প্রতি মূহূর্তে বদলায় জীবন

মতামত

11 August, 2022, 09:00 pm
Last modified: 11 August, 2022, 09:05 pm
বেলাল চৌধুরী। একদম শেকড়হীন, পিছুটানহীন মানুষ। তিনি সেবার যে গেলেন, আর ফিরে এলেন দশ বছর পর! এতগুলো বছর তিনি এভাবে ভাবলেশহীনভাবেই কাটিয়ে দিলেন। এমনকি সেখানে বিনা নাগরিকত্বে কাটিয়ে দিলেন দশ বছর!

কবি বেলাল চৌধুরী ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত

বেলাল ভাইয়ের (বেলাল চৌধুরী) সঙ্গে আমি একসময় চাকরিও করতাম। সময়টা মনে হয় ১৯৮০-র দিকে। সেসময় বাংলাদেশ টুডে নামে একটা ইংরেজি পত্রিকাও বের হতো। মানসম্মত মাসিক পত্রিকার মধ্যে এটি ছিল একটা।

সেই পত্রিকায় যারা কাজ করতো তারা সবাই ইংরেজি জানা মানুষ ছিলেন। বেলাল ভাই কিন্তু এত দক্ষ ছিলেন না ইংরেজিতে। কিন্তু পরিচিতি আর সম্পাদকীয় দক্ষতার জন্য তাকে রাখা হয়েছিল।

হুটহাট সব সিদ্ধান্ত নিতেন

একদিন অফিসে বসে আমরা কাজ করছি। এমন সময় পিয়ন এসে জানালেন, বেলাল ভাইকে একজন লোক খুঁজছে। বাইরে দাঁড়ানো। 

অফিসের ভেতরে কেউ ঢুকতো না সাধারণত। বেলাল ভাই চলে গেলেন দেখতে। আর আমরা কাজ করছি এদিকে। এরপর কী এক দরকারে আমরা বেলাল ভাইকে তখন খুঁজছিলাম। পিয়নকে বললাম, বেলাল ভাই কোথায় আছে দেখে আসার জন্য। পিয়ন এসে জানালো, 'স্যার তো সেই লোকের সঙ্গেই চলে গেছে।'

বেলাল ভাইয়ের এরকম হুটহাট সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যাস ছিল। কখন যে কোথায় চলে যেতেন, তার ঠিক ছিল না! বেলাল ভাই যে জীবনে কতবার এমন করেছেন তার হিসেব নেই।

কলকাতায় যাওয়াটা যেমন। বেলাল ভাইয়ের এক আত্মীয় ছিলেন খুলনার খুব বড় ব্যবসায়ী। তাদের একটা জাপানিজ জাহাজ এসেছিল বঙ্গোপসাগরের মাছের ওপর গবেষণা করতে।  '৭১ সালের আগের ঘটনা। যা-হোক, জাপানিজ ওই দলটি বাংলা ভাষা তেমন জানত না। তাই তাদের সাহায্য করতে বেলাল ভাই তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।

এরপর এখানের কাজ শেষে একদিন তারা বেলাল ভাইকে বললেন, আমরা তো কলকাতা যাব। তুমিও যাবে আমাদের সাথে? বেলাল ভাই বললেন, হ্যাঁ যাবো। তিনি নৌকা থেকে না নেমে বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে কলকাতায় চলে গেলেন!

অনেকটা শেকড়হীন, পিছুটানহীন মানুষ

এটাই আসলে বেলাল চৌধুরী। একদম শেকড়হীন, পিছুটানহীন মানুষ। তিনি সেবার যে গেলেন, আর ফিরে এলেন দশ বছর পর! এতগুলো বছর তিনি এভাবে ভাবলেশহীনভাবেই কাটিয়ে দিলেন। এমনকি সেখানে বিনা নাগরিকত্বে কাটিয়ে দিলেন দশ বছর!

এমনকি পুলিশের তোপের মুখেও পড়তে হয়নি বেলাল ভাইকে। এ ব্যাপারে আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলছিলেন, 'যে আমাকে ধরবে, সে-ই তো আমার সঙ্গে আড্ডা দেয়'। পুলিশ যার সঙ্গে আড্ডা দেয়, তাকে ধরবে? বেলাল চৌধুরীর বন্ধুই ছিলেন পুলিশপ্রধান। তিনিও একজন কবি ছিলেন। নাম, আয়ান রশীদ খান। ভারতের বড় কবি ছিলেন তিনি।

আমি বেলাল ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আপনার চলতো কী করে?' বেলাল ভাই বলেছিলেন, 'কীভাবে যে চলে যেতো আমিও জানিনা'।

বেলাল ভাইকে নিয়ে একবার শুনেছিলাম তিনি নাকি বিভিন্ন বন্ধুবান্ধবের বাসায় থাকতেন। কিন্তু কোনোটাই স্থায়ী না।

কবরস্থানের ভিতর ছোটো একটা ঘর বানিয়ে থাকতেন

কলকাতায় থাকাকালীন তিনি একটি শান্তির জায়গা পেয়েছিলেন। সেটা হলো কবরস্থান। এক কবরস্থানের ভিতরেই ছোটোমতো ঘরে থাকা শুরু করলেন। কাজ করতেন হয়তো কোনো পত্রিকায়, কিন্তু আমার ধারণা ওখানেও আড্ডাই দিতেন বেলাল ভাই। যেরকম আড্ডাপ্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি!

পত্রিকা অফিস থেকে অনেকগুলো বই নিয়ে এসে, তার ওপর চাদর বিছিয়ে, বেলাল ভাই শুতেন। কিন্তু তাতেও সমস্যা হতো। বই তো সব সমান হয় না। কোনোটা ২০০ পৃষ্ঠার, কোনোটা ৩০০ পাতার। এরপর মাটিতেই শুতে শুরু করলেন।

ছবি: সংগৃহীত

একবার সত্যি সত্যি বেলাল ভাইকে পুলিশ খোঁজা শুরু করলো। ঠিকই পুলিশ তাকে কবরস্থানে খুঁজে বের করলো। কিন্তু বেলাল চৌধুরী তো অনন্য মানুষ। বেলাল চৌধুরী সেই পুলিশের সঙ্গেই চা-বিস্কিট খেয়ে জমিয়ে দিলেন আড্ডা। যে মানুষ পুলিশকে নিয়ে চা-শিঙাড়া খায়, সে মানুষের কি অসুবিধা হয় কখনো? বেলাল ভাইয়ের জীবনে তাই ঘটলো। বেলাল ভাই এভাবেই সবার কাছে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।

জেলের ভাতও খেতে হয়েছে তাকে! 

বেলাল ভাই খুব কলকাতার গল্প করতেন। কলকাতায় তার ছিল অনেকটা বাউন্ডুলে জীবনযাপন। যাহোক, খালাশিটোলা বলে একটা জায়গা ছিল বন্দরের কাছাকাছি। ওখানে বাংলা মদ খেতে যেতেন তিনি। সুনীল, শক্তিও যেতেন সেখানে। আরেকজন যেতেন, নাম কমলকুমার মজুমদার। প্রতিবার মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরে যাওয়াটা ছিল নিত্যরুটিন।

বেলাল ভাইয়ের এতে সমস্যা হতো না কোনো, একা মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু কমলকুমার মজুমদার থাকতেন অনেক দূরে। প্রতিবারই তাই কেউ না কেউ তাকে বাসায় পৌঁছে দিতেন। বেলাল ভাইও দিতেন।

একদিন, কমলকুমার মজুমদারকে নিয়ে বাসে উঠেছেন বেলাল চৌধুরী। এরমধ্যে পুলিশ এসে টিকিট চেয়েছে। টিকিট তো পকেটে নেই। হারিয়ে গেছে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল দুপক্ষের কথা কাটাকাটি থেকে মারামারি।

এরপর তাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। রাত ১২ কি ১টার দিকে পুলিশের বড়কর্তা এসে দেখলেন তাদের দুজনকে কী হালে রাখা হয়েছে। তিনি কেঁদেই ফেললেন, 'তোমরা করেছ কী! কাকে ধরে এনেছ?' অর্থাৎ বড়কর্তাও কমলকুমারের ভক্তগোছের কেউ। এরপর গাড়ি করে কমলদার বাসায় পৌঁছে দিলেন তাদের। বেলাল ভাই আমাকে বলেছিলেন, 'এই প্রথম আমি কমলদাকে গাড়ি দিয়ে তার বাসায় পৌঁছে দিলাম।'

কমলকুমার মজুমদারের সান্নিধ্যই জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া 

আরেকটা জিনিস বেলাল ভাই কমলকুমার সম্পর্কে বলেছেন। 'কমলকুমার এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যে তার সাথে মিশেছে, সম্মোহনের মতো মিশেছে। কমলকুমার মানুষকে টেনে রাখতে পারতেন। তখন আমাদের যে বয়স, আরও অনেককিছু হয়তো আমাকে টানতে পারতো। কিন্তু কেন যেন, আফসান, কমলকুমার মজুমদারের সঙ্গটাই এত ভালো লাগতো আমার! ওটাই মনে হতো জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।'

বেলাল ভাই খুব পরোপকারী মানুষ ছিলেন

কিন্তু সংসারী ছিলেন না। এভাবে এক কথায় কলকাতায় চলে গিয়ে যে দশ বছরে দেশে না ফিরতে পারে, সেই মানুষটা আর কতটাই সংসারী হতে পারবে?

তবে মায়ের জন্য টান ছিল তার। মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ার পর, দশ বছর পর প্রথম দেখতে এসেছিলেন মাকে। সেবার ফেরত যাবার সময়, বাসেই মায়ের মৃত্যুর খবর শুনতে পান তিনি। 

মায়ের মৃত্যুর পর কিছুদিন গ্রামে থাকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। বেলাল ভাই গ্রাম পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, গ্রামে সবসময় রাজনীতি হয়। 

জীবনবোধ তার কবিসত্তার চেয়ে বড় ছিল 

বেলাল ভাইয়ের জীবনবোধ তার কবিসত্তার চেয়ে বড় হয়ে গিয়েছিল। বেলাল ভাইয়ের ছোটো ভাই ছিলেন সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী। গিয়াস কামাল চৌধুরী ছিলেন একদমই আলাদা।

তিনি রাজনীতি করতেন। আমাদেরও খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে তাকে কখনো দেখিনি। কারণ দুভাই ছিলেন দুরকম। গিয়াস কামাল চৌধুরী ছিলেন খুব গম্ভীর মানুষ। আর বেলাল চৌধুরী ছিলেন একদম নরম কাদার মতো মানুষ।

দেশে ফিরে এসে তিনি সচিত্র সন্ধানীতে কাজ শুরু করেন। তবে তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় মুক্তিযুদ্ধে প্রকল্পে কাজ করার মাধ্যমে। হাসান ভাইয়ের (হাসান হাফিজুর রহমান) কাছে আসতেন তিনি অনেক। খুব পছন্দ করতেন হাসান ভাই তাকে। 

বিয়েশাদি করলেন, ছেলেমেয়েও হলো। খুব সচ্ছল ছিলেন, তা নয়। মদ খেতেন প্রচুর। তবে মদ খাওয়ার কারণে কোনো দুর্নাম ছড়ায়নি তাকে নিয়ে। 

আমার দুটো ঘটনা মনে আছে। একবার ভারতীয় হাইকমিশনের দাওয়াতে বেলাল ভাইয়ের কাছে একজন এসে বললেন, 'আমাদের আর মদ খেতে দিচ্ছে না।' 

বেলাল ভাই প্রত্যুত্তরে বললেন 'মদ খেতে দিচ্ছে না? এটা তো জাতিসংঘের অধিকার।' এরপর তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। 

কখনো কোথাও থিতু হননি 

বেলাল ভাই কত জায়াগায় যে ঘুরে ঘুরে চাকরি করেছেন, আমি বলতে পারবো না সব। বেলাল ভাই শেষ পর্যন্ত গিয়ে একটি পত্রিকার সম্পাদক হয়ে গেলেন। ভারত বিচিত্রা নামে এই মাসিক পত্রিকা বের করতো ভারতীয় হাইকমিশন। সে সময় ওই পত্রিকা এত সুনাম ছড়ালো! আর হবে না কেন। বেলাল ভাই ছিলেন ওই পত্রিকার সম্পাদক। 

আমার সবচেয়ে সেরা লেখাটাও আমি বেলাল ভাইয়ের পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম। বেলাল ভাই যেসব মানুষের লেখা নিতে পারতেন, এদেশের আর কেউ সেটা পারবে না। কারণ, বেলাল ভাইয়ের মতো সেই দক্ষতা অন্যদের কমই ছিল। বেলাল ভাইয়ের কাছে সব সাহিত্যিক, সাংবাদিকরা যেত।

এরকম মানুষ তিনি একজন ছিলেন, আরেকজন ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। বেলাল ভাই কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না। একবার আমার ভিসা নিয়ে সমস্যা হলো। ভারতীয় হাইকমিশনেই বসেন বেলাল ভাই, তাকে গিয়ে ধরলাম। তিনি আমাকে বললেন, 'তুমি একটু বোসো, আমি আসতেছি।' এই বলে উনি ভিতর থেকে আমার ভিসাটা করিয়ে নিয়ে আসলেন। তার কথার মূল্য ছিল। তাকে মানুষ খুব পছন্দ করতো বলেই তার পক্ষে কোনো কাজই কঠিন ছিল না।

বেলাল ভাই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন 

কিন্তু তিনি কখনো ভাষা অন্দোলনে তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কিছু বলতেন না। এজন্য আমরা তাকে জানিও না। 

তবে বেলাল ভাই তার কবিতার ব্যাপারে অনেক নিরাসক্ত ছিলেন। তিনি কত বড় কবি, বা কেমন কবি এসব নিয়ে তার কোনো চিন্তাও ছিল না। তিনি হয়তো বুঝতেন, তার কবিতার চেয়ে তার জীবন বড়। মানুষের কাছেও কবি বেলাল চৌধুরীর কবিতার চেয়ে তার রঙিন জীবনটাই ফুটে উঠতো বেশি।


  • লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.