সবকিছু স্বাভাবিক: তাহলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে অসুবিধা কোথায়?

মতামত

শাহানা হুদা রঞ্জনা
26 February, 2021, 10:00 am
Last modified: 26 February, 2021, 10:03 am
ছাত্ররা প্রশ্ন তুলেছে আর কতসময় আমাদের বাইরে থাকতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিন, আমাদের ক্লাশ করতে দিন। করোনার কারণে কোনকিছুই তো বন্ধ নেই, তাহলে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজা কেন বন্ধ?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলের ছাত্ররা তালা ভেঙ্গে হলে প্রবেশ করেছে। বাকিরাও হয়তো তাই করবে, আর কয়েকদিনের মধ্যে। নানাধরণের অসুবিধার কারণে ছাত্ররা আর বাইরে থাকতে চাইছে না। শিক্ষাজীবনে আবাসিক হলই হচ্ছে তাদের বাসস্থান। তারাতো চাইবেই নিজের জায়গায় ফিরে আসতে। এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও একই কাজ করেছে।

ছাত্ররা প্রশ্ন তুলেছে আর কতসময় আমাদের বাইরে থাকতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিন, আমাদের ক্লাশ করতে দিন। করোনার কারণে কোনকিছুই তো বন্ধ নেই, তাহলে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজা কেন বন্ধ? সবচেয়ে বিম্ময়কর ব্যাপার হলো, হল না খোলার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে হলে "গাদাগাদি করে থাকলে করোনা ছড়াবে"। 

কর্তৃপক্ষের দেখানো কারণ শুনে হাসি পেলো। দেশে গত ৩/৪ মাস ধরে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে হোটেলে রুম খালি নাই। প্লেন-বাস-ট্রেনের টিকেট পাওয়া দুরুহ। সাগর দেখতে এত মানুষ যাচ্ছে যে পেছনে দাঁড়ালে সাগর দেখা যায়না। এছাড়া গ্রামের বাড়ি যাওয়া, মার্কেটে যাওয়া, হোটেল-রেষ্টুরেন্টে খেতে যাওয়া --- কোনকিছুইতো বাদ নেই। সবখানেই এভাবে গাদাগাদি করে সবাই সবকিছু চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে অহেতুক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার মানে কী।

বাংলাদেশে গাদাগাদি অবস্থা নাই কোথায়? করোনাকালে যখন সাধারণ ছুটি চলেছে, তখনও তো আমরা হাত ধরাধরি করে, প্রায় মাস্কবিহীন অবস্থায়, যেমন-তেমনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি। আর এখন হল খোলার সময় এই অদ্ভ'ত কারণ দেখানো হচ্ছে। সেটা কেন মানবে ছাত্ররা? আরেকটি বিষয় হচ্ছে কর্তৃপক্ষ স্বীকার করছে যে ছাত্রছাত্রীরা গাদাগাদি করে থাকে। তাহলে কেন এই 'গাদাগাদিত্ব' ঘোচানোর ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা? 

বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ছে এবং যারা পড়াচ্ছেন, তারা প্রত্যেকেই স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জানেন। কাজেই অনলাইনে ক্লাস নেয়া বন্ধ করে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া উচিৎ। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক ছেলেমেয়েই টিউশনি করে বা অন্য ছোটখাট কাজ করে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। এমনও ছাত্র আছে, যে হলে থেকে ৪/৫ টিউশনি করে নিজে পড়ে এবং বাবা-মাকেও টাকা পাঠায়। এদের আয় ও জীবনধারণ একেবারে বন্ধ হওয়ার পথে।

এমনও ছাত্রছাত্রী আছে, যাদের জন্য মোবাইলের ড্যাটা খরচ করে প্রতিদিন ক্লাস করা কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা ক্লাস রুমের পড়া আর মোবাইলের পড়ার মধ্যে ব্যাপক ফারাক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইলে এখুনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিতে পারেন। এমনকী রোজার ছুটিও না দিতে পারেন। দ্রুত ক্লাসে ফিরিয়ে এনে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি পূরণ করতে হবে।

আমরা সকলেই স্বীকার করছি করোনাকালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা খাত। এ ক্ষতি টাকার অঙ্কে মাপা যাবে না। সারাদেশে অন্তত পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু যে পড়ার ক্ষতি তা নয় বা পরীক্ষায় বসতে না পারার ক্ষতি এমনও নয়। এই ক্ষতি আরো অনেক বেশি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস জীবন ছাত্রছাত্রীদের যা দিতে পারে, অনলাইনের ক্লাস তা পূরণ করতে পারে না। মহামারির কারণে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু আর কতদিন ক্লাসের বাইরে থাকবে শিক্ষার্থীরা? 

এবার আসি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের প্রশ্নে। তাদের এই গৃহবন্দী জীবন, এই অনলাইন শিক্ষার ধকল, ক্লাস করতে না পারার জের শিশুদের বহণ করতে হবে বহুদিন। গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায় বা শহরের বস্তিতে যে বাচ্চাটি পড়ছে, যার স্কুলে গিয়ে শেখা ছাড়া, শেখার আর কোন উপায় নেই। অথবা এমন ছাত্রছাত্রী যাদের অভিভাবকরা পড়তে পারেন না কিংবা তাদের পড়াশোনাতে সহায়তাও করতে পারেন না, তাদের অবস্থাই সবচেয়ে সঙ্গীন ছিল করোনাকালে। সরকার চেয়েছিল শিশুদের জন্য কার্যকর দূর শিক্ষণ ক্লাসের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু তা প্রায় ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়। এই ব্যবস্থায় টিভি, রেডিও, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। কারণ বাংলাদেশে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর ইন্টারনেট একসেস নাই বললেই চলে ।

অনলাইন শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রযুক্তিগত দুস্প্রাপ্যতা, প্রান্তিকতা ও সামাজিক বৈষম্যের কারণে সফল হয়নি। এ প্রসঙ্গে ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং (সানেম) এর একটি সেমিনারে অনেক আগেই বলেছিলেন চর, হাওড় এবং চা বাগানের বাচ্চাদের স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট নেই। দেশের শতকরা ৪৪ ভাগ পরিবারের টেলিভিশনও নাই। তাহলে তারা কেমন করে অনলাইনে ক্লাস করবে ? সত্যিই তাই হয়েছে। এই একটা বছরে শিশুরা কিছুই শিখতে পারেনি। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী এবং বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত ছাত্রছাত্রীরা আর কতদিন শিক্ষা থেকে বাদ পড়ে থাকবে?

আমাদের জন্য ভয়াবহ তথ্যটা ছিল এক তৃতীয়াংশ শিশু ঝরে পড়বে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুধু করোনাকালীন অভাবের কারণে। সানেমের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ধারণা করা হয়েছে শতকরা ৩০ জন ছাত্রছাত্রী আর বিদ্যালয়ে ফিরে আসবেনা, কারণ তাদের পরিবার কাজ হারাবে এবং সংসারে অভাব বাড়বে। (সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন)  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, সময় নষ্ট কোন চ্যালেঞ্জ নয়, আসল চ্যালেঞ্জ ঝরেপড়ার হার কমানো। এর পাশাপাশি শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশের চাইতে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ সবচেয়ে কম।

বিবিসির তাদের একটা রিপোর্টে বলেছিল বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শতকরা ৯৮ ভাগ হলেও শিশুরা মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছেনা। বিশ্বব্যাংক বলেছে প্রাথমিকের ৬৫ ভাগ শিক্ষার্থী বাংলাই পড়তে পারেনা। ইংরেজি আর গণিতে অবস্থা এর চেয়েও দুর্বল। এদের অনেকে অক্ষরও চেনেনা। শিক্ষকরা মনেকরেন এই বাচ্চাগুলোকে বাসায় পড়ানোর মত কেউ নেই। এছাড়া শতকরা ৫০ ভাগ শিক্ষকের বছরের পর বছর কোন প্রশিক্ষণও হয়না। ইউনেস্কো বলেছে বাংলাদেশে শিক্ষকদের এই ট্রেনিং পাওয়ার হার এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। এই যদি হয় সাধারণ সময়ে শিশুদের শেখার অবস্থা, তাহলে করোনাকালের এই দীর্ঘ ছুটির পর বাচ্চাদের পড়াশোনার অবস্থা আরো অনেক খারাপ হতে বাধ্য। 

শিক্ষা খাত আমাদের দেশে সবসময়ই খুব উপেক্ষিত। করোনার ধকল সামলানোর জন্য শিল্প ও কৃষি খাতে প্রণোদনা দেওয়া হলেও, শিক্ষায় প্রণোদনা দেয়ার কথা শুনিনি। বেসরকারি খাতের কিছু স্কুল ছাড়া বাংলা মাধ্যম স্কুল-কলেজের যে বেহাল অবস্থা হয়েছে, তা নিয়ে সরকার কতটা ভাবছেন? অথচ একটি লেখায় পড়লাম, করোনার ১০ মাসে সারা দেশে প্রায় আড়াই হাজার বেসরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেইজন্যই সরকারকে শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে দ্রুত এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, স্কুলের উদ্যোক্তারা এই খাদ থেকে উঠে দাঁড়াতে পারেন, চলতি বছরে।

তবে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনলাইনে পড়াশোনা করাটা তেমন কোন অসুবিধার না হলেও, বাচ্চারা পড়াশোনার প্রতি অনেকটাই আগ্রহ হারিয়েছে। ইংরেজি মাধ্যমের ক্লাশ ফাইভে পড়া ছাত্র প্রিয়ম জানালো অনলাইনে তাদের কোন অসুবিধা হচ্ছেনা ঠিকই কিন্তু বাসায় থেকে পড়াটা কিন্ত তেমন হচ্ছেনা। এই অনলাইনে ক্লাস করতে গিয়ে শিশুরা অনেকবেশি মোবাইল বা কম্পিউটার নির্ভর হয়ে পড়েছে। খেলাধূলা বন্ধ, চোখের উপর বাড়তি চাপ, হেডফোন ব্যবহারের কারণে কানের উপর চাপ এবং প্রযুক্তি নির্ভর জীবন শিশুকে অসুস্থ করে তুলেছে। অভিভাবকরাও বলছেন সন্তানের প্রযুক্তি ব্যবহারের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

খবরে দেখলাম প্রায় ৪৭ ভাগ অভিভাবক চাইছেন না বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাতে। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে শহরকেন্দ্রিক এই অভিভাবকদের অনেকেই বাচ্চাকে নিয়ে বাসে বা ট্রেনে চড়ে দিব্বি এমন জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছেন, যেখানে আরো অনেক মানুষের ভীড়। তাহলে আর স্কুলে ফিরতে সমস্যা কোথায়? আমরা কি জানি বহু ছোট স্কুল এই একবছরে বন্ধ হয়ে গেছে, বহু শিক্ষক বেকার হয়েছেন, আরো অনেকে বেতন পাচ্ছেন না বা অল্প বেতন পাচ্ছেন। শিশুদের সাথে সাথে শিক্ষকদেরও ক্ষতি হচ্ছে। 

যে দেশে শপিং মল, গণপরিবহন, দূর পাল্লার পরিবহন, অফিস-আদালত, বাজার-হাট সবকিছু খুলে দেয়া হয়েছে সেখানে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে কিভাবে করোনাভাইরাস বিস্তার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? একজন শিক্ষার্থী কিভাবে শুধু ঘরে বসে করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকবে? কারণ তার পরিবারের অন্যান্যদের প্রতিদিন কাজের প্রয়োজনে বাইরে যেতে হচ্ছে। বাইরে থেকেও লোক আসছে বাসায়। একই ঘরে অবস্থান করা শিক্ষার্থী তার পরিবারের অন্যান্যদের মাধ্যমে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতেই পারে। সবকিছু স্বাভাবিক রেখে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কোন মানে হয়না। 

আর সবচেয়ে আতংকজনক তথ্য হলো অনেক বেশি সংখ্যক কন্যাশিশু এই করোনাকালে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। স্কুলে বলে বিয়ে হয়ে গেছে সুলতানা, মালা ও কেয়ার। এরা সবাই স্কুলে পড়তো। এখন শ্বশুরবাড়িতে আছে। মার্চ থেকে আগষ্ট পর্যন্ত মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের করা টেলিফোন জরিপে দেখা গেছে তাদের কর্ম এলাকায় ৯৩৫ টি বাল্যবিয়ে সংঘটিত হয়েছে, আর থামানো গেছে ৭৫৩ টি। এটি একটি খন্ড চিত্র। দেশব্যাপী ছবি আরো ভয়াবহ।

আমরা চাইছি যতটুকু সম্ভব নিয়ম মেনে স্কুলগুলো খুলে দেয়া হোক। এটা প্রমাণিত যে উপমহাদেশে সংক্রমণের তুলনায় বাংলাদেশে আক্রান্তের ও মৃত্যুর হার কম। দেশে অনেক রোগে এবং পানিতে ডুবে মৃত্যুহার, করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর চেয়ে বেশি। বার্ষিক প্রাণহানির সংখ্যাও বেশি। দেশে এখন টিকাও চলে এসেছে। ঝুঁকির তুলনায় ক্ষতির পরিমাপ করে দেখা জরুরি। পাঁচ কোটি শিশু-কিশোর ও তরুণকে ঘরে বসিয়ে রেখে, করোনা ঠেকানোর এই প্রক্রিয়াকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কি আমরা ভুল করছি ?

লেখক: সিনিয়র প্রশিক্ষক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.