির বুনো হাঁসসহ বিভিন্ন পাখি। ছিল আরও বিভিন্ন জলজ বন্যপ্রাণী। কিন্তু সেসব জলাশয় এখন রয়েছে শুধু গল্পে নয়তো ইতিহাসে।
জলাশয়গুলোর পানি ও পরিবেশের গুণাগুণ নষ্ট হওয়াতে ঠিকমতো খাদ্য উপাদান পাচ্ছে না বন্যপ্রাণীরা। পাশাপাশি সৌন্দর্যব র্ধনের নামে শহর বা গ্রামের জলাশয়গুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। সঙ্গে প্লাস্টিক দূষণ তো রয়েছেই। ফলে অনেক জলাশয় গুণগত মান হারিয়ে হয়ে পড়ছে বন্যপ্রাণীশূন্য।
মর্মান্তিক বিষয় হলো নির্বিচারে জলাশয়ের বন্যপ্রাণী হত্যা। শীত মৌসুম এলে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কতিপয় ব্যক্তিদের রসনা বিলাসের শিকার হচ্ছে পাখিরা। বিশেষ করে পরিযায়ী পাখিসহ বক, বুনো হাঁস, ডাহুক, কালেমের মতো পাখি আছে বেশি ঝুঁকিতে। বিষটোপ, এয়ারগান, ফাঁদ তো ব্যবহার করা হয়ই। তবে এখন পাখির ডাক নকল করে বাঁশি বাজিয়ে ও মোবাইল বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে হচ্ছে পাখি শিকার। এয়ারগান সম্প্রতি নিষিদ্ধ করা হলেও তা কতজন মেনে চলছে এটা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। এছাড়া খবরের পাতায় প্রায়ই দেখা যায় মেছোবাঘ হত্যা, ডলফিন হত্যা, কচ্ছপ পাচারসহ বিভিন্ন সংবাদ।
গণমানুষের সঙ্গে আলাপ করলে উঠে আসে, আগের মতো আর বন্যপ্রাণী দেখা যায় না জলাশয়ে। কারণ একটাই—হারিয়ে যাচ্ছে জলাশয়, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে শিকার। কিছু জলাশয়ে মাছ চাষ বেড়েছে, ফলে মাছ রক্ষায়ও হত্যা করা হচ্ছে পাখি। কিন্তু জানার বিষয় হলো, জলচর পাখিরা জলাশয়ের মাছ খেয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতি করে না, বরং অসুস্থ মাছ খেয়ে মাছের মহামারি থেকে রক্ষা করে জলাশয়কে।
জলাশয়কেন্দ্রিক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে তাদের আবাসস্থল সংরক্ষণে। আবাসস্থলের ভৌত গঠন, গুণাগুণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি। স্থানীয় পর্যায়ে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হবে, বিশেষ করে যুক্ত করতে হবে তরুণদের। তারাই বেশি ভূমিকা রাখবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে।
-
আশিকুর রহমান সমী: বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, সিইজিআইএস, বাংলাদেশ
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.