টিকটক কী জানেন না সেলফোনের জনক

মতামত

02 March, 2023, 07:45 pm
Last modified: 02 March, 2023, 07:46 pm
সেলফোনের জনক মার্টিন কুপার মনে করেন, এ ফোনের কারণেই আজকের জগৎ থেকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি হারিয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেশায় ঢুলছে দুনিয়া। 

১.

১৯৯০-এর দশকের কথা। কয়েকজন তরুণ বসে আলাপ করছে। সিম ও সেলফোন তাদের আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশে মাত্র সেলফোন চালু হয়েছে। তখন সেলফোনের দাম আকাশছোঁয়া। সিম কার্ড মহার্ঘ্য বস্তু। সেলফোন দেখেছেন অনেকেই। কিন্তু ব্যবহার করার ভাগ্য আমজনতার হয়নি। কথা বলতে মিনিটে ১০ টাকা বা তারও বেশি লাগে। যেতে কাটে। আসতেও কাটে। কল করলে টাকা যায়। কল রিসিভ করলেও যায়। আধুনিক কালের শাইলক দ্য জু-র তৈরি শাঁখের করাত। 

আড্ডার তর্কের বিষয় ছিল সেলফোনের কলের দাম এবং সিমের দাম কমবে কি কমবে না। সেলফোন আরও সস্তা হবে কি না! 

আড্ডার কথাবার্তা শুনছিলেন নানি সম্পর্কের এক ভদ্রমহিলা। তিনি হঠাৎ করে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, 'শোন ভাইয়েরা। কেবল সিম না, বরবটি কিংবা মটরশুঁটি দিয়াও ফোন চালানোর বুদ্ধি বাইর করব বিজ্ঞানীরা। তারা তো কেবল ধানের বিচি খায় না বা খড় দিয়া লেখাপড়া করে নাই। তখন দেখবি নাইরকেল গাছ থেকে হড়হড় কইরা নামার মতোই তোগো হাতফোনের দাম কইম্যা যাইব।' 

নানির কথা একদিক থেকে ঠিক হয়েছিল। বরবটি বা মটরশুঁটি দিয়ে ফোন বানানো শুরু না হলেও সিমের দাম হড়হড় করেই কমেছে। কমেছে কল রেটও। নানি মারা যাওয়ার আগেই ফোন ব্যবহার করে গেছেন। তার নিজেরই 'দুইট্যা' ফোন ছিল। আজীবন তিনি ওগুলোকে 'হাতফোন' বলতেন। আর ল্যান্ডফোনকে বলতেন 'দড়ি-ফোন!' 'হাতফোন' বলার পেছনে নানির যুক্তি ছিল—আরে হাতপাংখা আছে না আমাগো। ওইট্যা তো মুঠ কইর্যাই ধরতে হয়। তাই বইল্যা কি মুঠা-পাংখা কই, তা তো কই না! তাইলে হাত-ফোনে জ্বালা ধরে ক্যা!'

২.

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩ এপ্রিল। প্রথম সেলফোন থেকে কল করলেন মার্টিন কুপার। মটোরেলা টিএসি ৮০০০এক্স ফোনটির ওজন ছিল আড়াই পাউন্ড বা প্রায় ১.১৩ কেজি। তারহীন এ ফোনের নির্মাতাও তিনি। 

কুপার ইলিনয় ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি বা আইআইটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে। এরও সাত বছর বছর পর মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করলেন বিদ্যুৎ প্রকৌশলে। ১৯৭০-এর দশক থেকে কার-ফোনের চল ছিল। গাড়ির ব্যাটারি থেকে সংযোগ দেওয়া হতো এ ফোনের, তারপর রেডিও চ্যানেল ব্যবহার করে ফোন করা হতো। এসব তেমন কার্যকর ছিল না। 

কুপার সে সময় সহজে ব্যবহারযোগ্য এরকম ফোনের সম্ভাবনা আঁচ করতে পারলেন। তিনি গাড়ি থেকে ফোনকে বের করে আনলেন। তুলে দিলেন মানুষের হাতে। 

শিকাগোর অধিবাসী কোপারের বয়স এখন ৯৪। ৫০ বছর আগে প্রথম সেলফোন থেকে কল করার কথা বলতে গিয়ে অকপটে স্বীকার করেন তিনি: 'তখন যে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটতে চলছে সে সময়, তা বোঝার কোনো উপায়ই আমাদের ছিল না।' 

কিন্তু তার এই কলের মধ্য দিয়েই সেলফোন বিপ্লবের সূচনা হলো। লম্বায় এগারো ইঞ্চি প্রায় থান ইটের মতো ভারী সে ফোন এখন ছোট হয়ে গেছে। দুনিয়ার প্রায় প্রত্যেক মানুষের হাতে হাতে শোভা পাচ্ছে। 

এ বস্তু কেবল ফোন নয়, বরং তারচেয়েও আরও শক্তিশালী যন্ত্র। তবে এজন্য মানব সমাজকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। 

সেলফোনের জনক মার্টিন কুপার মনে করেন, এ ফোনের কারণেই আজকের জগৎ থেকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি হারিয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেশায় ঢুলছে দুনিয়া। 

তিনি বলেন, 'সেলফোনের সবচেয়ে নেতিবাচক দিকটি আমি মনে করি, আমাদের কারোরই আজ ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলে কিছুই নেই। আমাদের সম্পর্কে সবকিছুই কোথাও না কোথাও লিপিবদ্ধ বা রেকর্ড হচ্ছে। প্রবল ইচ্ছা থাকলেই যে-কেউই সেসব তথ্য হাতিয়ে নিতে পারবে।' 

১৯৭৩ সালে মোবাইল ফোন আবিষ্কার করেন মার্টিন কুপার। ছবি: সংগৃহীত

নিজেকে তিনি স্বাপ্নিক হিসেবে তুলে ধরতে ভালোবাসেন। সেলফোনের নকশা বা আকৃতিকে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে তাতে বিস্মিত বোধ করেন তিনি। কুপার মনে করেন, এ প্রযুক্তির সেরা সময় এখনও আসেনি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এখনও অনেক বাকি। 

১৯৭৩-এর পরবর্তী দশক সেলফোনের বাণিজ্যিক সংস্করণ বাজারে আনার কাজে ব্যয় করেন কুপার। বেতার যোগাযোগ শিল্পকে শুরু করার কাজে সহায়তা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বে বিপ্লব ঘটে গেছে। বিশ্বে সেলফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা, কেনাকাটা করা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ধরা দিয়েছে। 

১৯৫০-এর দশকের জনপ্রিয় কমিক বই 'ডিক ট্রেসি'র কাল্পনিক বেতারঘড়ি কুপারকে সেলফোন আবিষ্কারে উৎসাহিত করেছে। কমিকের নায়ক ডিক ট্রেসি পুলিশ বিভাগে তার সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের কাজে এ ঘড়ি ব্যবহার করত। সেকালে ট্রেসির এই ঘড়িকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি মনে করা হতো। এরই জের ধরে বাস্তব জীবনে অনেক আবিষ্কারক খুদে বহনযোগ্য বেতারযন্ত্র এবং চৌকসঘড়ি বা স্মার্টওয়াচের আবিষ্কারেও উৎসাহিত হয়েছেন। 

এ ছাড়া, হুবহু ডিক ট্রেসির হাতঘড়ির মতা দেখতে ঘড়ি পাওয়া যায় এবং দ্বিমুখী বেতার যোগাযোগ করাও যায়। সেলফোন ঘিরে মার্টিন কোপারের আর স্বপ্নও রয়েছে। তিনি এমন সেলফোন উদ্ভাবনের কল্পনা করছেন যা মানবদেহের বিদ্যুৎশক্তিতেই চলবে। 

মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে ২৭ ফেব্রুয়ারি দেওয়া বক্তব্যে কুপার আরও বলেন, 'সেলফোন, চিকিৎসা প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা অসুখ-বিসুখকে জয় করতে পারব। খাবার খাই, দেহে শক্তি জোগাই। ত্বকের তলে, কানের ভেতরে বসানো শব্দধারক যন্ত্র বা রিসিভারকে কেন দেহ শক্তি জোগাবে না?' 

ইউরোপে ডাটার গোপনীয়তা রক্ষার কঠোর আইনকানুন রয়েছে। অ্যাপ ও ডিজিটাল বিজ্ঞাপন সেলফোনসহ অন্যান্য যন্ত্র ব্যবহারকারীর চালচলন, স্বভাব-আচরণের ওপর নজর রাখে। এতে প্রযুক্তি কোম্পানিসহ অন্যান্যরা এসব যন্ত্র ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য থেকে শুরু করে অনেক কিছু সম্পর্কেই ভালোভাবে জানতে পারে। কুপার মনে করেন এ সমস্যার সমাধান হবে। তবে খুব সহজে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ হবে না। 

কুপার বলেন, 'আপনি কোথায় আছেন, কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন, কে কে আপনাকে কল করছে, ইন্টারনেটে আপনি কোথায় কোথায় ঘোরাঘুরি করছেন—সবই একদল মানুষ ঠিকই জানতে পারেন।' পাশাপাশি শিশুদের স্মার্টফোন ব্যবহার সীমিত করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি। 

কুপার ইন্টারনেটকে বয়সোপযোগী করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, 'পাঁচ বছরের শিশুর শিক্ষণের কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করা উচিত। আমরা চাই না সে পর্নসাইটগুলোতে যাক। বা এমন কোনো কাজকর্ম করুক যার অর্থ সে ঠিকভাবে বোঝেও না।' 

নিজের ফোন ব্যবহার সম্পর্কে কুপার বলেন, 'ই-মেইল দেখতে ফোন ব্যবহার করি। এ ছাড়া, খাবার টেবিলের তর্কাতর্কিতে তথ্য জোগাতে ফোনের সাহায্য নিই। সেলফোনের সঙ্গে যুক্ত অনেক কিছুর ব্যবহার এখনও শিখে ওঠেননি সেলফোনের জনক।' 

তিনি বলেন, 'টিকটক যে কী, তা এখনও আমি জানি না।'

৩. 

সেলফোন এসে ঘড়ির দিন শেষ করেছে। রেডিও করেছে দফারফা। গান শোনার ওয়াকম্যান-ট্যান উঠে গেছে। ক্যামেরাকুল অকুল পাথারে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। কোনো কোনো দোকান-পাটের কারবার গেছে চুকেবুকে। অনেক কাজে ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটারকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে হয়তো পাসপোর্ট-ভিসারও জানাযা পড়াবে। 

এ রকম আরও ফিরিস্তি আউড়ানোর পর আমাদের বয়সে বড় এক বন্ধু বললেন, 'এবারে যদি ওই ফোনের মধ্যে একটু থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিত, তাহলে খুবই উপকার হতো। দ্যাখ তো, ভাই, কোনো বিজ্ঞানীকে বিষয়টা বুঝাতে পারিস কি না!'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.