‘তালেবান বিজয়’ পশ্চিমা সভ্যতা বিস্তারের একটি বড় ব্যর্থতা

মতামত

ডিং গাং
20 August, 2021, 11:20 am
Last modified: 20 August, 2021, 11:23 am
বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার ও অন্যান্য উপসভ্যতা বা বিশ্বাসকে রূপান্তর কিংবা জয় করার পশ্চিমাদের এই 'স্বভাব' ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে।

আজ থেকে ৫০০ আগে শুরু হয় বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা সভ্যতার বিস্তার, যা এখনো চলমান। তবে পশ্চিমা সভ্যতার এই সম্প্রসারণে সাম্প্রতিক 'তালেবান বিজয়' দেখা দিয়েছে বড় ধরনের ব্যর্থতা হিসেবে। যদিও পশ্চিমাদের এই সম্প্রসারণ বন্ধ হবে না, আর সেই সঙ্গে তালেবানদের পালটা আক্রমণের ফলে ধর্মীয় মৌলবাদীতা আরও বেশি নজরে আসবে।

আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের সাম্প্রতিক পরাজয় শুধু সামরিক পরাজয় নয়। ৫০০ বছর আগে পাশ্চাত্য সভ্যতার বিস্তারের  শুরু থেকেই খ্রিস্টান ও মুসলিমদের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এ শুধু সম্পদের দ্বন্দ্বই ছিল না, বরং এই দ্বন্দ্ব ছিল আদর্শ, ধারণা ও বিশ্বাসকেন্দ্রিক।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের একটি প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে। সেটি হলো, এখন আর তথাকথিত পশ্চাৎপদ সভ্যতাকে রূপান্তর কিংবা জয় করার ক্ষেত্রে শক্তির ব্যবহার কাজ করবে না; কারণ আজকের পৃথিবী যখন পশ্চিমারা দক্ষিণ আমেরিকা জয় করেছিল- সেই ৫০০ বছর আগের পৃথিবীর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।

তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, পশ্চিমা সভ্যতা প্রাকৃতিক এবং সামাজিক বিজ্ঞানের মতো ক্ষেত্রগুলোকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে, যা সবসময়ই মানুষের উপকারে আসবে।

যাহোক, পশ্চিম সবসময়ই সবার ওপর এক ধরনের ধর্মীয় ও আদর্শিক মিশন নির্ধারণ করে আসছে। সেইসঙ্গে তারা বিশ্বজুড়ে অবিরামভাবে সম্পদ ও বাজার দখল করে চলেছে। মূলত তাদের এই মিশন ও কর্মকাণ্ডের কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে চলছে নিরন্তর যুদ্ধ, যা উন্নয়নশীল দেশগুলার ওপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।

বিশেষ করে, পশ্চিমের রাজনৈতিক মানদণ্ডকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ফলে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুসারে একটি স্থিতিশীল উন্নয়নের পথ তারা কখনো খুঁজে নিতে পারেনি।

আফগান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৪৭ সালে। তবে এই সাম্রাজ্যের শক্তি উনিশের শতকে এসে কমতে শুরু করে। দুর্বল হয়ে যাওয়া সাম্রাজ্যের দখলকে কেন্দ্র করে তখন রাশিয়া ও ব্রিটেনের মাঝে বাড়তে থাকে দ্বন্দ্ব।

আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী হলো পশতুন। দ্বিতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের (১৮৭৮-১৮৮০) পর, ১৮৯৩ সালে ডুরান্ড লাইন প্রতিষ্ঠিত হয়, যার মাধ্যমে ব্রিটেন ও রাশিয়ার মাঝে আফগানিস্তান একটি বাফার স্টেটে (বা, অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দুই দেশের মাঝে ভৌগোলিকভাবে অবস্থিত দুর্বল রাষ্ট্রে) পরিণত হয়।

এর ফলে ব্রিটিশ-ভারতের পশতুনরা আফগানিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যায়। ব্রিটিশ-ভারত তখনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গতই ছিল। ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করে, তখন তারা ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রে বিভক্ত করে দিয়েছিল। আর তখন থেকেই ডুরান্ড লাইন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মাঝে একটি অবিরাম সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

২০১৬ সালে সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বলেছিলেন, আফগানিস্তান ডুরান্ড লাইনকে কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মাঝে সীমানা হিসেবে মেনে নেয়নি। তিনি এটিকে 'দুই ভাইয়ের মধ্যে তৈরি বিদ্বেষের এক প্রাচীর' হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

২,৬৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুরান্ড লাইনের বেশিরভাগ অংশই উঁচু পাহাড়ের মাধ্যমে বিভক্ত; কোথাও নির্জন মরুভূমি, আবার কোথাও উঁচু শৃঙ্গের মধ্য এই রেখা টানা হয়েছে। এই রেখার দু'পাশের অঞ্চল সবসময়ই বিশ্বের সবচেয়ে বদ্ধ, বিপজ্জনক ও দরিদ্রতম  অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই নিশ্চিতভাবেই এটি চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ সম্প্রসারণে বেশ সুবিধাজনক অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত।

তালেবানও ঠিক এ রকম সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক এলাকাতেই বেড়ে উঠেছে। তারা কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনে বিশ্বাসী এবং বাহ্যিক সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে চরমপন্থী।  

১৯৭৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং দেশটির রাজনৈতিক আদর্শকে তাদের মতো পরিবর্তনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু মাত্র এক দশকের মধ্যেই ১৯৮৯ সালে, ইসলামি কট্টরপন্থীদের প্রতিরোধে সোভিয়েতের চরম পরাজয় হয় আফগান ভূমিতে।

এরপর ৯/১১ পরবর্তী সময়ে তালেবান সরকার আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে সমর্থন দিচ্ছে- এমন অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্র। বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরের প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়ার অভিযোগে মার্কিন নেতৃত্বে ২০০১ সালে শুরু হয় ন্যাটো বাহিনীর আফগান অভিযান। উদ্দেশ্য ছিল তালেবানকে চরম শিক্ষা দেওয়া।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেই সময়ের গুরুত্বের জায়গা আর এখনকার গুরুত্বের জায়গাগুলো এক নয়। তখন সন্ত্রাসবাদ নির্মূলই ছিল মার্কিনিদের প্রধান লক্ষ্য। আর এখন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসূচীর ফর্দে আরও অনেক বিষয় যুক্ত হয়েছে।

৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের গণতান্ত্রায়নে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছিল। তারা ভেবেছিল, সে সময়ের ইরাক আক্রমণ আরববিশ্বে গণতন্ত্রের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে উঠবে। আফগানিস্তানকেও তারা তাদের মধ্যপ্রাচ্য গণতন্ত্রায়ন কর্মসূচীরই একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছিল।

বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার ও অন্যান্য উপসভ্যতা বা বিশ্বাসকে রূপান্তর কিংবা জয় করার পশ্চিমাদের এই 'স্বভাব' ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এমন চিন্তাধারা এবং এ থেকে আবির্ভূত নীতিই আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর পতন ডেকে এনেছে। কারণ বর্তমান বিশ্বে একের ওপর অন্যের বিশ্বাস, সভ্যতা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো জোর করে চাপিয়ে দেওয়া অসম্ভব।

মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর কিছু পশ্চিমা মিডিয়া দুঃখজনকভাবে অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র তার মিশন শেষ না করেই আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছে; অথচ এটা তাদের মিত্রদের প্রতি একটি আঘাত ছাড়া আর কিছুই নয়।

ইতিহাস আমাদের দেখায়, পশ্চিমা সভ্যতা সম্প্রসারণের এই মিশন সম্পূর্ণভাবেই ক্ষতির মুখ দেখেছে। যদিও ৯/১১-এর পর গত বিশ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে, কিন্তু যেভাবেই হোক পুরো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার যে মিশন নিয়ে তারা মাঠে নেমেছিল, তা মোটেও পরিবর্তন হয়নি।


  • লেখক: সিনিয়র সম্পাদক, পিপলস ডেইলি; সিনিয়র ফেলো, চংইয়াং ইনস্টিটিউট ফর ফিনান্সিয়াল স্টাডিজ, রেনমিন ইউনিভার্সিটি অব চায়না
  • গ্লোবাল টাইমস থেকে অনুবাদ: জান্নাতুল তাজরী তৃষা

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.