সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা

মতামত

31 May, 2021, 10:25 pm
Last modified: 31 May, 2021, 10:25 pm
পৃথিবীর কোথাও কোনো সমাজেই উগ্র সন্ত্রাসবাদী ও সামাজিক বিভেদ সৃষ্টিকারী মতবাদকে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।

বিশ্ব গত এক দশকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি নিয়ে নতুন মাত্রার বিতর্কে জড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ভূমিকা ও বহির্বিশ্বের প্রতি তাদের অবস্থান এই দুইয়ের মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার গৃহীত সংবিধানে ১৭৯১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে জনগনের পাঁচটি অধিকার বা স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে। যেটা, "বিল অব রাইটস" নামে পরিচিত। বিল অব রাইটসে, ধর্মের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, একত্রিত হওয়ার স্বাধীনতা ও সরকারের কাছে আবেদনের অধিকার প্রদান করা হয়। দেশটির জন্মের ইতিহাস প্রায় আড়াইশো বছরের। এই আড়াইশো বছরের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, দেশটিতে কখনো গণমাধ্যমকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। যদিও পৃথিবীর বহু দেশে গণমাধ্যম নিষিদ্ধ হওয়া কিংবা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম, এই ইতিহাস বিদ্যমান। আবার মার্কিন মদদে আফগানিস্তানের মাটিতে ধর্মীয় বিভাজন দেশের অভ্যন্তরে বিরাজমান ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বীর প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। তালেবান গোষ্ঠির জন্মদানকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবার আফগানিস্তানেই ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত করে। ফলে মার্কিনদের নিজের দেশে এক নীতি অন্য দেশে ভিন্ন নীতি পরিলক্ষিত হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোড়াতে ১৩টি রাজ্য নিয়ে গঠিত হওয়া এবং দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ৫০টি রাজ্য নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান অর্থনীতির উত্তরাধিকার হওয়া- এ সবকিছুর অন্তর্নিহিত শক্তি হলো, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু এই মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও তার পরিধি সবাই তার মত করে খুঁজে ফিরছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে যে সকল সন্ত্রাসী মতবাদ প্রকাশ করা হয়, তা কি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পর্যায়ে পড়ে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপকতার এই সময়ে বিষয়টি আরো বেশি সামনে চলে এসেছে। বিশেষ করে অনুন্নত সমাজে। বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছুকাল যাবত ধর্মীয় স্বার্থন্বেষী মহল নির্বিঘ্নে তাদের উগ্র ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করে বেড়িয়েছে। কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নয়। দেশের একবারে আনাচে কানাচে ওয়াজ মহফিলের নামে ধর্মীয় হিংসা বিদ্বেষ ও নারীর প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য দিয়ে চলেছে। এর ফলে অন্য ধর্মের মানুষে প্রতি ঘৃণা ও নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পেলেও এদের প্রতি প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এখানে প্রশ্ন হলো, আমাদের প্রচলিত আইনের প্রতি অজ্ঞতা, নাকি আইন প্রয়োগে অবহেলা, নাকি এক ঢিলে অনেক পাখি মারার মত একটি আইন তৈরি করে নেওয়া। দেশের অখণ্ডতা, ধর্মীয় সম্প্রীতি, সামাজিক বিভাজন রোধ ও যে কোন সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য নুতন কোনো আইনের প্রয়োজন নেই, দেশের প্রচলিত আইনেই এগুলোর সুরক্ষা দেয়া সম্ভব।

পৃথিবীর কোথাও কোনো সমাজেই উগ্র সন্ত্রাসবাদী ও সামাজিক বিভেদ সৃষ্টিকারী মতবাদকে 'মত প্রকাশের স্বাধীনতা' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। উন্নত দেশগুলোতেও একই অবস্থা বিরাজমান। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে অন্য নাগরিকের অধিকার, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ভঙ্গ করা যাবে না। এটি স্বভাবজাত ও স্বাভাবিক একটি বিষয়। এখানে নুতন আইনের কোন দরকার নাই। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর জন্য এক নীতিমালা প্রকাশ করেছে। হোয়াটসঅ্যাপ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে অভিযোগ তুলেছে যে, এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে তার  সেবা গ্রহণকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপণীয়তা বিঘ্নিত হবে। ফেসবুক তার অবস্থান এখনও স্পষ্ট করেনি। এখন দেখার অপেক্ষা ভারতীয় আদালত হোয়াটসঅ্যাপ প্রশ্নে কী সমাধান দেয়। তবে পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কোনো বক্তব্য, 'মত প্রকাশের স্বাধীনতা' হতে পারে না।

এখন প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও ব্যক্তির নিরাপত্তা কীভাবে পরিমাপ করা যাবে। এটা সরকার পরিচাপলনাকারী রাজনৈতিক দলের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের বিষয় নয় বরং সমাজের মধ্যেই বিষয়গুলোর মীমাংসা হয়ে থাকতে হবে। চিন্তার সামাজিকীকরণের ব্যর্থতা বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের অনেকগুলো অনুন্নত সমাজে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এর দায়ভার সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত রাষ্ট্র নিজে গ্রহণ না করে নানান কায়দা-কৌশল অবলম্বন করে। কোথাও দমন- নিপিড়ন, গুম-খুন, ক্রসফায়ার, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ইত্যাদি নানা রূপে রাষ্ট্রকে দেখা যায়।

মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও জননিরাপত্তা পারস্পারিক সম্পর্কিত বিষয়। রাষ্ট্রের দাবি রোজিনা ইসলাম রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছেন। তথ্য সংগ্রহ করা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা কিনা তা বিশ্বব্যাপী কোনো মানদণ্ড তৈরি হয়নি। আমাদের ২০০৯ সালে প্রণীত তথ্য অধিকার আইন রয়েছে। তথ্য প্রাপ্তি মানুষের 'অধিকার' এবং তথ্য প্রবাহ অবাধ করার লক্ষ্য নিয়ে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই আইনের লক্ষ্য পূরণ কতটা সফল হয়েছে সে প্রশ্ন এখন উঠতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত লীগ অব নেশনে মানুষের অধিকার ও মানবাধিকারের ঘোষণা এবং ১৯৪৯ সালে সার্বজনীন মানবাধিকার সনদে বহু বিষয়ের মীমাংসা করা হয়। মানবাধিকার সনদের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদ (যেটা আর্টিকেল নাইটিন নামে পরিচিত) মানুষের মত ও অভিব্যক্তি প্রকাশের অধিকার দেয়া হয়। এই অধিকারের মধ্যে আরো বলা হয়, বিশ্বের যে কোন মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য অর্জন করা এবং অন্য কোথাও সেই তথ্য বা চিন্তা প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। ১৯৬৬ সালে "নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি (আই সি সি পি আর) দ্বারা কারো সম্মানহানি ও জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তবে কিছু ক্ষেত্রে মানবাধিকার সনদের ১৯ অনুচ্ছেদের অবাধ চর্চা রহিত করা হয়। আই সি সি পি আর চুক্তির মাধ্যমে মর্যাদাহানি, কুৎসা রটানো, পর্নোগ্রাফি, অশ্লীলতা, আক্রমাণাত্মক শব্দ এবং মেধাস্বত্ত, বাণিজ্যিক গোপনীয়তা, জননিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা যদি অন্য কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে বা কারো অপকার করে তবে "অপকার নীতির" আলোকে বাকস্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে।

হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকসহ বেশ কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একধরনের 'নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা' তৈরি করেছে। সমাজের জন্য ক্ষতিকর মনে করলে তারা সেটি নিরুৎসাহিত করে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য প্রচারিত হলে চলমান সহিংসতা বৃদ্ধি পেতে পারে এই বিবেচনায় কোনো কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু এ ব্যবস্থা সর্বজনীন হতে পারে না। মার্কিন সমাজে যা ক্ষতিকর বাংলাদেশের সমাজে তা ক্ষতিকর নাও হতে পারে। রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সামাজিক ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা কোনটা সমাজের জন্য ক্ষতিকর, তার কোনটা সঠিক মাত্রা পৃথিবীতে ঠিক হয়নি। পৃথিবীর বহু দেশে সমকামিতার বৈধতার জন্য প্রকাশ্যে আন্দোলন যেমন হয় তেমনি করে আবার মুসলিম সংখ্যাধিক্য দেশগুলোতে এই ধরনের কথা প্রকাশ্যে বলা আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ। সে কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলির নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হবে না যতক্ষণ এটাকে 'প্রসঙ্গ ও অঞ্চল নির্দিষ্ট' করা না যাবে।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে ইসলাম 'সুরক্ষার' নামে বেশকিছু মাওলানা দীর্ঘকাল যাবত সমাজে যে হিংসা ও বিদ্বেষ সৃষ্টির করে চলেছে যার পরিণতিতে নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে তাদের আক্রমণ ও হিংস্রতার যে প্রকাশ তারা করেছে, তার জন্য প্রশাসন কী ব্যবস্থা নেয় তা দেখার অপেক্ষা করছে সবাই। কিছু গ্রেফতার হয়েছে। অর্থ যোগানদাতা কিছু চিহ্নিত হয়েছে। ধর্মীয় নেতাদের অর্থ তছরূপের কিছু কিছু কাহিনী সামনে আসলেও সবকিছু সরকারের সদিচ্ছার উপর অনেকটা নির্ভর করছে। ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনার পর তাদেরকে কোথাও কোনো জবাবদিহিতার মধ্যে আসতে হয়নি। ফলে সংখ্যায় আজকে তাদের অবস্থান বিশাল আকার ধারণ করেছে। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা ও ধর্মীয় অপব্যাখ্যার ফলে ক্রমান্বয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটছে আমাদের দেশে। অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি নামক গবেষণা গ্রন্থে ধর্মীয় ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার আবরণে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত মাত্র আট কিলোমিটার মহাসড়কের দুইপাশে প্রায় ৭০টি মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে মাত্র দুইটি সরকারী বাকিগুলো কওমি মাদ্রাসা, যার কোন হিসাব কেউ দিতে পারে না। এই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা এখুনি বন্ধ করা দরকার। সরকারের ইচ্ছা, অনিচ্ছার প্রশ্ন নয় বরং সবকিছু নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। তাহলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে যা উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত।

  • লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.