চীন-তাইওয়ান সম্পর্কের বেড়াজাল এবং চলমান উৎকণ্ঠা

মতামত

14 August, 2022, 03:05 pm
Last modified: 18 August, 2022, 04:04 pm
তাইওয়ানের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ নিয়ামকটি হলো এর অর্থনীতি। বর্তমানে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম যেমন ফোন থেকে শুরু করে ল্যাপটপ, ঘড়ি– সবকিছু তৈরিতেই ব্যবহৃত হয় সেমিকন্ডাক্টর যার সিংহভাগই আসে তাইওয়ান থেকে।

চীন এবং তাইওয়ানের মাঝে চলমান উত্তেজনাকে অনেকেই ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের সমান্তরালে দেখছেন। চীনের দক্ষিণ-পূর্বাংশের উপকূলীয় এলাকা থেকে মাত্র ১০০ মাইল দূরে অবস্থিত তাইওয়ান একটি দ্বীপ। প্রায় ২৪ মিলিয়ন লোকের বসতি এখানে। চীন তাইওয়ানকে একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসেবে দেখে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং 'আধুনিক পরাশক্তির জাতীয় পুনরুজ্জীবন' শীর্ষক ঘোষিত নীতির অংশ হিসেবে তাইওয়ানকে শান্তিপূর্ণভাবে মূল ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে, স্বশাসিত এই দ্বীপের জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই নিজেদেরকে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে স্বতন্ত্র এবং আলাদা একটি জাতি বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তাদের নিজস্ব সংবিধান আছে এবং সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন ব্যবস্থা পরিচালনা করা হয়। বর্তমানে কেবল ১৩টি দেশ (এবং ভ্যাটিকান সিটি) তাইওয়ানকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ইউক্রেনের মতো তাইওয়ানও দীর্ঘকাল ধরে শক্তিশালী প্রতিবেশীর পাশে অবস্থান করছে। তাইওয়ান এবং ইউক্রেনের মাঝে অনেক সাদৃশ্য থাকলেও, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈসাদৃশ্যও বিদ্যমান। তাইওয়ানকে ঘিরে কোনো সংঘর্ষের সূত্রপাত হলে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরিভাবে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল, যা ইউক্রেনের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। তাইওয়ানকে নিয়ে যুদ্ধ বাধবে, এখনো সেরকম কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যুদ্ধ যদি বাধে, তবে তা বিশ্বের সর্ববৃহৎ দু'টো সামরিক শক্তিকে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে, বিপরীত দিকে অবস্থান করবে দু'টো বৃহত্তম অর্থনীতি। তাই তাইওয়ানকে ঘিরে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা হবে আরো ব্যাপক, সুদূরপ্রসারী এবং উদ্বেগজনক।

চীন-তাইওয়ান উত্তেজনার সর্বশেষ

চলতি মাসের ২ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফরে যান। সফরটির কয়েকদিন আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে শি জিনপিংয়ের ফোনালাপ হয়। সেখানে পেলোসি যেন এই সফরে না যান, তা পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া হয়েছিল। তবে পেলোসি তাইওয়ান থেকে ফিরে আসার পরপরই, চীন সামরিক মহড়া চালায়, উপকূলে রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। স্মরণকালে তাইওয়ানের উপর এত বড় সামরিক অভিযান চীন কখনোই চালায়নি।

তাইওয়ান কি সবসময়ই তাহলে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল?

ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়, এই দ্বীপটি প্রথম সম্পূর্ণভাবে চীনের নিয়ন্ত্রণে এসেছিল ১৭ শতকে, চিং সাম্রাজ্যের সময়। তবে ১৮৯৫ সালে জাপানের সাথে প্রথম সাইনো-জাপানিজ যুদ্ধে পরাজয়ের পর জাপানের কাছে তাইওয়ানকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় চীন। প্রায় অর্ধশতক ধরে জাপান একে শাসন করেছিল। কিন্তু ২য় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর চীন আবার এর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল, তাতে অক্ষশক্তির সমর্থনও ছিল।

কিন্তু চীনের মূল ভূখণ্ডে চাং কাই-শেকের জাতীয়তাবাদী সরকার এবং মাও সে তুংয়ের সমাজতন্ত্রী দলকে ঘিরে হওয়া গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। কাই-শেক এবং তার দলের অবশিষ্টাংশ যেটি কুয়োমিনটাং নামে পরিচিত, সেটি নিয়ে তাইওয়ান পালিয়ে যান। সেখানে বেশ কয়েক দশক ধরে তাইওয়ান শাসন করেন তারা। অন্যদিকে মাওয়ের দল বেইজিং দখল করে নেয়। কাই-শেক চেয়েছিলেন মূল ভূখণ্ডে ফিরে গিয়ে কমিউনিস্টদের হাত থেকে চীনকে ফিরিয়ে আনবেন। তবে সেটি আর বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে তাইওয়ানের মানুষ চীনকে পৃথক ভাবতে পছন্দ করেন।

চীন-তাইওয়ানের সম্পর্কের সমীকরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন প্রাসঙ্গিক

তাইওয়ান তথাকথিত 'প্রথম সারির দ্বীপপুঞ্জের' একটি। এই সারিতে যারা অবস্থান করছে, তাদের প্রত্যেকের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির জন্যও তাই এই বন্ধুপ্রতিম অঞ্চলগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চীন যদি তাইওয়ান আক্রমণ করে দখলে নিয়ে ফেলে, তাহলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার পশ্চিমাংশে স্বাভাবিকভাবেই আরো সহজে ক্ষমতার প্রদর্শন করতে পারবে। এমনকি গুয়াম এবং হাওয়াইয়ে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিগুলোর জন্যও তা হবে হুমকিস্বরূপ। তবে এখন পর্যন্ত চীন দাবি করছে যে তারা শান্তিপূর্ণভাবেই এগোতে চায়।

চলতি বছরের মে মাসে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে একটি সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র কি তাইওয়ানকে সামরিকভাবে সুরক্ষা দেবে কি-না, তা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। বাইডেন এতে সম্মতিসূচক উত্তর দেওয়ায়, পরবর্তী সময়ে দ্রুতই হোয়াইট হাউজ থেকে স্পষ্ট করা হয় যে 'এক চীন' নীতির ক্ষেত্রে তাদের প্রশাসনের অবস্থান পাল্টায়নি। কিন্তু অনেক বারণ থাকা সত্ত্বেও আগস্টে পেলোসির মতো একজন হেভিওয়েট কংগ্রেস সদস্য তাইওয়ান সফরে যাওয়ায়, এটি চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে কিছুটা অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

১৯৭৮ সালের স্বাভাবিকীকরণ চুক্তির পর বেইজিংয়ের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের উন্নতি হওয়ায় তাইওয়ান ক্রমেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে আসছিল, তা বহাল থাকবে কি-না, তা নিয়ে বিচলিত ছিল। তবে ১৯৮২ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান তাইওয়ানকে ছয়টি ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি জারি রাখা, তাদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অপরিবর্তিত রাখা, স্বাভাবিকীকরণ চুক্তিতে কোনো পরিবর্তন না আনা এবং চীনের সাথে কোনো সমঝোতায় যেতে তাইওয়ানকে বাধ্য না করা এর মধ্যে অন্যতম।

তাইওয়ানকে স্বাধীন করার যেকোনো চেষ্টা যুদ্ধে গড়াবে বলে ইতোমধ্যেই সতর্কবাণী দিয়েছে চীন, ছবি: রয়টার্স

কৌশলগত অস্পষ্টতা

আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার 'এক চীন' নীতি মেনে চলে যেটি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকেই দেশটির একমাত্র বৈধ সরকার বলে স্বীকৃতি দেয়। তবে তাইওয়ান তাদের নিজেদের অংশবিশেষ বলে যে বক্তব্য চীন দিয়ে থাকে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দেয় না। ১৯৭৯ সাল থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার স্বাক্ষরিত তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্ট অনুসরণ করে আসছে। এটি অনুযায়ী, তাইওয়ানের উপর আসা যেকোনো আগ্রাসন এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে ওয়াশিংটন প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় 'শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ' দেখবে।

তবে চীন তাইওয়ান আক্রমণ করলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করবে কি-না, তার কোনো নিশ্চয়তা এখানে দেওয়া নেই। বরং যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি এবং যোগান দেওয়ার মাধ্যমে সাহায্য করবে যেন তাইওয়ান নিজে থেকেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে – এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক দশক ধরেই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য ওয়াশিংটন কূটনৈতিকভাবে বেইজিং ও তাইপেয়ের মাঝে এই কৌশল অবলম্বন করছে। তাইওয়ান ইস্যুতে তারা মোটাদাগে অস্পষ্ট।

চীন এবং তাইওয়ানের তৎপরতা

গত কয়েক বছরে তাইওয়ানের পার্শ্ববর্তী এলাকায় চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি শতশত জেট, বোমারু এবং গুপ্তচর বিমান পাঠিয়েছে। তাইওয়ানকে যেন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া হয় কিংবা স্বীকৃতি হিসেবে গণ্য হবে এমন কিছু যেন না করা হয়, সেজন্য চীন অন্যান্য দেশের উপর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কূটনৈতিক চাপ দিয়ে থাকে।

অন্যদিকে, ইউক্রেনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কীভাবে চীনের আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যায়, তা নিয়ে ইতোমধ্যেই তাইওয়ান ভাবতে শুরু করেছে। ইউক্রেনীয় সৈন্যরা ট্যাংক এবং ক্ষেপণাস্ত্র-প্রতিরোধী যে সরঞ্জাম ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছে, তা ক্রয় করার চেষ্টা করছে তাইওয়ান।

চীনের তাইওয়ান আক্রমণ করার সম্ভাবনা কতটুকু

প্রতিরক্ষা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে, চীনের কাছে তাইওয়ান নগণ্য। তাই চীন তাইওয়ান আক্রমণ করলে তা দখল করায়ও সফল হয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে যদি যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পরাশক্তি এখানে হস্তক্ষেপ না করে। এ ছাড়া পেলোসির সফরের পরই চীন যেরকম সামরিক মহড়া চালিয়েছে, তা থেকে বোঝা বাকি থাকে না যে আধুনিক যৌথ মহড়ায় তারা কতটা এগিয়ে গেছে।

তাইওয়ানের উপর পূর্ণ ব্লকেড স্থাপন করার মতো যথেষ্ট সরঞ্জাম নেই চীনের- এমনটা দাবি করেছিল তাইওয়ান প্রশাসন। তবে বেইজিং ইতোমধ্যেই দেখিয়েছে যে উপকূলীয় অঞ্চলে তাদের যে পরিমাণ শক্তি মজুত আছে, তা দিয়ে দ্বীপটির অর্থনীতিকে তারা স্তিমিত করে দিতে সক্ষম। ফলে সরাসরিভাবে সংঘর্ষের ডাক না দিয়েও, তাইওয়ানকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দিয়ে তারা পরাস্ত করতে সমর্থ।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে তাইওয়ান কেন গুরুত্বপূর্ণ

তাইওয়ানের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ নিয়ামকটি হলো এর অর্থনীতি। বর্তমানে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম যেমন ফোন থেকে শুরু করে ল্যাপটপ, ঘড়ি– সবকিছু তৈরিতেই ব্যবহৃত হয় সেমিকন্ডাক্টর। এর সিংহভাগই আসে তাইওয়ান থেকে। যেমন: তাইওয়ানের একটি প্রতিষ্ঠান, টিএসএমসি একাই বিশ্ববাজারের অর্ধেকের বেশি নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রতিষ্ঠানটি একটি 'ফাউন্ড্রি' – অর্থাৎ তারা বিভিন্ন ভোক্তা কোম্পানি এবং সামরিক বাহিনীর জন্য এই কম্পিউটার চিপগুলো তৈরি করে থাকে। ২০২১ এর তথ্য মোতাবেক এই বিশাল ব্যবসাটি ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ছিল। তাই চীন তাইওয়ানকে দখল করতে পারলে যে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শিল্পখাতও তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

অ্যাপলের মতো অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এই টিএসএমসির তৈরি সেমিকন্ডাক্টরের ভোক্তা, ছবি: স্যাম ইয়েহ

চীন-তাইওয়ান ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান

উল্লেখ্য, তাইওয়ানের সাথে কখনোই বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। বাংলাদেশ এই ইস্যুতে সবসময়ই 'এক চীন' নীতির অবস্থানে অটল ছিল এবং সামনেও এই পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশের এ অবস্থানকে সাধুবাদও জানিয়েছে চীন।


এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.