শুধু সম্পদ অর্জন নয়, সন্তানকে সম্পদে রূপান্তর করা জরুরি

মতামত

সাইফুল হোসেন
24 May, 2020, 03:55 pm
Last modified: 24 May, 2020, 04:01 pm
আমরা জীবনে কী চাই- সেটা আমাদের পছন্দ বা চয়েস। আমরা কি সুন্দর, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা পারিবারিক জীবন চাই, নাকি চাই আর্থিক বিলাস-বৈভবে ভরা অশান্তির আগুনে পোড়া অন্য জীবন?

জন বায়রন নামে এক বিদেশি মৃত্যুশয্যায় কয়েক মাস অবস্থান করার পর দৈবক্রমে ফিরে আসেন। কেউ ভাবেননি, তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন। খুব ধনী ছিলেন। অনেক অট্টালিকা, গাড়ি, বড় ব্যবসা, নগদ টাকা অর্জন করেছিলেন। মৃত্যুর দুয়ারে যখন তিনি প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলেন বা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন, তখন তার ভাবনা বা অনুভূতি কেমন ছিল, সেই প্রশ্ন করা হয়েছিল তাকে। তখন কি তিনি তার ব্যবসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন? নাকি সম্পদ কী করবেন, সেই চিন্তায় ছিলেন? নাকি সুন্দরীরা, যারা তার আন্তরিক সেবায় নিয়োজিত থাকত, তাদের চিন্তায় ছিলেন?

তার উত্তর ছিল, যখন তিনি ওপারে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছিলেন, তখন প্রথম কয়েকটি মুখ চোখের সামনে বারবার হাজির হচ্ছিল। এই মুখগুলো তার প্রাণপ্রিয় সন্তানদের মুখ, তার স্ত্রীর মুখ (যাকে তিনি খুব ভালোবেসেছেন বলে মনে হয়নি), তার মৃত বাবা-মার মুখ। তার চোখের সামনে বা মনের পর্দায় কোনো লাস্যময়ী সুন্দরীর মুখ, ব্যাংকের নগদ টাকা, বড় অট্টালিকা একবারের জন্যও ভেসে ওঠেনি। কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পর তিনি প্রথম তার স্ত্রীকে খোঁজ করেছিলেন। অবশ্য স্ত্রী-সন্তানরা শিয়রের পাশেই অশ্রুসিক্ত নয়নে তার ফিরে আসার জন্য প্রার্থনা করছিলেন।

পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার প্রাক্কালে মানুষের জীবনের সত্যটা তার মানসপটে ধরা পড়ে। জন বায়রন যতদিন বেঁচে ছিলেন, তার পরিবারকে অধিক ভালোবেসেছিলেন। জীবন আমূল পাল্টে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সবাই তো তার মতো সৌভাগ্যের অধিকারী হয় না। তাই আমরা যারা এখন বেঁচে আছি, তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জাগতিক জীবনে পরিবারের দিকে আন্তরিক দৃষ্টি দেওয়া। আমার মনে হয়, ভালো একটি পরিবার গঠন করা, সুন্দর এবং সুস্থ একটি পারিবারিক জীবনযাপন করতে পারা পৃথিবীতে একটি বড় নিয়ামত।

পৃথিবীতে আমরা যেমন ঈশ্বরের প্রতিনিধি, আমাদের প্রতিনিধি আমাদের সন্তানরা। আমাদের মৃত্যুর পর তারা পৃথিবীতে বসবাস করবে। তাদের মৃত্যুর পর তাদের সন্তানরা-এ এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যে শিশু বাবা-মায়ের মাধ্যমে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হলো, তাকে সঠিকভাবে লালন-পালন করে যোগ্য করে গড়ে তোলার দায়িত্ব বাবা-মায়ের। তাই চিন্তা-ভাবনা শুরু হয় শিশুর জন্ম নেওয়ার আগে, যখন বাবা-মা একটি সন্তানের জন্য আকাঙ্ক্ষা করা শুরু করেন, পরিকল্পনা করেন, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন।

প্রতিটি বাবা-মা-ই তার সন্তানকে ভালোবাসেন- এতে কোনো দ্বিমত, সন্দেহ নেই। তবে সঠিকভাবে বাচ্চা লালন-পালন করা, তাকে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে শিক্ষা দেওয়া, সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারা সহজ বিষয় নয়। এ জন্য বাবা-মায়ের যথেষ্ট চিন্তা, পড়াশোনা, প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ ও আন্তরিক ধৈর্য ধারণ প্রয়োজন। আমরা যেমন চাকরি করি, ব্যবসা করি অধিক মনোযোগ ও সময় দিয়ে; সন্তান লালন-পালনও তেমনি চাকরি বা ব্যবসার মতো মনোযোগ ও সময় দাবি করে।

আমি একজন পিতা। কোনো বিশেষজ্ঞ নই; তবে প্যারেন্টিং নিয়ে খুব আগ্রহ আছে, তাই চিন্তা করি। সুযোগ পেলে লব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে শেয়ার করতে পছন্দ করি।

একদিন একজন বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল আমার অফিসে। তিনি খুব কষ্ট করে, জীবন-সংগ্রাম করে বড় ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন। যতদূর জানি, সৎভাবে জীবন নির্বাহ করার চেষ্টা করেন। জানতে পারি, প্রায় প্রতিদিন তিনি রাত ১১টার পর বাসায় ফেরেন। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করেন। বাচ্চাদের সঙ্গে তার প্রতি শুক্রবার সকালে দেখা হয়। তিনি বাচ্চাদের খেলনা, খাবার-দাবার, ভালো স্কুলে ভর্তি, টিউটর, ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ, তাদের আবদার সব নিমিষেই ব্যবস্থা করে দেন।

যেহেতু তিনি ছেলেবেলায় খুব অর্থকষ্টের মধ্যে মানুষ হয়েছেন, তাই বাচ্চারা যেন সেই কষ্ট তার জীবদ্দশায় বা মরণের পরে না পায়, সে ব্যবস্থা করে ফেলেছেন এবং ওদের জীবন আরও নিরাপদ করা যায় কোন আর্থিক প্রক্রিয়ায়, সেটা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের বাচ্চাদের জন্য অনেক সম্পদ রেখে যাওয়াটা জরুরি কি-না সেটা একটা মূল্যায়ন দাবি করে। আমার চেনা এক ভদ্রলোক আছেন, যিনি বাবার মৃত্যুর পর ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় পেয়েছেন কয়েকটা বাড়ি, ঢাকা শহরের পাশেই আছে কয়েক বিঘা জমি এবং একটি শিল্প-কারখানা। বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে সম্পত্তির ভাগ কাউকে দিতে হয়নি। ভদ্রলোক গ্র্যাজুয়েট। বাবার মৃত্যুর পর তিনি তার শিল্প-কারখানা চালাতে অনিচ্ছুক ছিলেন বিধায় সেটাকে লিজ দিয়েছেন ১০ বছর মেয়াদে। প্রতি মাসে বাড়ি ভাড়া থেকে পান ১০ লক্ষাধিক টাকা। গড়ে প্রতি মাসে অপরিশ্রমলব্ধ আয় তার সব মিলিয়ে ১৫ লাখের বেশি।

তিনি ঘুম থেকে ওঠেন দুপুরবেলায়। আয়েশ করে খাওয়া-দাওয়া করেন। বিকেলে আরেকটু রেস্ট নেন এবং সন্ধ্যায় ক্লাবে সময় কাটান। বাসায় ফেরেন গভীর রাতে টলতে টলতে। প্রাণপ্রিয় স্ত্রী মনে একবুক কষ্ট নিয়ে  স্বামীকে শোয়ানোর ব্যবস্থা করেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজে তার পাশে ঘুমিয়ে পড়েন কাঁদতে কাঁদতে। এটা তার নিত্যকার ব্যাপার। তার বাবা যখন যুবক ছিলেন, তখন কিন্তু দিনান্ত পরিশ্রম করে সম্পদ গড়েছেন ছেলের ভালো থাকার প্রত্যাশায়।এখানে পিতা-মাতার অনেক চিন্তা ও অনুধাবনের বিষয় আছে।

আমার ব্যবসায়ী বন্ধুকে এই গল্পটা আমি শুনিয়েছি। তিনি বললেন, 'এভাবে তো ভাবি নাই!'

সত্যি আমরা এভাবে ভাবি না। কেউ বললে ভাবতে পারি। এই লেখা যারা পড়ছেন, তারাও একটু ভাববেন, আশা করি।

ছেলেমেয়েরা শৈশবে বাবা-মায়ের নিবিড় সান্নিধ্য চায়, অখণ্ড মনোযোগ চায়। চায় তার বাবা-মাও তার মতো তার সঙ্গে খেলাধুলা করুক। পরম মমতায় তাকে জড়িয়ে ধরুক, বিপদে-আপদে বিনাশর্তে তার পাশে থাকুক, তাকে নিরাপদ রাখুক। অথচ আমরা তার সঙ্গে কী করি? সারাদিন বাচ্চাদের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করার সংগ্রামে ব্যস্ত আর বর্তমানের প্রতি মুহূর্তকে অবজ্ঞা-অবহেলা করি।

ভবিষ্যৎ সবসময় ভবিষ্যৎ। বর্তমানকে গুরুত্ব দিতে হবে, বর্তমান সময়ে আমাদের বসবাস করতে হবে, বর্তমানের প্রতিটি ক্ষণকে উপভোগ করতে হবে। আসলে আমরা আমাদের বাচ্চাদের জন্য ব্যস্ত; কিন্তু আমাদের ব্যস্ত থাকতে হবে বাচ্চাদের সঙ্গে। বাচ্চার জন্য সম্পদ রেখে যাওয়ার চেয়ে বাচ্চাকে সম্পদে রূপান্তর করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে বেশি।

আপনারা যারা পড়ছেন লেখাটা, তারা বোধ করি আমার সঙ্গে একমত হবেন, আজকের যে সামাজিক অবক্ষয়, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ সামাজিক জীবনে ক্রমাবনতি- তার জন্য বাবা-মা অনেকাংশে জেনে বা না জেনে দায়ী। ছেলেমেয়েরা যতটা না বাবা-মায়ের উপদেশ শুনবে, তারচেয়ে তারা দেখবে বা অনুসরণ করবে বাবা-মায়ের কাজ, যা বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের সামনে করবেন। তাদেরকে আপনি বলবেন সত্য কথা বলতে, কিন্তু তাদের সামনে অন্যের সঙ্গে মিথ্যা বলছেন- বাচ্চারা তা বুঝতে পারে। তারা আপনার মিথ্যা বলাটাকে গ্রহণ করবে। ভাববে এবং তাদের অবচেতন মনে রেকর্ড হবে- 'মিথ্যা বলা যায়।' কারণ সে তার বাবা-মা, যাদেরকে সে পৃথিবীতে অনুসরণীয়-অনুকরণীয় হিসেবে গণ্য করে, তাদের মিথ্যা বলতে দেখেছে।

ধরুন, বাসায় আপনার কাছে কেউ এসেছে। আপনি তার সঙ্গে দেখা করতে চান না। ছেলে বা মেয়েকে বললেন, 'যাও। বলো, বাবা বাসায় নেই।' সন্তান আপনার আদেশ পালন করবে; কিন্তু তার অবচেতন মনে বা চেতন মনে ছাপ পড়বে- মিথ্যা বলা অন্যায় নয়। আমাদের তাই চিন্তা ও বাক্য প্রক্ষেপণে খুব সচেতন হতে হবে।

আপনারা যারা নতুন বাবা-মা বা যাদের বাচ্চা ছোট, তারা দয়া করে একটা হোমওয়ার্ক করবেন। তার কানে ভূতের খবর না দিয়ে তাকে বলতে শেখান, 'আমি জিনিয়াস।' সে বুঝুক বা না-বুঝুক, মুখস্থ করবে- 'আমি জিনিয়াস।' আর তার সামনে পারতপক্ষে 'না', বা 'নো' শব্দটি বলবেন না। 'এটা ধরো না, পানি ফেলো না, ওদিকে যেও না, দৌড় দিও না...'- এ রকম হাজারও 'না' বা 'নো' তাকে নেগেটিভিটি শেখায়, যা পরে তাকে ঋণাত্মক চিন্তার ধারক বাহক হতে বাধ্য করে। আর ঋণাত্মক চিন্তাধারা মানুষের বিকাশের জন্য অন্যতম অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। বাচ্চা স্বাধীনভাবে কাজ করতে শিখবে না, যদি তাকে সারাক্ষণ 'না... না...' করতে থাকেন।

আমার বাচ্চা একদিন আগুনে হাত দিতে যাচ্ছে। আমার স্ত্রী খুব ভয় পেয়ে বকাবকি শুরু করল আমার সঙ্গে। আমি বললাম, 'শান্ত থাকো, অপেক্ষা করো আর দেখো।' আমি জ্বলন্ত মোমবাতি ওর সামনে রাখলাম। ও মোমবাতির আগুনের কাছে হাত দিয়ে গরম অনুভব করে ফিরে এলো। ওর আকাঙ্ক্ষা ছিল- লালচে ফুলকিটা কী, তা বোঝার। ওর বিচার করা শেষ হলো, আকাঙ্ক্ষাও নিবৃত্ত হলো। আগুনে হাত পোড়েনি। হাত পোড়ানোর অবস্থা হলে ধরে ফেলতাম। বাচ্চার ক্ষুুদ্র বিপদেও পাশে থাকবেন। ও কাজে উৎসাহী হবে আর জানবে, বাবা-মা ওকে বিপদে সাহায্য করবেন, আগলে রাখবেন। এই বোধটা খুব জরুরি।

বাচ্চার সুষ্ঠু ও সুন্দর বেড়ে ওঠার জন্য বাবা-মায়ের সুস্থ চিন্তা, কাজ, সততা, নিষ্ঠাসহ যত সৎগুণ থাকা দরকার; তা থাকতে হবে। কেননা, বাচ্চা মানুষ করা একটা যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভ করার মতো।

দেখবেন, আপনার বাচ্চা যদি মানুষের মতো মানুষ হয় আর সহায়-সম্পত্তি নাও থাকে, আপনি সুখী অনুভব করবেন। আর যদি আপনার পাহাড়সমান সম্পদও থাকে আর বাচ্চা অমানুষ হয়, সেই সম্পদের সুখ নিমিষেই ধুলায় প্রোথিত হবে। ভাববেন না আমি আপনাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য লিখছি। না, সেজন্য নয়; তবে ভাববার জন্য, গভীরভাবে চিন্তা করবার জন্য অবশ্যই। 

আমরা জীবনে কী চাই- সেটা আমাদের পছন্দ বা চয়েস। আমরা কি সুন্দর, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা পারিবারিক জীবন চাই, নাকি চাই আর্থিক বিলাস-বৈভবে ভরা অশান্তির আগুনে পোড়া অন্য জীবন?

তাহলে কি জীবনে কি সম্পদের প্রয়োজন নেই! অবশ্যই আছে। তারচেয়েও প্রয়োজন সন্তানকে সম্পদে রূপান্তরিত করা। আপনার অর্জিত সম্পদ রক্ষা করার জন্যও আপনার সন্তানকে সম্পদে রূপান্তরিত হওয়া জরুরি।

  • লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
    ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.