মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির পালে নতুন হাওয়া

মতামত

11 July, 2021, 10:30 pm
Last modified: 11 July, 2021, 10:57 pm
একসময় সৌদি বলয়ে থাকা তেলসমৃদ্ধ কাতারও এখন ঝুঁকছে ইরানের দিকে, সৌদি প্রভাব হ্রাসে তুরস্কেরও আগ্রহ সেদিকে, আরেক মিত্র সংযুক্ত আমিরাতও কৌশলগত কারণে ইরানকে ক্ষেপাতে চাচ্ছে না।

এই মুহুর্তে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মরুভূমির তপ্ত আবহাওয়াকে পাশ কাটিয়ে এক পশলা বৃষ্টির মত খবরের পাতার কিয়দংশ জুড়ে আছে ইরান-সৌদি আরব আলোচনার নয়া সূচনা। আবার ঠিক দুম করে গুমও হয়ে যেতে পারে এই এক পশলা বৃষ্টি। নিশ্চিতভাবে সবকিছু নির্ভর করছে দুই দেশের নীতিনির্ধারণী মহলের উপর।

বিভিন্ন সময়েই ইরান সৌদি আরব সম্পর্ক নানা চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে গেছে। তবে সর্বশেষ যে কারণে দেশ দুটি নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তার সূত্রপাত ঠিক ৫ বছর আগে ২০১৬ সালে, রিয়াদ কর্তৃক শিয়া ধর্মগুরু শেখ নিমর আল নিমরের প্রাণদণ্ড কার্যকর করার প্রতিবাদে সৃষ্ট উত্তেজনায় তেহরানে সৌদি দূতাবাসে যখন হামলা হয়। এরপর মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির সর্বস্তরেই নিজেদের মধ্যে চূড়ান্ত বিরোধ জারি রেখেছে দু'পক্ষ। তবে ২০১৯ এর সেপ্টেম্বরে সৌদি তেল স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর থেকেই কিছুটা নমনীয় হতে শুরু করে রিয়াদ। তারই ফলে তারা ইরানের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরুর জন্য মধ্যস্থতাকারী খুঁজছিল এবং এই কাজে তারা বেছে নেয় আরেক শিয়া অধ্যুষিত দেশ ইরাককে। এর ধারাবাহিকতায় গত ৯ এপ্রিল বাগদাদে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা আল কাজিমির মধ্যস্ততায় বৈঠকে বসে সৌদি আরব ও ইরানের কর্মকর্তারা। শুরুর দিকে বৈঠকের বিষয়টি গোপন থাকলেও পরবর্তীতে দু'পক্ষই মতের ভিন্নতা সত্বেও আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে বলে স্বীকার করেছে। 

অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এমন ঘটনার নজির খুব কমই আছে এবং দিনশেষে দু'পক্ষ যদি মতৈক্যে পৌঁছাতে পারে তবে তা গোটা আরব বিশ্বের জন্যই স্বস্তিদায়ক হবে। আরব বিশ্বের ক্ষমতা কাঠামোয় এখন যে দ্বিমেরু বিশিষ্টতা লক্ষ্য করা যায় তার সূচনা মূলত একদিকে আরব ইসরায়েল যুদ্ধে মিশরের পরাজয় আর অন্যদিকে ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ফলে। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ধীরে ধীরে সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের দাবিদার হয়ে উঠেছে অপরদিকে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরান বিপ্লব পরবর্তী সময়ে আরব বিশ্বে তার মডেলের রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছে। সুন্নি শিয়া দ্বন্দ্বের পাশাপাশি এই কারণেও সৌদি আরবের রাজতন্ত্র ইরানকে হুমকি হিসেবে দেখেছে যার ফলে সরাসরি সংঘাত না বাঁধলেও এক ধরনের ছায়া যুদ্ধের আবহ বিরাজ করে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে।

যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের মদদে রিয়াদ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশরকে নিয়ে যে প্রভাব বলয় তৈরি করেছে তার মোকাবিলায় ইরান লেবাননে হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহী, সিরিয়ায় আসাদ সরকার, ইরাক ও ক্ষেত্রবিশেষে হামাসকে সঙ্গে রেখে পাল্টা জবাব দিচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে বড় ভূমিকায় আছে রেভ্যুলেশনারী গার্ডের কুদস ফোর্স, যারা আসাদকে সিরিয়ার ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে রাশিয়ার পাশাপাশি অন্যতম নিয়ামক ছিলো এমনকি ইয়েমেনে সৌদি জোটকে পর্যন্ত পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে প্রক্সি মিলিশিয়া দ্বারা।

এসব ক্ষেত্রে রিয়াদের বড় পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিদায়ে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে, বাইডেন প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি তাই বিন সালমানের জন্য যথেষ্ট চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে এক বক্তব্যে তিনি আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনিকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন সেই বিন সালমানই এবার ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ দেখিয়েছেন।

একসময় সৌদি বলয়ে থাকা তেলসমৃদ্ধ কাতারও এখন ঝুঁকছে ইরানের দিকে, সৌদি প্রভাব হ্রাসে তুরস্কেরও আগ্রহ সেদিকে, আরেক মিত্র সংযুক্ত আমিরাতও কৌশলগত কারণে ইরানকে ক্ষেপাতে চাচ্ছে না। এইসব কারণেই ক্ষমতা কাঠামোয় ভারসাম্য ঠিক রাখতে আলোচনার টেবিলে আগ্রহ দেখাচ্ছে সৌদি আরব। তবে তারা মনে করিয়ে দিচ্ছে ইরান যদি তার পূর্বের অবস্থান থেকে সরে না আসে তবে সব উদ্যোগই ভেস্তে যাবে।

অন্যদিকে ইরান শুরুতে এপ্রিলের আলোচনা নিয়ে মন্তব্য না করলেও গত কয়েকদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে বলেছে আলোচনায় যথেষ্ট অগ্রগতি এসেছে। দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত অর্থনীতিকে পুনরায় চাঙ্গা করতে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সামরিক কর্মকাণ্ডের প্রধান কাসেম সোলেমানির হত্যায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তার পরবর্তী পর্যায়ে এই আলোচনা তাদের দীর্ঘমেয়াদে সুবিধাজনক অবস্থানেই রাখবে।  

বছরের পর বছর ধরে চলমান মধ্যপ্রাচ্যের এসব সংকট কাটিয়ে উঠতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন দেশগুলোকে যুদ্ধংদেহী  বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে সফট পাওয়ার পলিটিক্সে গুরুত্ব দেওয়া উচিত তাতে বরং সব পক্ষেরই ক্ষতির চেয়ে লাভই বেশি। সে জন্য দ্বন্দ্ব নিরসনে রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ায় যাওয়া অতি জরুরি। ইরানকে নিয়ে রিয়াদের যে তিনটি বিষয়ে সমস্যা তা হল তাদের পরমাণু কর্মসূচি, মিসাইল পরিক্ষা ও বিদ্রোহীদের সহায়তা (হুতি)। এসব প্রসঙ্গে ইরান কতটা নমনীয়তা দেখাবে সেটা ভাবনার অবকাশ রাখে, তার উপর এবারের নির্বাচনে জয়লাভ করে নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন পাশ্চাত্যের ভাষ্যে কট্টরপন্থী বলে বিবেচিত ইব্রাহিম রাইসি। তবে আশার বিষয় হল ইরান সরকারের মুখপাত্র আলী রাবিয়ি বলেছেন "মতবিরোধ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে এই আলোচনা চালিয়ে যাবে তেহরান"।

এই আলোচনার শেষ সিদ্ধান্ত অবশ্য আলী খোমেনি আর বিন সালমানই নির্ধারণ করবেন হয়ত তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় আশা করাই যায় মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মরুতে শান্তি ফিরবে আবার।


  • লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 
  • ইমেইল: amshakil01@gmail.com 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.