হোম কোয়ারেন্টিন: সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সুখ

মতামত

ফারহানা রহমান ঊর্মি
06 May, 2020, 12:50 pm
Last modified: 06 May, 2020, 08:54 pm
আমরা অনেকেই ভাবছি, অফিস, রেস্টুরেন্ট, শপিংমল সবই তো একে একে খুলে দেওয়া হচ্ছে, আমরা এখন মুক্ত। কিন্তু না; এখনই সময় নিজ উদ্যোগে পরিবারকে লকডাউন রাখা।

ফারহানা রহমান ঊর্মি

করোনাকালীন সময়ে দামি নয়, স্বল্প মূল্যের খাবারেও ভরিয়ে দেওয়া সম্ভব পরিবারের সদস্যদের মন। হোম কোয়ারেন্টিনের কারণে সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা থেকে দূরে থাকতে পারলেও পারিবারিক দায়িত্ববোধ থেকে নীতিগতভাবে নিজেকে সরিয়ে রাখা অসম্ভব। সময়টা দুর্যোগপূর্ণ হলেও পরিবারের সদস্যদের জন্মদিন, বিয়েবার্ষিকী, শব-ই-বরাত, বাঙালির প্রাণের পহেলা বৈশাখ- এসব উৎসব করোনার জন্য সামাজিকভাবে পারলেও পারিবারিকভাবে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। চলমান রোজা, এমনকি ঈদ ও অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবও পালন হতে পারে এমন সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে।
 
এখন পর্যন্ত আমরা হোম কোয়ারেন্টিনে আছি, আরও কতদিন এই পরিস্থিতি চলবে তাও অনিশ্চিত। আমরা অনেকেই ভাবছি, অফিস, রেস্টুরেন্ট, শপিংমল সবই তো একে একে খুলে দেওয়া হচ্ছে, আমরা এখন মুক্ত। কিন্তু না; এখনই সময় নিজ উদ্যোগে পরিবারকে লকডাউন রাখা। দিন দিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলছে জ্যামিতিকহারে। নিজেকে ও নিজের পরিবারকে এই ভয়ানক থাবা থেকে পরিত্রাণের জন্য এখন থেকেই নতুন করে আবার একটু গুছিয়ে নিতে হবে সবকিছু।
 
মন খারাপ, দেশের পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না, বিশ্বের মন্দাভাব কাটছে না; তাই বলে আমরা কেউ কিন্তু না খেয়ে বসে নেই। এই সংকটকালীন সময়ে গৃহকর্ত্রীকে হতে হবে বৈষয়িক। হালকা কথা হলেও সত্য- ''সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে" আর এই গুণকে কাজে লাগানোর এখনই মোক্ষম সময়।
 
আমরা অনেকেই কিছুটা খাদ্য মজুদ করেছি বা করছি যেন নিত্যদিনের বাজারের জন্য বাইরে গিয়ে করোনা নামক বিপদ ডেকে আনতে না হয়। এই বাজারগুলো কিছুটা অগোছালোভাবে করা হয়ে থাকলে এখন অবশ্যই তালিকা করে গুছিয়ে নিতে হবে, নইলে আমাদের কঠিন সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। এখন আমাদের খেতে হবে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার এবং বর্জন করতে হবে জাঙ্ক ফুড। তাই বলে বাচ্চাদের রুচির বাপারটা একদম ভুলে গেলে চলবে না; অবশ্যই প্রতিটি খাবার হতে হবে স্বাদযুক্ত। আর তাই প্রতিটি মেনু পরিকল্পনা করতে হবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে "স্বল্প মূল্যে বৈচিত্র্যময় খাবার"।
 
বাজারের তালিকা করার সময় অবশ্যই তালিকায় বেশি রাখতে হবে শুকনো ও উচ্চ ক্যালোরি সমৃদ্ধ খাবার- যা সংকটকালীন সময়ে বিপদের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। যেমন- চাল, বিভিন্ন ধরনের ডাল, আলু, আটা, ছোলা, চিড়া, মুড়ি, মিষ্টি আলু, খেজুর, বিভিন্ন রকম বাদাম- এ জাতীয় খাবার অধিক সময় পর্যন্ত এনার্জি ধরে রাখতে সহায়ক।
 
কয়েকটি পাত্রে রেখে দিতে পারেন খেজুর, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম ও কিসমিস। এ জাতীয় খাবার যেমন এনার্জি দেবে ঠিক তেমনই হালকা ক্ষুধা নিবারণ করবে। দৈনন্দিন রুটিনে রাখতে হবে কালোজিরা, মধু এবং কিছুক্ষণ পর পর হালকা কুসুম গরম পানিতে লেবু ও আদা কুচি মিশ্রিত পানীয় পান করতে হবে। করোনাকালীন সময়ে এই জাতীয় খাবারগুলো অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত ও ফলদায়ক।
 
ডিম ও মুরগির মাংস দিয়েই আমিষের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করতে হবে এবং এই সময়ে মাছের দিক থেকে দৃষ্টি কিছুটা সরিয়ে আনতে হবে। যানবাহন চলাচলের সীমাবদ্ধতার কারণে টাটকা মাছ পাওয়া দুষ্কর এবং করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। এজন্য ঝুঁকি এড়াতে তাজা মুরগির মাংস ও ডিম খাওয়াটাই শ্রেয়। বাসায় যেহেতু এখন সাহায্যকারীর সংকট, সে ক্ষেত্রে সবজি কেনার সময় খোসা ছাড়ানোর ঝামেলা আছে এমন সবজি কেনা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করুন। এতে কাজটা অনেকটা সহজ হয়ে আসবে।

এ সময়ে বেগুন, ঢেঁড়স, সিম, বরবটি, ফুলকপি, পাতাকপি ইত্যাদি সবজি বাছাই করুন। খোসাযুক্ত সবজির মধ্যে গাজর, কাঁচাকলা ও মিষ্টিকুমড়া নির্বাচন করতে পারেন।


 
পরিবারের সদস্যদের মানসিকভাবে আনন্দে রাখা একজন গৃহিণীর প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। সেক্ষেত্রে রান্নার ধরন কিছুটা বদলে ফেলে খাবারকে করে তোলা সম্ভব উৎসব উপযোগী। যেমন- দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় আমরা বিভিন্ন সময় বুটের ডাল, সুজি ও গাজর রাখছি। সচরাচর যে পদ্ধতিতে আমরা রান্না করি সেভাবে না করে রেসিপিতে কিছুটা ফিউশন এনে সেগুলো দিয়ে হালুয়া তৈরি করে পরিবারের সদস্যদের মন ভরিয়ে দেওয়া সম্ভব। আলু, ডাল, ডিম, বেগুন, কালোজিরা ইত্যাদি আমাদের নিত্যদিনের সবচেয়ে স্বল্প মূল্যের খাবার; কিন্তু সেগুলোকে রান্না না করে ভর্তা করে পান্তা অথবা গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করে অনেক মা'ই পহেলা বৈশাখের দিনটিকে করে তুলেছিলেন উৎসব মুখর।
 
বিরহের দিন কাটাচ্ছি ভেবে বসে থাকলে নেমে আসবে হতাশা। আর এই হতাশা থেকে সুরক্ষা দিতে পারেন পরিবারের মা-বোনেরা। নতুন নতুন কাজে বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগে বুদ্ধির উৎকর্ষতা বাড়বে বৈ কমবে না। বাচ্চার জন্মদিন যে সব সময় বড় পরিসরে করতে হবে ব্যাপারটা তেমন নয়, বাচ্চার আনন্দটাই এখানে মুখ্য। সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের জন্য কেক তৈরি করে বা দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যে মুরগি রান্না হতো শুধু রেসিপি বদলে ফেলে সেই মুরগি দিয়ে একটু বিরিয়ানি রান্না করেও পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে বাচ্চাদের খুশি করা সম্ভব। 

এমনকি রোজার সময় জিলাপি ছোট-বড় সবারই খুব পছন্দের খাবার। ভাবছেন কেক ও জিলাপির ভালো রেসিপি জানা নেই বা অনেক সরঞ্জাম লাগবে যেগুলো বাসায় আছে কিনা, শুধু একটু বুদ্ধি প্রয়োগ করে ইউটিউবে সার্চ করে দেখুন। জিলাপি ও লকডাউন কেকের রেসিপির লিংক দিয়ে ভরে গেছে রান্নার ইউটিউব চ্যানেলগুলো। এমনকি এসব তৈরি করতে লাগবে মাত্র ২/৩টি উপাদান। ইফতারিতে কেমিক্যালযুক্ত পানীয়ের পরিবর্তে পান করা যেতে পারে লেবু বা কাঁচা আমের শরবত।  
 
এই সংকটময় সময়ে বাচ্চাদের বাসার কাজে অভ্যস্ত করতে হবে। এতে যেমন গৃহিণীর কাজের চাপ কিছুটা কমবে, তেমনি একে অপরের কাজের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। যা পরবর্তীকালে সন্তানের একটি বড় শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে কাজে লাগবে। তবে বাচ্চাদের ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করতে হবে। বাড়ির সদস্যদের মধ্যে নারী-পুরুষ, ছোট–বড় এত ভেদাভেদ না করে এই সংকটকালীন সময়ে সকল সদস্যকে দায়িত্বের সঙ্গে প্রতিটি কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে।
 
সবাই ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন ও পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে সহায়তা করুন। আসুন নিজের পরিবার নিয়ে ভালো থাকি এবং অন্যকে ভালো থাকতে সহায়তা করি।     

  • লেখক: মানবসম্পদ প্রধান, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.