মধ্যবিত্তরা কেন দ্রুত গরিব হয়ে যাচ্ছে

মতামত

সাইফুল হোসেন
05 July, 2020, 11:10 pm
Last modified: 05 July, 2020, 11:17 pm
কয়েক দশকের অভ্যাস আর মনস্তাত্ত্বিক গঠনের কারণে ‘অন্য ধরনের কাজ’ আর ‘সাহায্য নেওয়া’ থেকে বেশ কিছু সময় বিরত থেকে গোপনে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাবে দেশের মধ্যবিত্ত।

সমগ্র পৃথিবীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা দিন-দিন বেড়েছে; কমেনি। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাজের ঢাল হিসেবে কাজ করে। সমাজ বা রাষ্ট্রের দুর্দিনে তাদের ভীষণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে; কারণ, তারা যে সমাজে থাকেন, সেই সমাজ বা রাষ্ট্রকে তারা বুকের মধ্যে ধারণ করেন, চিন্তা চেতনায় লালন করেন এবং একটা স্বপ্নের বুনন তাদের মস্তিষ্কের কোষে অনুরণন তোলে এই ভাবনায় যে, এই রাষ্ট্রে তার পূর্বপুরুষেরা দিন কাটিয়েছেন এবং এই সমাজে তার উত্তর পুরুষেরা জীবনযাপন করবেন। তাই এই রাষ্ট্রের চিন্তা ভিন্ন অন্য কোনো চিন্তা তার মাথায় খেলা করে না।

যখন তার প্রাণের দেশ আক্রান্ত হয়, তা সেটি যুদ্ধ হোক বা কোনো মহামারিতে, তার হৃদয় তখন বিদীর্ণ হয়; তার মস্তিষ্কের কোষগুলো যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়ে ওঠে; মন খুঁজতে থাকে সমাধানের পথ। শুরু হয় সংগ্রাম- নতুন পথের, নতুন সমাধানের।

করোনা সংকটের কারণে বাংলাদেশের সেই মধ্যবিত্ত আজ বিপদগ্রস্ত, বিপন্ন।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্প্রসারণ একটি দেশের উন্নয়নের লক্ষণকে প্রকাশ করে। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দারিদ্র কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, গত ১০ বছরে আমাদের দেশে প্রায় এক কোটি মানুষ হতদরিদ্র অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন।

সরকারি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১০ সালে দেশে হতদরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৮ লাখ। ২০১৯ সালের জুন মাস শেষে অতি গরিব বা হতদরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখের কিছুটা বেশি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৭ কোটি। আর সব মিলিয়ে করোনা পূর্ববর্তী সময়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের সংখ্যা সোয়া তিন কোটির কিছু বেশি।

২০১৮ সালের একটা সরকারি হিসেবে দেখা যায়, প্রায় ৩৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা জাতীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যা ১৯৯৯ সালে ছিল ৫৯ শতাংশ।

সরকার ২০২২-২৪ সালের মধ্যে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ১২.৩ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৪.৪ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছে। গত ২০ বছরে ক্রয়ক্ষমতা প্যারিটির (পিপিপি) পরিমাপে বাংলাদেশের জিডিপি ১৬৭.৬ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে ২০১৮ সালে। এটি দেখায়, পিপিপির ভিত্তিতে জিডিপি ক্রমবর্ধমান বার্ষিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই জাতীয় বৃদ্ধি মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রমবর্ধমান বিকাশকে প্রতিফলিত করে।

দেশের জনসংখ্যা যখন চরম দারিদ্র্যের সীমা অতিক্রম করে, তখন তারা সাধারণ দারিদ্র্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। তারপরের ধাপ নিম্ন মধ্যবিত্ত, তারপর মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত। পরের ধাপ উচ্চবিত্ত।

গেল বছর দারিদ্র্যের হার সাড়ে ২০ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার সাড়ে ১০ শতাংশে নেমেছিল; কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে এই হার আবার বেড়ে দিগুণ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদি উচ্চবিত্ত ২০ শতাংশ, আর দরিদ্র মানুষ সাড়ে ২০ শতাংশ হয়, তাহলে বাকিটা অর্থাৎ প্রায় ৫৯ শতাংশ মানুষ মধ্যবিত্তের কাতারে পড়ার কথা। শুধু যদি আর্থিক সক্ষমতার নিরিখে বিচার করা হয়, তাহলে মধ্যবিত্তের শতকরা হার ৬০ বা ৫০ শতাংশের মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকবে।

দুঃখের বিষয়, ইতোমধ্যে দরিদ্র শ্রেণি থেকে যাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তরণ হয়েছিল, তারা আবার দরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছেন, আর দরিদ্ররা হচ্ছেন চরম দরিদ্র।

বৈশ্বিক এই মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত; কাজ হারিয়েছেন ও হারাচ্ছেন কোটি কোটি মানুষ। আইএলওসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্ম হারানো মানুষের যে সংখ্যা ও পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে, সে সংখ্যার একটি বড় অংশ হতে যাচ্ছে এই মধ্যবিত্ত। তাদের হাতে বাড়তি অর্থ তো থাকছেই না; বরং মৌলিক চাহিদা মেটানো নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে, বিশ্বজুড়ে। 

বাংলাদেশের অগ্রসরমান মধ্যবিত্তও সেই ঝুঁকিতে দারুণভাবে আক্রান্ত। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণি হয়তো নানা সাহায্য সহযোগিতা, নয়তো নানা রাষ্ট্রীয়-সামাজিক বলয়ের মধ্যে দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে যাবে; কিন্তু কয়েক দশকের অভ্যাস আর মনস্তাত্ত্বিক গঠনের কারণে 'অন্য ধরনের কাজ' আর 'সাহায্য নেওয়া' থেকে বেশ কিছু সময় বিরত থেকে গোপনে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাবে দেশের মধ্যবিত্ত।

বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সংকট নিয়ে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে; কিন্তু একটি প্রশ্ন আমার মনে বারবার উঁকি দেয়। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি কেন এত দ্রুত বিপদে পড়ছে? তারা কেন আর্থিকভাবে এত তাড়াতাড়ি সংকটাপন্ন হয়ে পড়লেন? কেন তাদের নিম্নগামিতা এত দ্রুত ঘটে? সেটা ভাবার বিষয়; মনে করি, গবেষণার বিষয়ও বটে।

নিচে কিছু কারণ উল্লেখ করার চেষ্টা করা হলো:

১। আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা নিজেদেরকে একটা মোড়কের মধ্যে আটকে রাখতে অভ্যস্ত। সেই মোড়ক আত্মসম্মানের, কিছুটা অহমিকার, কিছুটা মিছে প্রহেলিকার চাদরে ঢাকা। সংকটে পড়লে তারা ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েন ঠিকই; কিন্তু সবার অলক্ষ্যে সেই সংকট থেকে মুক্তি চান, মুক্ত হওয়ার পথ খোঁজেন- কখনো পেয়ে যান, কখনো-বা পান না।

যখন পান না, তখন যন্ত্রণা নিজের মধ্যে চেপে রেখে আগুনে তপ্ত হন, দগ্ধ হন; কাউকে কিছু বলেন না- যতক্ষণ সেটা অনিবার্য সহ্যসীমা অতিক্রম না করে। ফলে তার সমস্যা সবার সমস্যা হয়ে ওঠে না। মধ্যবিত্ত সংগঠিত শক্তি হয়ে ওঠে না। তাদের দাবী সামগ্রিকভাবে দানা বাঁধতে সময় লাগে; আদায় হতেও তাই সময় লাগে অনেক; অথবা অনাদায়ই থেকে যায়।

করোনার সময়ে সৃষ্ট আর্থিক সমস্যা তারা নিজেরা সামলানোর চেষ্টা করছেন। এটা এখনো তার নিজের সমস্যা, নিজেদের সমস্যা; সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সমস্যায় রূপ নেয়নি। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাধানের লক্ষণীয় উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।

২। শতবছর পূর্বের মধ্যবিত্ত আর বর্তমানের বিকশিত মধ্যবিত্তের মধ্যে পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। এখনকার মধ্যবিত্ত পুঁজিবাদী সমাজের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। তারা যে স্বল্প আয় করেন, তার পুরোটা, কখনো-বা তারচেয়েও বেশি তাদের খরচ হয়ে যায়। মাটিতে পা রেখে চাঁদ ছুঁয়ে দেখার আকাঙ্ক্ষা তার প্রবল; কিন্তু সেজন্য যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, সেটা নিতেই যত কুণ্ঠা!

আয় বৃদ্ধির পরিকল্পনার চেয়ে খরচ ও ভোগের হাত তার পাকা হয়ে উঠেছে, ক্রমান্বয়ে যা তাকে ঋণী করে ফেলছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এবং সঞ্চয় প্রবণতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। সঞ্চয়হীনতা তাকে গভীরতর সংকটে ফেলে দিচ্ছে। যেমনটি হয়েছে এবার এই অনাকাঙ্ক্ষিত করোনার কারণে।

আর্থিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ তার আয়ের একটা অংশ প্রতি মাসে জমিয়ে রাখবেন, যা আস্তে আস্তে একটা বড় সঞ্চয়ের স্তূপ সৃষ্টি করবে। পরবর্তীকালে সেই সঞ্চয় দিয়ে বিপদকাল সামাল দিতে হবে- এই মানসিকতা, প্রজ্ঞা এবং অভ্যাস মানুষকে সংকটে সহায়তা করবে।

মধ্যবিত্ত ভাবেনি কোনো ধরনের বিপদ সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে- শুধু করোনা নয়; অন্য যেকোনো ধরনের সমস্যা হতে পারে। সবার উচিত কমপক্ষে তিন মাস থেকে ছয় মাসের টাকা একপাশে রাখা; তা সে পরিবার হোক বা ছোট ব্যবসাই হোক, যা দিয়ে আপদকাল সামাল দেওয়া যাবে। আমাদের মধ্যবিত্ত এই চিন্তার মধ্য দিয়ে হাঁটেনি; তাই আজ বর্ণনাতীত বিপদের সম্মুখীন; পথ থেকে ছিটকে বাইরে পড়ে যাচ্ছে। 

৩। মধ্যবিত্তের মধ্যে উচ্চবিত্তের জীবনযাপনের একটা তাড়না কাজ করে। কে না চায় তার জীবন সুন্দর কাটুক, একটু আরাম আয়েশে কাটুক, ছেলেমেয়ে ভালো স্কুল-কলেজে পড়ুক? পরিবারের আয়ের ওপর নির্ভর করে খরচের বাজেট করা খুব দরকার। দেখা গেছে, অধিকাংশের আয়ের সঙ্গে খরচের বাজেটের কোনো মিল নেই।

দেখা যাচ্ছে, আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার পেছনে। ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য ভালো জায়গায় বাসা ভাড়া নিতে হচ্ছে। ভালো বাসা, ভালো পরিবহণ, ভালো রেস্তরাঁ, ভালো কফিশপ, ভালো জায়গায় ঘুরতে যাওয়া, ভালোভাবে অতিথিদের আপ্যায়ন করা- এসব করতে গিয়ে সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে খরচ; ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বাড়ছে, ক্রেডিট কার্ডের ঋণ বাড়ছে। ফলে প্রতিমাসে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে, পরিবারের ঋণ বাড়ছে।

করোনার আগেই অনেকে জীবন চালাতে যুদ্ধ করছিলেন। বলছি না বেহিসেবি; বলছি আর্থিক জ্ঞানের অভাব বা আর্থিক বিষয় না বোঝার কারণে অসতর্ক।

মধ্যবিত্তকে ভালোভাবে টিকে থাকতে হলে নিজেদের দিকে একটু সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। ঋণ করে ঘি খাওয়া বা খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে বা কমিয়ে আনতে হবে; নিজের আয়সীমার দিকে সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্তের বিকাশ থেমে গেলে সেটা সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য শুভকর নয়। সোশ্যাল মিডিয়ার আগ্রাসনের এই সময়ে মধ্যবিত্তের মূর্ত অবস্থান খুবই প্রয়োজন সমাজের ক্ষয়িষ্ণুতাকে রোধ করবার জন্য, সমাজের সাংস্কৃতিক সুস্থ বিকাশ ধরে রাখার জন্য এবং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য। তাই সরকারকে খুব সতর্কভাবে মধ্যবিত্তের ঝরে পড়া রোধ করতে হবে, তা যেভাবেই হোক; না হলে সমাজ পিছিয়ে যাবে সামগ্রিকভাবে।

  • লেখক: কলাম লেখক, অর্থনীতি বিশ্লেষক
    ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.