পাকিস্তানের বন্যা: বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন প্রবীণরা, তাই ফলল
২৪ আগস্ট মা আমাকে উদ্ভ্রান্তের মতো কল করে জানায় টানা বৃষ্টিতে আমাদের গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। উত্তর-পশ্চিম সিন্ধু প্রদেশের হামাল হ্রদের তীরে আমার গ্রাম সাবু বুরিরো। এর মাত্র দুই মাস আগেই প্রচণ্ড গরমে হ্রদের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল। বর্ষায় কয়েক সপ্তাহের বৃষ্টিতে হৃদ এতটাই ভরে উঠেছে যে আমাদের রক্ষা করা বাঁধটাও ভেঙে যাওয়ার উপক্রম।
আমি করাচিতে পড়াশোনা করি। সেখান থেকে ১০ ঘণ্টা যাত্রা শেষে গ্রামে এসে দেখি আমার আত্মীয় ও প্রতিবেশিরা সবাই ভয়ে-আতঙ্কে জর্জরিত। সেনাবাহিনীর কয়েকটি ট্রাক কয়েকজন নারী ও শিশুদের সরিয়ে নিতে এসেছিল। বাকিরা শুকনো শস্য, গবাদিপশু ও বাড়িঘর রক্ষা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছিল। সেনাবাহিনীর ট্রাক চলে যাওয়ার পর আর কোনো সরকারি সাহায্য আসেনি। আমি শহর থেকে কমরেডদের ডেকেছিলাম। তারা ভ্যান নিয়ে আসে। বাঁধ ভাঙার আগ পর্যন্ত তিন দিন পাগলের মতো যতটুকু করা যায় তাই করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এরপরই বাঁধ ভাঙে আর বন্যার পানিতে পুরো গ্রাম তলিয়ে যায়।
এই বছরের বিপর্যয়কর বন্যায় বাস্তুচ্যুত হওয়া লক্ষাধিক পাকিস্তানির মধ্যে রয়েছে আমার পরিবারও। প্রাথমিকভাবে বর্ষায় রেকর্ড বৃষ্টির কারণে এই বন্যা হলেও গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। কিন্তু এই বিপর্যয়ের মাত্রাকে আরও বড় করে তুলেছে পাকিস্তানে 'প্রগতির' নামে প্রকৃতির শোষণ। আমাদের দেশের নদীভিত্তিক অবকাঠামো ঘিরে শিল্প ব্যবস্থাপনা বন্ধ করা জরুরি। তা না হলে একইসঙ্গে দেশের পরিবেশ ও অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটবে।
সাবু বুরিরো সিন্ধু প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। কিন্তু প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সিন্ধু ব-দ্বীপে বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ। সেখানে নাটকীয় হারে সমুদ্রের পানি উঠেছে।এটি দুটি কারণে ঘটেছে এবং এর উভয়ের জন্য দায়ী মানুষ। প্রথমত, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের বাঁধ নির্মাণ প্রীতি, যার ফলে পানি প্রবাহ ধীর হয়ে গেছে এবং উন্মত্ত সিন্ধুকে যেন লাগাম পড়ানোর চেষ্টা করছে।
পাকিস্তানের বাঁধ নির্মাণের উন্মাদনা শুরু হয় ১৯৬০-এর দশকে। দিন দিন তা বেড়েছে। নদীর উৎসের কাছাকাছি পাঞ্জাব প্রদেশে জ্বালানি শক্তির চাহিদা পূরণ হলেও আমাদের সিন্ধু অঞ্চলের জনজীবনকে উপেক্ষা করা হয়েছে। নদীর বাঁধ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক দিকগুলো আমাদের জন্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এর কারণে যেমন সিন্ধু নদীর ব-দ্বীপ হ্রাস পেয়েছে, তেমনি ভারী বর্ষায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।
নদীর বাঁধের কারণে বহু জমিতে খরা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জায়গায় আর চাষাবাদও সম্ভব নয়। এই জিনিসগুলো যখন ঘটে তখন ওই সব অঞ্চলের দরিদ্র মানুষ শহরমুখী হয়। কিন্তু সেখানে তাদের থাকার জায়গা মিলে না। প্রতিনিয়ত অবজ্ঞার শিকার হয় এবং শেষ পর্যন্ত অনাকাঙ্খিত সব জায়গায় মাথা গুঁজে তারা।
পাকিস্তানের প্রথিতযশা জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আলি তৌকির শেখ সম্প্রতি এক ব্যাখ্যায় বলেন, 'বাস্তুচ্যুত মানুষদের নিজ অঞ্চলে আর কিছু না থাকুক, সামাজিক পুঁজি থাকে। নতুন এলাকায় তারা প্রান্তিক হয়ে যায়। তাদের আর্থিক ও অন্য কোনো নিরাপত্তাও থাকে না।'
আমি দেখেছি একই রকম চ্যালেঞ্জ আমাদের সাবু বুরিরো ঘিরেও তৈরি হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে আমাদের আবাদী জমির উৎপাদন কমে গেছে। উজান থেকে আসা বর্জ্য নিষ্কাশনে আমাদের মাটি বিষাক্ত হয়ে গেছে। গ্রামের প্রায় সকলের মতো আমার জীবদ্দশাতেই পরিবারের গবাদি পশুর সংখ্যাও নাটকীয়ভাবে কমতে দেখেছি। এটি সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। শুকনো জমির কারণে, গবাদি পশুও আগের মতো খাবার পায় না।
গত সপ্তাহগুলোতে বন্যার কারণে আমার পরিবার ও প্রতিবেশিদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার বিষয় সামলানো আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। এখনও অনেকেই তাঁবুতে কিংবা খোলা আকাশের নিচে বাস করছে। আমরা ও ভাইবোনদের মতো অনেকে কাছাকাছি শহর কাম্বারে আছে। কিন্তু সেখানেও থাকার পর্যাপ্ত জায়গা নেই ও পরিবেশ খুবই অস্বাস্থ্যকর। তারা কখন সাবু বুরিরোতে ফিরতে পারবে? ফিরে গেলেও কী পাবে?
বন্যার কারণের সিন্ধুর ৯০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। আমার ভাই একজন কৃষক। তিনি বললেন এই বছর অক্টোবরে গমের ফসল রোপণের সময়েও পানি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই,। আমাদের পরিবারসহ গ্রামের অন্যরা পানিবাহিত রোগে গবাদি পশু হারিয়েছে। পালের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে এসব অসুখ। গবাদি পশু আমাদের পুষ্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এগুলো আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো। বিয়ে কিংবা জরুরি চিকিৎসার মতো সময় এগুলো বিক্রি করে টাকা পাওয়া যায়। কুরবানি ঈদের এদের কুরবানি দেওয়া হয়।
২০১০ সালেও আমরা একই রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম। সেবারও এক ভয়ঙ্কর বন্যা এসে পাকিস্তানকে গ্রাস করেছিল। এরপর থেকে আমাদের গ্রামের প্রবীণরা সতর্ক করে আসছিলেন যে এর পরবর্তী বন্যা আরও ভয়াবহ হবে এবং সেটা সামলে ওঠার ক্ষমতাও আমাদের থাকবে না। তারা দেখেছিলেন কীভাবে সামন্তবাদী অভিজাত শ্রেণি আর সরকারের বাজে পরিকল্পনা আমাদের নদীর স্বাভাবিক গতিপথে হস্তক্ষেপ করেছিল। বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন তারা। সেটাই এবার সত্যি হলো।
তরুণরাও আমাদের পরিবেশের পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করছে। দারিদ্র্য, কৃষিকাজ এবং পড়াশোনার হাত থেকে বাঁচতে এখনকার অনেক তরুণ-তরুণী উপসাগরীয় দেশগুলোতে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে যেতে চায়, রেমিটেন্স আনতে চায় যার ওপর বাড়ছে আমাদের নির্ভরতা। শুধু বেঁচে থাকার জন্যই কাজ করে যাচ্ছে তারা। যারা রয়ে গেছে তাদের অনেকেই দাবি করছে কর্মকর্তারা যেন নদীপথ নিয়ে লোকজ জ্ঞানগুলোর কথায় গুরুত্ব দেন এবং বাঁধ নির্মাণের উন্মাদনা বন্ধ করেন। কিন্তু এটা তাদের পক্ষে একা করা সম্ভব না।
পাকিস্তানি হিসেবে আমরা আমাদের সরকারকে এর দায় থেকে মুক্তি দিতে পারি না। আমাদের বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আরও সক্রিয়ভাবে দাঁড়াতে হবে। একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সহনশীলতা বৃদ্ধি ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আরও উন্নত নীতিমালা চাইতে কার্যকরভাবে সংঘবদ্ধ হতে হবে। বিশ্ববাসীকেও দাঁড়াতে হবে আমাদের পাশে।
বিশ্ব নেতারা যখন নভেম্বরে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনের মিশরে জড়ো হবেন, তখনও আমাদের ভূমি পানির নিচে থাকবে। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা মানবিক বিপর্যয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন এবং বিশ্বকে মনে করিয়ে দেবেন আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি- যদিও কার্বন নির্গমনের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশের জন্য দায়ী আমাদের দেশ। এই সংকটের প্রতিক্রিয়ায় মানবিক সহায়তার বিষয়ে অবশ্যই আলোচনা বাড়াতে হবে, তবে পাকিস্তানের জনগণের যা প্রয়োজন তা হলো ক্ষতিপূরণ যার কারণে এসব ঘটনার সূত্রপাত। এগুলো শুধু ধনী দেশ থেকেই আসতে পারে।
আমি যখন সাবু বুরিরো থেকে চলে আসি তখন আমার লাইব্রেরির বইগুলো বাক্সে ভরে বন্যার করুণায় ছেড়ে আসতে হয়েছিল। সেখানে রয়ে যাওয়া বইগুলোর মধ্যে একটি হলো ডেভিড ওয়েনের 'হোয়্যার দ্য ওয়াটার গোজ: লাইফ অ্যান্ড ডেথ এলং দ্য কলোরাডো রিভার'। এই বইটি আমাকে দেখিয়েছে কীভাবে কলোরাডো থেকে সিন্ধু পর্যন্ত আমরা সবাই সেই একই শক্তির সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছি। আপনি যেখানে বসেই এই লেখা পড়ছেন না কেন, মনে রাখবেন আমার জন্মভূমি আপনার সঙ্গেও কোনো না কোনোভাবে সংযুক্ত।
আশা করি শিগগিরই বাড়িতে ফিরতে পারব আর দেখব পানি এসে আমার লাইব্রেরিটা ধুয়ে যায়নি! সেখানে ইঁদুরের খাবার সংকটও তৈরি হয়েছে নিশ্চিত। আমার ভয় হচ্ছে আগে আগে পৌঁছাতে না পারলে যা অবশিষ্ট আছে তাও ইঁদুরের পেটে যাবে।
- লেখক পরিচিতি: ইব্রাহিম বুরিরো পাকিস্তানের আওয়ামী ওয়ার্কার্স পার্টির একজন সংগঠক। বর্তমানে তিনি উন্নয়ন অধ্যয়নের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এবং করাচিতে বাস করছেন।