‘অবৈধ’ মানবতা এবং আমাদের আইন

মতামত

26 January, 2021, 02:25 pm
Last modified: 26 January, 2021, 02:29 pm
একজন মানুষ কি কখনো ‘অবৈধ’ হতে পারে? একটি মানবিক সত্তা কি কখনো ‘বৈধ বা অবৈধে’র মাপকাঠি বা মানদণ্ড পরিমাপ হতে পারে?

২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি। ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি রায় দিয়েছিলেন সেদিন। রায়টির বিষয়ে লেখার আগে চলুন এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা জেনে আসি। বেশ আগে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মোহাম্মদ ইলিয়াস আলি বিয়ে করেছিলেন হিন্দু নারী ভাল্লিয়াম্মাকে। ইলিয়াস ও ভালিয়াম্মা দম্পতির ঘর আলো করে একটি ছেলে সন্তান হয়, তার নাম শামসুদ্দিন। একসময় মারা যান ইলিয়াস। কিন্তু সন্তান হিসেবে বাবার সম্পত্তি শামসুদ্দিনের হওয়ার কথা থাকলেও ইলিয়াসের পরিবারের লোকজন তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের দাবি, ইসলামের আইন লঙ্ঘন করে ইলিয়াস হিন্দু নারীকে বিয়ে করেছেন। সুতরাং এই বিয়ের ফলে তাদের যে সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে, সে 'অবৈধ'! ফলে সেই অবৈধ সন্তান সম্পত্তি পাবে না।

উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার সম্পত্তি না পাওয়ায় মামলা করে বসেন ইলিয়াস-ভালিয়াম্মা দম্পতির ছেলে শামসুদ্দিন। শামসউদ্দিন ও তার চাচাতো ভাইবোনদের মধ্যে সম্পত্তির ভাগ নিয়ে বিরোধের জেরে মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। তারই শুনানি শেষে একটি চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন দেশটির শীর্ষ আদালত।

২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি সেই গুরুত্বপূর্ণ রায়ে ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্ট বলেন, একজন মুসলিম পুরুষের সঙ্গে হিন্দু মহিলার বিবাহ 'নিয়মিত বা বৈধ' নয়, তবে এ জাতীয় বিবাহের ফলে জন্মগ্রহণ করা শিশু বৈধ।

আদালত রায়ে বলেন, ওই সন্তান যেহেতু বৈধ, তাই তার বাবার সম্পত্তির ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী সে। বাবার সম্পত্তিতে তার পূর্ণ অধিকার আছে। 

আদালত পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট বলেন, বিয়ের সময় ভালিয়াম্মা হিন্দু ছিলেন। তাই তাদের বিয়ে ধর্মমতে নিয়মবিরুদ্ধ। আবার আইনের চোখে বেআইনিও নয়। সেক্ষেত্রে বিধবা ভালিয়াম্মা ইসলামি আইনে স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারি নন। তবে তার সন্তানের সে সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার আছে।

বিচারপতি এন ভি রমানা এবং মোহন এম শান্তনাগৌদারের বেঞ্চ রায়ে আরও বলেন, একজন মুসলিম পুরুষ যদি আগুনের উপাসক অথবা পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী কোনো নারীকে বিবাহ করেন, তাহলে তাদের বিয়ে নিয়মবিরুদ্ধ বিয়ের উদাহরণ। তবে কোনোভাবেই বেআইনি নয়। অতএব, তাদের সন্তান বাবার সম্পত্তি দাবি করতে পারেন।

এবার নজর দেই বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশে অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট বা সাক্ষ্য আইন নামে একটি আইন আছে। আজ থেকে প্রায় দেড়'শ বছর আগে, ১৮৭২ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় আইনটি প্রণীত হয়। বাংলাদেশ সেই আইন নিজেদের বিধানাবলীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। সেই সাক্ষ্য আইনে সন্তানের বৈধতা নিরূপণ সংক্রান্ত একটি ধারা আছে। বৈধ-অবৈধ সন্তানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সাক্ষ্য আইনের ১১২ ধারায় বলা হয়েছে, 'কোনো ব্যক্তির মাতার সঙ্গে এক ব্যক্তির আইনসিদ্ধ বিবাহ চালু থাকাকালে অথবা বিবাহ বিচ্ছেদের পর ২৮০ দিনের মধ্যে তার মাতা অবিবাহিত থাকাকালে যদি তার জন্ম হয়ে থাকে এবং যদি প্রতীয়মান না হয় যে, ওই ব্যক্তি যখন মাতৃগর্ভে এসে থাকতে পারে অনুরূপ কোনো সময়ে বিবাহিত পক্ষদ্বয়ের পরস্পরের মধ্যে মিলনের পথ উন্মুক্ত ছিল না, তবে জন্মের বিষয় দ্বারা অবশ্যই চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হবে যে সে তার মাতার সঙ্গে বিবাহিত উক্ত ব্যক্তির সন্তান।'

এই ধারাটি চ্যালেঞ্জ করে এবং এটি বাতিল চেয়ে ২০১৯ সালের জুন মাসে একটি রিট করেছিলেন ইশরাত হাসান নামের সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। ওই ধারাটি নিয়ে রিট আবেদনে বলা হয়, সন্তানের পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব পরীক্ষা হতেই পারে। কিন্তু বৈধতা বা সন্তানকে অবৈধ ঘোষণা দেওয়ার ব্যাপারটি একেবারেই অবান্তর। এর মাধ্যমে বৈধ ও অবৈধ সন্তানের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। কোনো সন্তান যদি আদালতের মাধ্যমে বৈধ প্রমাণিত না হয়, তবে তাকে সারাজীবন অবৈধ সন্তানের উপাধি নিয়ে নিগৃহীত হতে হবে এবং সমাজের কাছে ছোট হতে হবে, যা একেবারেই কাম্য নয়।

আবার, ধর্ষণের ফলেও সন্তান জন্মগ্রহণ করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এরকম অসংখ্য ঘটনার নজির রয়েছে। তাই বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তের জন্য একটি নিষ্পাপ শিশুকে অপমান করা যুক্তিযুক্ত নয়।

রিট আবেদনে আরও বলা হয়, এটি ১৮৭২ সালে লিখিত ১৫০ বছরের পুরাতন আইন। ব্রিটিশ আমলে করা এ আইন বর্তমান যুগের জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত। বর্তমান সময়ে ডিএনএ টেস্টের সুযোগ রয়েছে। তাই এ ধারা সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বৈষম্যমূলক। এছাড়া ইউনিভার্সেল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটসের পরিপন্থী।

গত ৯ মার্চ এই রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি রুল জারি করেন। সন্তান বৈধ নাকি অবৈধ, তা বিচার সংক্রান্ত সাক্ষ্য আইনের ১১২ ধারা কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ধারাটি সংশোধন করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চান আদালত। চার সপ্তাহের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

গত ৬ সেপ্টেম্বর এই রুলের মূল লিখিত কপিটি প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেই রুল শুনানি এখনো শুরু হয়নি। আশা করা যায়, দ্রুতই রুল শুনানি শেষে একটি ইতিবাচক রায় আসবে।

এবার মৌলিক নৈতিকতা ও মানবিকতা বোধের প্রশ্নে আসি। একজন মানুষ কি কখনো 'অবৈধ' হতে পারে? একটি মানবিক সত্তা কি কখনো 'বৈধ বা অবৈধে'র মাপকাঠি বা মানদণ্ড পরিমাপ হতে পারে? একজন মানুষ অসৎ হতে পারে, মিথ্যাবাদী হতে পারে, অনৈতিক হতে পারে, লোভী হতে পারে। কিন্তু একজন মানুষ কি কখনো 'অবৈধ' হতে পারে?

একটি সন্তান বা মানুষ জন্মের ক্ষেত্রে 'অনাকাঙ্ক্ষিত' হতে পারে, কিন্তু 'অবৈধ' নয়। কারণ শিশুর জন্ম পদ্ধতি বা পরিস্থিতির ওপর তার কোনো প্রভাব বা হস্তক্ষেপ নেই। সুতরাং কোনো ধরনের মানবিক বা নাগরিক অধিকার হতে সে বঞ্চিত হতে পারে না। কোনো নেতিবাচক বিশেষ শব্দে সে চিহ্নিত হতে পারে না। 

আশা রাখি, চলমান সমাজ থেকে মানুষের ক্ষেত্রে 'অবৈধ' শব্দটির ব্যবহার বন্ধ হবে।

  • লেখক: সাংবাদিক

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.