গণতন্ত্র না উন্নয়ন, মানুষ কোনটা চায়!

মতামত

14 November, 2022, 04:25 pm
Last modified: 14 November, 2022, 04:36 pm
উন্নয়ন ভোট আনে না, সাথে গণতন্ত্র লাগে। মানুষের কথা বলার অধিকার লাগে, ভোট দেওয়ার অধিকার লাগে।

গণতন্ত্র না উন্নয়ন মানুষ কোনটার পক্ষে? 

এ প্রশ্নের সহজ উত্তর, মানুষ দুটোরই পক্ষে। শাসকরা একটা ভুল চিন্তায় নিমজ্জিত থাকেন এই ভেবে যে, কেবল উন্নয়ন দিয়েই মানুষের গণতন্ত্রের প্রতি আকাঙ্ক্ষা ঢেকে দেওয়া সম্ভব।
কিন্তু দেশে দেশে প্রমাণিত হয়েছে, উন্নয়নের সাফল্য কাজ করছে না গণতন্ত্রের কাছে। 

২০১৩ সালে ভারতীয় লোকসভার নির্বাচনে গুজরাট উন্নয়নের মডেল দিয়ে ঝড় তোলেন গুজরাটের ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক গণহত্যার সাথে অভিযুক্তরা। নির্বাচনে ভারতীয় কংগ্রেসকে শোচনীয় পরাজয়ের মুখে ঠেলে দিয়ে লোকসভায় ২৮৩টি আসনে জয়লাভ করে তারা। ভারতের স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের বাইরে এই প্রথম একক দল হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করে বিজেপি। এখন তৃতীয়বারের জন্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। নির্বাচন হবে ২০২৪ সালে। এখনো চলছে তাদের সেই উন্নয়নের জয়গান। 

কার্যত তারা তাদের জনপ্রিয়তা হারিয়েছে কতটুকু, তা বোঝা যাবে আসন্ন গুজরাট রাজ্যের নির্বাচনে। সেখানে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে আম আদমি পার্টি।

দল হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি সমর্থক আর এস এস সর্বভারতীয় অবস্থান থেকে সাম্প্রদায়িক ঝড় তুলতে শুরু করে। জোর করে ধর্মন্তারিত করাসহ নানা কর্মকাণ্ড শুরু করে্। পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়। পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদাবিহীন দিল্লির নির্বাচনে মোদির 'উন্নয়নের গল্পো' তৃতীয়বারের মত আম আদমি পাটির নেতা কেজরিওয়ালের কাছে তিনটি আসন থেকে মাত্র পাঁচটি আসন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়।

গত ২০২০ এর নির্বাচনে আম আদমি পাঁচটি আসন হারায় যা বিজেপি'র ঘরে জমা হয়। দিল্লির ৭০ আসনের বিধান সভায় ৬২টি আম আদমি পার্টির আর ৮টি আসন নিয়ে সন্তষ্ট থাকতে ভারতীয় মসনদে আসীন ক্ষমতাসীন বিজেপি'র। 

এতকিছুর পরও মোদি ও তার বিজেপির ঘুম ভাঙেনি। বিহার নির্বাচনের আগে গরু নিয়ে রাজনীতি সামনে নিয়ে আসা হয়। পর্দার পিছনের মুল শক্তি আর এস এস ও বজরং দল। গরু খাওয়া নিষিদ্ধ করা, বাংলাদেশে গরু পাঠানো নিষিদ্ধ করা (যদিও পর্দার অন্তরালে বাংলাদেশে গরু আসতে বাধা না দেওয়া) ইত্যাদি কাজ করতে থাকে তারা। আবারও ধরাশায়ী বিজেপি।

এবারের সংকট আরও তীব্র। যাদের হাত ধরে বিজেপির জন্ম- আদভানি, যোশী, যশোবন্ত- তাদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে মোদি ও অমিত জুটির দল এবং তাদের নির্বাচনী কৌশল। যে আন্না হাজারীর হাত ধরে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন করে ভারত বিজয় করল বিজেপি, সেই বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে আইপিএল দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রাক্তন ক্রিকেট কর্তা ললিত মোদীকে দেশ ছাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় নথি তৈরি করতে সাহায্য করার। 

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, যে ললিত মোদীর বিরোধিতা করে এক সময় একাধিক কংগ্রেস মন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করেছিল বিজেপি, ক্ষমতায় এসে সেই দলেরই অন্যতম নেত্রী ললিত মোদীর ভিসা সমস্যা সমাধানে কী করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন! ফলে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিতে বিলম্ব করেনি। বিহার নির্বাচন প্রমাণ করলো, ভারতের মানুষ উন্নয়নের বদলে সাম্প্রদায়িকতা অথবা দুর্নীতি, কোনটাই মানে না।

পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে বিজেপিকে চমকে দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন হয়। কিছুকাল যেতে না যেতেই নানান দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসে। পশ্চিমবাংলা হাইকোর্টের এক বিচারক পশ্চিম বাংলার মমতা ব্যানার্জি সরকারের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার নানা আদেশ।

মিয়ানমারে আরেক ঐতিহাসিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো বিগত বছর। সেখানেও একই ঘটনা। দীর্ঘ ৫০ বছরের সামরিক শাসন এবং তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী সু চি। নানাভাবে দীর্ঘদিন এই সামরিক শাসক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অবরোধসহ নানা চাপ উপেক্ষা করে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাদের রচিত নতুন সংবিধানের আওতায় নির্বাচন সম্পন্ন হলো। দীর্ঘদিনের সামরিক শাসনের অবসান হলো। নতুন সংবিধানের বিধান অনুযায়ী এক তৃতীয়াংশ পর্লামেন্টের উভয় কক্ষে আসন সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত রেখে হলো এই নির্বাচন।

বিগত কয়েক বছর মিয়ানমারের অর্থনীতিতে জোরালো উন্নয়ন দেখা যাচ্ছিল। সেনা শাসিত সরকার ও সেনা সমর্থিত ক্ষমতাসীন দল উন্নয়নকে পুঁজি করে নির্বাচন ডেকেছিল। ভেবেছিল, ব্যাপক উন্নয়ন তাদের নির্বাচনে জয় আনবে। ঘটলো উল্টোটা। সু চির দলের বিজয় নিশ্চিত ছিল। ফলে আবার মিয়ানমারের সেই সেনা শাসন ফিরে এসেছে। সু চিকে আবার কারাগারে অন্তরীণ করা হয়েছে।

নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবসায়ী দেশগুলো নানা উপায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসায় লিপ্ত। সেই দলে চীন, রাশিয়া, ভারতসহ অনেকেই আছে। সু চির পরাজয় প্রমাণ করে, উন্নয়ন ভোট আনে না, সাথে গণতন্ত্র লাগে। মানুষের কথা বলার অধিকার লাগে, ভোট দেওয়ার অধিকার লাগে।

স্মরণ করা যেতে পারে ইরানের রেজা শাহ পাহলভী'র কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যিনি নিজ পিতার বিরুদ্ধে বৃটিশদের সাথে ষড়যন্ত্র করে হিটলারের নাৎসিবাদের সমর্থক প্রমাণ করে পিতাকে অপসারণ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন রেজা শাহ। ক্ষমতা আরোহণের পর প্রথমে ভুমি সংস্কার করে আমাদের দেশের মত জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে ভূমিহীনদের ভূমি প্রদান করে। এতে  ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন শাহ। এরপর ১৯৭৩ সালে ওপেক গঠন করার ভিতর দিয়ে পেট্রোডলার আয়ের মাধ্যমে ইরানের ব্যাপক মৌলিক ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করেন তিনি, কিন্তু তারপরও ১৯৭৯ সালে স্বপরিবারে দেশ ত্যাগে বাধ্য হতে হয়। 

অন্যদিকে ইরাকে নির্বাসিত ইরানী নেতা খোমেনির ডাকে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয়। ইসলামী বিপ্লবের ৪৩ বছর অতিক্রম হওয়ার পরে নারীরা অধিকার আদায়ের জন্য এখন রাস্তায় নেমেছে। সারা দেশজুড়ে বিক্ষোভ চলছে। প্রচুর হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তরের গণমাধ্যমের তথ্য হিসাবে তিন শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন বলে খবর বেড়িয়েছে। তারপরও বিক্ষোভ থামছে না।

উন্নয়ন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সীমিত করতে পারে না বরং স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো গণতন্ত্র ও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের নিশ্চয়তা।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.