হিরো আলমের উত্থান ও সাখাওয়াত স্যারের এসাইনমেন্ট 

মতামত

11 February, 2023, 12:50 pm
Last modified: 11 February, 2023, 12:54 pm
হিরো আলমকে আমরা যতোই হাস্যকর প্রতিপন্ন করতে চাই না কেন বা ট্রল করি না কেন, তাতে যে তার কিচ্ছু আসে যায়না, প্রান্তিক মানুষের কাছে জনপ্রিয়তাই এর প্রমাণ। হিরো আলমের সফলতা এখন এমনই যে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সেক্রেটারি জেনারেল তাকে নিয়ে কথা বলছেন, বিতর্কে জড়িয়েছেন। হিরো আলম আলোচনায় আসছেন। সামাজিক মাধ্যমে ট্রল থেকে শুরু করে ডয়েচে ভেলের মতো আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে হিরো আলমকে নিয়ে কথা বলছে। ব্যক্তি বা শিল্পী হিসেবে আমরা যতোই তাকে তুচ্ছ বলে মনে করি না কেন, কফির টেবিলের আলোচনায় এখন হিরো আলমের নাম শোনা যাচ্ছে। 

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে থাকাকালে ইন্টারপারসোনাল কমিউনিকেশন বিষয়টি পড়ার সময় 'হিরো থেকে জিরো বা জিরো থেকে হিরো' বাক্যটির সাথে পরিচিত হই। মানুষের কাজের ফলাফল হিসেবে এটা ঘটতে পারে। ঠিক যেমনটা ঘটেছে আমাদের হিরো আলমের ক্ষেত্রে। নাম হিরো হলেও উনি ছিলেন জিরো, মানে একদম নগণ্য মানুষ; পরে ইউটিউবের কল্যাণে হয়ে গেলেন একেবারে হিরো।

উনি কিভাবে হিরো হলেন তা অবশ্য এখন মিডিয়ার কল্যাণে সবাই জানেন। এরপরেও কিছু বিষয় আলোচনার দাবি রাখে, যেমন বগুড়ার উপনির্বাচনের এক দিন আগে ফেসবুক লাইভে এসে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার শিক্ষক মখলিছুর রহমান বলেছেন তিনি তার নিজের ব্যবহৃত নোয়াহ মাইক্রোবাসটি হিরো আলমকে উপহার দেবেন। কারণ 'হিরো আলম একসময় জিরো ছিলেন। জিরো থেকে তিনি হিরো হয়েছেন। হিরো আলম এখন সোনার টুকরা'।

আর এর চাইতেও বড় কথা, নানা আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে হিরো আলমকে যখন গাড়ি হস্তান্তর করা হয়, সেদিন সকাল থেকে চুনারুঘাটের নরপতি গ্রামে মানুষের ঢল নেমেছিল। চুনারুঘাট উপজেলা ছাড়াও হবিগঞ্জ সদর, বাহুবল, মাধবপুর উপজেলা থেকেও উৎসুক মানুষ হিরো আলমকে একনজর দেখতে আসেন। তাহলে বুঝেন হিরো আলম কতটা হিরো হয়েছেন।

আশির দশকের মাঝামাঝি 'বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না' সিনেমাটি যখন দেশের প্রেক্ষাগৃহে মাসের পর মাস হাউজফুল, তখন আমাদের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাখাওয়াৎ আলী খান স্যার বলেছিলেন, 'যোগাযোগের ছাত্রছাত্রী হিসেবে তোমাদের জানা উচিৎ কেন বেদের মেয়ে জ্যোৎস্নার মতো এরকম একটি ফোক-ফ্যান্টাসি সিনেমা ব্যবসা সফল হলো? এত ভাল সিনেমা থাকার পরেও কেন অতি সাধারণ একটি সিনেমা দর্শক হৃদয় জয় করলো?' উনি এটা আমাদের এসাইনমেন্টও দিয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত সাখাওয়াৎ স্যার যদি এখন ক্লাস নিতেন, তাহলে হয়তো হিরো আলমের 'এই জিরো থেকে হিরো হয়ে ওঠা'র কাহিনীটা নিয়েও এসাইনমেন্ট দিতেন।

আমাদের যে রাজনীতিবিদরা হিরো আলমকে নিয়ে হাসাহাসি করছেন, তারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে ওনাদের নিজেদের এলাকার বাইরে অথবা দলের সমর্থন ছাড়া ওনাদের দেখার জন্য কয়েকটি উপজেলা থেকে মানুষের ঢল নামবে? ওনারা জানেন বহু নেতার জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে। অনেকের বিরুদ্ধেই চুরি, বাটপারি, জমি-বাড়ি-বাজার দখল, দরিদ্র মানুষের টাকা খাওয়া, টাকা পাচার, হত্যা, ঋণখেলাপির অভিযোগ আছে। 

হিরো আলমকে আমরা যতোই হাস্যকর প্রতিপন্ন করতে চাই না কেন বা ট্রল করি না কেন, তাতে যে তার কিচ্ছু আসে যায়না, প্রান্তিক মানুষের কাছে জনপ্রিয়তাই এর প্রমাণ। হিরো আলমের সফলতা এখন এমনই যে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সেক্রেটারি জেনারেল তাকে নিয়ে কথা বলছেন, বিতর্কে জড়িয়েছেন। হিরো আলম আলোচনায় আসছেন। সামাজিক মাধ্যমে ট্রল থেকে শুরু করে ডয়েচে ভেলের মতো আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে হিরো আলমকে নিয়ে কথা বলছে। ব্যক্তি বা শিল্পী হিসেবে আমরা যতোই তাকে তুচ্ছ বলে মনে করি না কেন, কফির টেবিলের আলোচনায় এখন হিরো আলমের নাম শোনা যাচ্ছে। 

কেন এমনটা হলো? কেন হিরো আলম রাজনীতির মাঠ গরম করতে সচেষ্ট হলেন, কেন মানুষ তাকে হুড়মুড় করে ভোট দিলেন? কেন অন্য জেলার একজন প্রধান শিক্ষক তাকে নিজের ব্যবহৃত গাড়ি উপহার দিলেন? কেন আশেপাশের উপজেলা থেকে হাজারো সাধারণ মানুষ হিরো আলমকে একনজর দেখার জন্য ভীড় করেছিলেন? আমাদের স্বীকার করতেই হবে একটা ক্রেজ কাজ করছে এর পেছনে। 

এই ক্রেজটা কেন তৈরি হলো? বাংলাদেশে শুধু রাজনীতি নয়, শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান, গবেষণা, সাহিত্য প্রতিটা ক্ষেত্রেই মান নিম্নমুখী হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাংলাদেশ যতোটা এগিয়েছে, মানবিক উন্নয়নে ততোটাই পিছিয়েছে। হিরো আলমদের উত্থান কিন্তু একদিনে হয়নি। আমাদের রুচির যে অধোগতি হচ্ছে, তা রোধ করে কার সাধ্য। আজ থেকে প্রায় বছর দুয়েক আগে হিরো আলম বিমান থেকে নামার পর বিমান সংস্থার কর্মকর্তা থেকে কর্মীরা হিরো আলমকে ঘিরে ধরে মোবাইলে সেল্ফি তুলেছেন। হিরো আলম বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রংপুরের একটি খাৎনা অনুষ্ঠানে। তাকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আবার শেষ ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের ইউটিউব চ্যানেলে সবচেয়ে বেশিবার দেখা গানটি আরবি ভাষার। 'হিরো আলমের অ্যারাবিয়ান ফুল গান' শিরোনামে গানটি তিনি ইউটিউবে দেওয়ার পর সেটি দেখা হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ বার। গানের ভিডিওটির নিচে মাজহার নামের এক ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন এমন, 'আমার খুব প্রিয় শিল্পী। মন খারাপ হলে তার গান শুনে কিছুক্ষণ বেহুঁশ থাকি।'

তার এই জনপ্রিয়তা দেখে বাংলাদেশের শ্রোতা দর্শকের রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সঙ্গীতের কোন মানেই তাকে ফেলা যায় না, কিন্তু তিনি বিস্ময়করভাবে অসংখ্য মানুষের প্রিয় হয়ে উঠলেন। গান, নাচ, নাটক বা চলচ্চিত্র সবই একটা চর্চার বিষয়। সবকিছুরই একটা মানদণ্ড আছে। সুর, লয়, তালহীন কোনকিছুকে গান বলা যায়না। অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গী করে, উদ্ভট পোশাক পরে, বাজে উচ্চারণে কিছু করাকে কি গান বলা যায়? অর্থহীন এইসব 'গান' যখন মানুষের কাছে আদৃত হয়, তখন আমাদের দেশের দর্শক-শ্রোতাদের রুচির মান নিয়ে প্রশ্ন উঠাটাই স্বাভাবিক।

একই কথা রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দেশের মানুষ দেখছে রাজনীতির বলয়টা ক্রমশ কম পড়াশোনা জানা টাকাওয়ালাদের হতে চলে যাচ্ছে। সৎ মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তুখোড় রাজনীতিবিদ ও সাংসদ পাওয়াও কঠিন। শিক্ষিত, যোগ্য এবং সজ্জন মানুষ ভোটের মাঠে আসতে ইচ্ছুক হন না। শিক্ষিত তরুণদের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ প্রায় শূন্যের কোঠায়। মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে, মেধাবীরা এদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি এড়িয়ে চলছে। সুশীল মানুষ ভোটের মাঠে বেমানান এবং ওনারা এসে জনসমর্থনও পাননি। আবার এ কথাও ঠিক যে ওনারা বিভিন্ন কারণে নিজেদের 'হোয়াইট কলার' ভেবে সাধারণ জনগণের কাছেও আসেননি বা আসেন না। তাই সুশীল, শিক্ষিত, ভদ্র, সভ্য মানুষের সংখ্যা ভোটের ময়দানে প্রায় নেই বললেই চলে। 

এই যে রাজনীতি, তা ধীরে ধীরে তুখোড় রাজনীতিকদের হাতছাড়া হয়ে গেছে নানা কারণে। তৃণমূল পর্যায়ের ত্যাগী নেতার সংখ্যা কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে টাকাওয়ালাদের কদর বাড়ছে। হয়তো সেজন্যই সংসদে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দিনে দিনে বাড়ছে। সমাজও সেইসব মানুষকে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।  

হিরো আলম রাজনীতি করবেন কিনা, গান গাইবেন কিনা, বই লিখবেন কিনা এবং সেলিব্রেটি কিনা - এসব নিয়ে কথা বলতে হলে আমাদের উচিৎ ছিল বহু আগে থেকেই দেশে শুদ্ধ রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলা। কারণ বহুদিন ধরেই এই মানদণ্ডগুলো অধঃমুখী, এমনকি এখনো আমরা মান বিষয়ে নিশ্চুপ।

দর্শক-শ্রোতা চাইলে হিরো আলম দেশের এক নাম্বার গায়ক হোক, ভোটে জিতে সাংসদ হোক, কোটি টাকা আয় করে ধনী হোক, এতে কারো কোন কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা যারা যারা সুস্থ রাজনীতি চাই, শিক্ষিত রাজনীতিবিদ চাই, শুদ্ধ সমাজ ও সংস্কৃতি চাই তারা কি এই দাবিতে সোচ্চার হই? 

একজন মাননীয় সাংসদ যখন সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, "আমার বাড়ি ঢাকা। আমার বাসায় ছয়টা গাড়ি সবসময় পইড়া থাকে। কী কী গাড়ি আছে এটা বলব না আমি। বললে মনে করব যে এইটা নিজেকে নিজেই ফুটানি দেখাইতেছি। এই যে আমার হাতে ঘড়িটা দেখতেছেন, এক কোটি টাকা। এই রকম ঘড়ি আমার পাঁচ বাচ্চারেই দিয়া দিছি দুইটা কইরা। এই রকম ঘড়ি আমার বউরে দিয়া দিছি। সেই টাকার উৎস কী, সেটা নিয়ে যেমন কেউ প্রশ্ন তোলে না, তেমনি এই সম্পদের ট্যাক্স আদৌ দেওয়া হয় কি না, দিলে কত টাকা ট্যাক্স, সেই কথাও কোথাও ওঠে না" (রুমিন ফারহানা, প্রথম আলো)। 

কার কত টাকা আছে, এই টাকা উনি কিভাবে ছিটাবেন, কোন কাক এসে তা খেয়ে যাবে, এগুলো পারিবারিক বা সামাজিক আলোচনার বিষয়, রাজনীতির নয়। আর সংসদে বসে এইসব কথা বলাতো রীতিমত অপরাধ। কারণ সংসদ চলাকালে প্রতি মিনিটে ২ লাখ টাকা খরচ হয়, আর এই টাকা জনগণের। অধিবেশন চলাকালে সাংসদরা কতজন, কয়দিন, কিভাবে উপস্থিত থাকেন, কী কী বিষয়ে কী কথা বলেন, কে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তুলে ধরেন, কারা নারী বিদ্বেষী কথা বলছেন বা নিজেদের বড়লোকি প্রচার করছেন এগুলো সবই মিডিয়ার কল্যাণে জনগণ জানতে পারে। 

তাই যখন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, হিরো আলমকে সংসদে এনে সংসদকে ফালতু এবং ছোট করার চেষ্টা করা হয়েছে, তখন সত্যিই অবাক হয়ে যাই। যেসব মাননীয় সাংসদ সংসদে এসে জনগুরুত্বপূর্ণ কথা না বলে ব্যক্তিগত কথা বলেন বা শুধু স্তুতিবাক্য পেশ করেন, তারা কি সংসদের ভাবমূর্তি ও গাম্ভীর্যকে হেয় করছেন না? 

লাক্স সাবানের ডাইসে আপনি যদি পঁচা সাবানের (কাপড় কাচার সাবান) উপাদান দেন তাহলে যে সাবানটি তৈরি হবে সেটি দেখতে লাক্স সাবানের মতো হবে, কিন্তু সেটি আসলে পঁচা সাবানই। লাক্স সাবানের জন্য লাক্স সাবানের উপাদানই ডাইসে দিতে হবে- বহুবছর আগে কথাগুলো বলেছিলেন বিচারপতি কে এম সোবহান, যা এখনো আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিকই থেকে গেলো। (তথ্যসূত্র: শওগাত আলী সাগর)।

  • লেখক: যোগাযোগকর্মী 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.