ক্ষমা করে দেবেন শর্মিলী আপা আমাদের ব্যর্থতার জন্যে!

মতামত

09 July, 2022, 04:00 pm
Last modified: 09 July, 2022, 04:17 pm
আজ মনে হচ্ছে বেঁচে থাকতে গুণী শিল্পীদের আমরা মর্যাদা দিতে পারিনি। এঁরা এমন একটি প্রজন্মের শিল্পী যারা শুধু শিল্পকে সাধনার বিষয় হিসেবে গণ্য করেননি। শিল্প তাঁদের জীবন থেকে আলাদা কিছু ছিল না।

শর্মিলী আহমেদ আজ আর নেই। তাঁর মৃত্যুর খবর টেলিভিশন এবং ফেসবুকে খুব দ্রুত ছড়িয়েছে, অথচ তিনি যে অসুস্থ ছিলেন সে খবর কোনো মিডিয়াতে তেমন প্রকাশ পায়নি। আমরা মৃতদের নিয়ে অনেক কান্নাকাটি, হা হুতাশ করা জাতি- এ কথা শর্মিলী আহমেদ ছাড়া অন্যান্য গুণীজনদের বেলায়ও আমরা দেখেছি।

অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদের খুব ভক্ত আমি। নাটকে শর্মিলী আহমেদ, দিলারা জামান, ডলি জহুর, আবুল হায়াত থাকলে নায়ক-নায়িকা যেমনই হোক এই নাটক দেখার আগ্রহ আমার সব সময় হতো।

আমরা শুধু নাটক দেখিনা, আমরা অভিনয় দেখি। সেই অভিনয় শর্মিলী, দিলারা জামান, ডলি জহুর, আবুল হায়াত – এরা দিতে পারেন; দিয়েছেন আন্তরিকভাবে। এখন তাদের তেমন ডাকা হয় না, তাই অভিনয়ের পারদর্শিতা কমেছে, অভিনয় শিল্পীদের সংখ্যাও কমেছে। হয়তো ডিজিটাল মাধ্যম এর জন্য কিছুটা দায়ী হতে পারে। সিনেমাতেও শর্মিলী আহমেদ অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখেছেন। 'অবির্ভাব' সিনেমাতে তাঁর অভিনয় আমাকে খুব আপ্লুত করেছে।

শর্মিলী আহমেদকে আমি চিনতাম তিনি মাজেদা মল্লিক নামে যখন পরিচিত ছিলেন তখন থেকেই। আমার আব্বার চাকুরির সুবাদে আমরা রাজশাহীর সেরিকালচারে থাকতাম। শর্মিলী আপার বাবা তোফাজ্জল হোসেইন আব্বার কলিগ ছিলেন। তখন লিলি আপা (শর্মিলী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, আমি কেবল মেট্রিক পাশ করে কলেজে ঢুকেছি। কলেজে ঢোকা মানে পরবর্তী ধাপ বিশ্ববিদ্যালয়। এমন চিন্তা মাথায় থাকতো। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তোফাজ্জল চাচার বড় মেয়ে! তিনি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছেন। অতএব তাঁকে দেখা মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোঁয়া পাওয়া।

ছুটিতে বাড়িতে এলে তাঁকে দেখার আমার খুব ইচ্ছা হতো, দেখতে যেতাম। তাঁর খুব সুন্দর ব্যক্তিত্ব আমাকে খুব আকর্ষণ করতো। তাঁর অনেক প্রতিভা সেটাও জানতাম। চাচী (শর্মিলী আপার মা) দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। তিন একপেঁচে শাড়ি পরতেন খুব পরিপাটি করে। তাঁর শরীরের গড়নের সাথে খুব মানাতো। দেখতে খুব মার্জিত লাগতো। আমাদের খুব স্নেহ করতেন, আম্মার সাথে ছিল তাঁর মহা ভাব। তোফাজ্জল চাচা খুব ভাল অভিনয় করেন, আব্বা সেসব কথা আমাদের বলতেন। তার ভাই বোনেরা সবাই প্রতিভাবান। একটা খুব সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল পরিবারে। এই পরিবারের খুব খ্যাতি ছিল। গতকাল আমার আম্মার সাথে শর্মিলী আপার মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সেই সব স্মৃতি আবার ভেসে উঠলো।

দীর্ঘদিন পর শর্মিলী আপা যখন খুব জনপ্রিয় অভিনেত্রী, তখন ঢাকায় আবার দেখা হয়েছে। তাঁর ছোট বোন ওয়াহিদা মল্লিক জলিও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসেছেন। আমার বড় বোন ফেরদৌস আখতার লিলি এসব অনুষ্ঠান আয়োজন করে যোগাযোগগুলো করতেন। আজ আমার বোন লিলি বেঁচে থাকলে এ খবর শুনে নিশ্চয়ই খুব আফসোস করতেন। শর্মিলী আপা প্রবর্তনায় এসে টাঙ্গাইলের শাড়ি পছন্দ করে কিনতেন। তখন আমরা থাকলে শাড়ি বাছতে বাছতেই হেসে হেসে অনেক গল্প করতেন। আম্মা কেমন আছেন জানতে চাইতেন।

আজ কত কথাই মনে পড়ছে। সাথে এটাও মনে হচ্ছে বেঁচে থাকতে গুণী শিল্পীদের আমরা মর্যাদা দিতে পারিনি। এঁরা এমন একটি প্রজন্মের শিল্পী যারা শুধু শিল্পকে সাধনার বিষয় হিসেবে গণ্য করেননি। শিল্প তাঁদের জীবন থেকে আলাদা কিছু ছিল না। কারণ তাঁদের নিজের জীবনেও তাঁরা শিল্পকে আত্মস্থ করবার সাধনা করেছেন।

সম্প্রতি একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে শর্মিলী আহমেদ বলেন, এখনকার নাটকে তাঁদের আর তেমন কাজ থাকে না। মাসে দু'চারদিনের বেশি কাজ পাওয়া যায় না। ফলে একধরনের বিষন্নতা জাগে।

মনে হচ্ছে একট জেনারেশন চলে গেল, যাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা শিল্প ও জীবন যাপনের ধারণাও দ্রুত অপসৃত হয়ে যাচ্ছে।
ইতিহাস সম্ভবত নির্দয়। ক্ষমা করে দেবেন শর্মিলী আপা আমাদের ব্যর্থতার জন্যে।

আপনি ভাল থাকুন, আল্লাহ আপনাকে ভাল রাখুক।

ফরিদা আখতার/ প্রতিকৃতি- টিবিএস
  • লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী

 

 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.