ভারতের চলমান কৃষক আন্দোলন: ইতিহাসের পাতা থেকে আজকের সংগ্রাম 

মতামত

08 February, 2021, 08:50 pm
Last modified: 08 February, 2021, 09:38 pm
ভারত উপমহাদেশের ইংরেজি শিক্ষিত, চাকরি ও সুযোগ সন্ধানী মধ্যবিত্ত পশ্চিমের মার্ক্স-রুশো পড়ে যা করতে পারেনি; তার বিপরীতে সাধারণ কৃষক কখনো আল্লাহর দুনিয়ায় জমিতে সবার সমান হক বা কখনো গুরুর নামে অনেক বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছে

ভারতের চলমান কৃষক আন্দোলন ইতোমধ্যেই দেশ-বিদেশের মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আলোচনা-উত্তেজনা, তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এই আন্দোলন। আমরা জানি এর ভেতরেই অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রাজনৈতিক ধারাভাষ্য লেখা হয়েছে এই আন্দোলন নিয়ে। আমি মনে করি, ভারতের চলমান এই আন্দোলন বুঝতে হলে ভারতে সংগঠিত অতীতের বড় কৃষক বিদ্রোহগুলোর আখ্যানও স্মরণ করা প্রয়োজন। আর ভারতের তিনটি প্রদেশ এবং বিশেষত: পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকেরা ও শিখ কৃষকেরা এই আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকায় অতীতেও শিখ কৃষকেরা তাদের ধর্মগ্রন্থ ও গুরুদের আদেশে ফসলের অধিকারের প্রশ্নে লড়েছেন, সেই দিকটিও খানিকটা বিশ্লেষণ করার আছে।

২০২০-২০২১-এর কৃষক আন্দোলন:  

গত বছরের শেষভাগ থেকে অদ্যাবধি চলমান ভারতের এই উত্তাল কৃষক বিদ্রোহ মূলত: ২০২০-এর সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের জাতীয় পার্লামেন্টের লোকসভা ও রাজ্যসভায় তিনটি কৃষি আইন পাশ হবার প্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে। তবে সংসদে আইনত্রয়ী পাস হবার পর আন্দোলনের আগুন প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়লেও, আন্দোলনটি প্রথম সূচনা হয় গতবছরের ৯ই আগস্ট। সে হিসেবে এই আন্দোলনের বয়স এখন ছয় মাস ছাড়িয়েছে। 

ভারতের কৃষকেরা উপরোক্ত তিনটি বিল প্রত্যাহারের দাবিতেই আন্দোলন করছেন। ফসলের ন্যূনতম ন্যায্যমূল্য আইনীভাবে নিশ্চিত করা ও তিনটি বিল বাতিলের দাবিতে কৃষকেরা ঘেরাও, ধর্ণা, সড়ক অবরোধ, প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও আত্মহত্যার মতো নানা পন্থায়; এক কথায় সর্বতোভাবে তাঁদের সংগ্রাম জারি রাখছেন। 

আন্দোলনে জড়িত কৃষক দলগুলোর নেতৃত্বে রয়েছে সংযুক্ত কিষাণ মঞ্চ, যার আওতাধীন দলগুলো হচ্ছে অল ইন্ডিয়া কিষাণ সঙ্ঘ, ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন, কিষাণ স্বরাজ সংস্থা, অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভা, জয় কিষাণ আন্দোলন, লোক সঙ্ঘ মোর্চা, অল ইন্ডিয়া কৃষক ক্ষেত মজদুর সংগঠন, ন্যাশনাল এ্যালায়েন্স অফ পিপলস মুভমেন্ট প্রমুখ। 

আন্দোলনকে সমর্থন দানকারী রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর আছে শিরোমণি আকালি দল, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (সিপিআই), কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট-সিপিএম), রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক দল ও শিবসেনা। বিপরীতে তিনটি কৃষি বিল আনা হয়েছে ভারত সরকারের বর্তমান কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক এবং এই উদ্যোগে সমর্থন দিয়েছে বা দিচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। 

২৭ জানুয়ারি ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে যে, মোট ১৫৯ জন কৃষক এই আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে মারা গেছেন; যাদের ভেতর আত্মহত্যা করেছেন ৭জন ও আহত হয়েছেন কয়েক হাজারের বেশি। 

ভারতের কৃষক ইউনিয়নগুলো এবং ইউনিয়ন সমূহের মুখপাত্ররা বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকার প্রণীত তিনটি কৃষি বিল অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে এবং এর কম কোন শর্তে তারা আন্দোলনে ছাড় দেবেন না। ইতোমধ্যে, গত ১৫ অক্টোবর ২০২০ থেকে ১৫ জানুয়ারি ২০২১ সাল নাগাদ কেন্দ্রীয় সরকার ও কৃষক নেতাদের ভেতর নয় দফা আলোচনা হয়েছে এবং কোনো ঐক্যমত্যে পৌঁছানো যায়নি। 

আন্দোলনরত কৃষক নেতারা কেন্দ্রীয় সরকারের আনীত তিনটি বিলকে "কৃষক বিরোধী আইন'' বলে দাবি করছেন এবং বিরোধী দলীয় রাজনীতিকেরাও এই আইনত্রয়ীকে "কর্পোরেটের হাতে কৃষককে ছেড়ে দেয়া'' বলে আখ্যায়িত করছেন। বাণিজ্যিক সংস্থা যেন কৃষকের ফলানো ফসলের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, সেটাই আজকের ভারতীয় কৃষকের মূল আকুলতার জায়গা। 

ভারত সরকার অবশ্য বলছে যে, কৃষক যেন সরাসরি তার পণ্য বড় ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে পারে এবং মধ্যসত্বভোগীর হাত থেকে রেহাই পায়, সেটাই এই আইনত্রয়ীর লক্ষ্য। সেদেশের সরকার আরো বলছে যে কৃষক আন্দোলনকে কিছু ভুল তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত করা হচ্ছে। 

গত বছর তিনটি কৃষি বিল প্রণীত হবার পরপরই, কৃষক ইউনিয়নগুলো স্থানীয় পরিসরে প্রতিবাদ আয়োজন করতে থাকে। পাঞ্জাবেই বেশি প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। দু'মাস নানা প্রতিবাদের পর মূলত: পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষক ইউনিয়নগুলো "দিল্লি চলো'' নামে একটি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। আক্ষরিক অর্থেই লাখ লাখ কৃষক এই মিছিলে যোগ দিয়ে দেশের রাজধানী অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। 

কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রের নানা প্রদেশে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কৃষকদের মোকাবেলা করার জন্য জল কামান, লাঠি ও টিয়ার গ্যাস হাতে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়। কৃষকেরা যেন পাঞ্জাব থেকে হরিয়ানা ও তারপর দিল্লিতে প্রবেশ করতে না পারে, তেমন নির্দেশনাও ছিল। ২৬শে নভেম্বর ২০২০-এ সারা ভারতে এক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় যেখানে কৃষক ইউনিয়নগুলোর পক্ষে প্রায় ২ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ অংশ নেয়। ৩০ নভেম্বর দিল্লিতে প্রবেশের নানা সীমান্ত বিন্দুতে অন্তত: দুই থেকে তিন লাখ কৃষক সমবেত হয়। 

যদিও ভারতের গরিষ্ঠ সংখ্যক কৃষক ইউনিয়ন প্রতিবাদী ভূমিকায় রয়েছে, ভারত সরকারের দাবি মতে, কিছু ইউনিয়ন নাকি নতুন কৃষি আইনগুলোর পক্ষেও কথা বলছে। সারা ভারতের সড়ক পরিবহন ইউনিয়নগুলো (যার আওতায় কিনা এক কোটি ৪০ লাখ ট্রাক ড্রাইভার কাজ করেন) অবশ্য কৃষকদের পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন এবং দেশের বেশ কিছু প্রদেশে সব দ্রব্য বা পণ্যের সরবরাহ বন্ধ করে দেবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। 

গত ৪ঠা ডিসেম্বর সরকার কৃষক ইউনিয়নগুলোর দাবি মেনে না নেয়ায় কৃষক ইউনিয়নগুলো ৮ই ডিসেম্বর দেশ জুড়ে ধর্মঘটের ডাক দেয়। সরকার কৃষি আইনগুলোয় কিছু সংশোধনের প্রস্তাব দিলেও কৃষক ইউনিয়নগুলো আইন বাতিল করার দাবিতে অনড় থাকে। ১২ই ডিসেম্বর কৃষক ইউনিয়নগুলো হরিয়ানার হাইওয়েতে যানবাহনের অবাধ চলাচলের অনুমতি দেয়। 

বিদায়ী বছরের মধ্য-ডিসেম্বর নাগাদ, ভারতের সুপ্রিমকোর্ট দিল্লির আশপাশে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে শহরজুড়ে নানা সড়ক অবরোধ তুলে দেবার দাবি জানায়। আদালত সরকারকে আইনগুলো স্থগিত রাখতে বললেও সরকার অসম্মতি জানায়। ৪ঠা জানুয়ারি ২০২১ তারিখে আদালত প্রথম বিক্ষোভরত কৃষকদের পক্ষে আবেদন দায়ের করা হয়। আবেদনে কৃষকেরা জানায়, তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আদালতের কথা শুনবে না।
 
৩০শে ডিসেম্বর নাগাদ ভারত সরকার কৃষকদের দুটি দাবি মেনে নেয়: কৃষকদের নতুন "দূষণ আইনে'র আওতা থেকে মুক্ত করা ও নতুন "বিদ্যুৎ অধ্যাদেশে''র সংস্কার পরিহার করা।

এবছর ২৬শে জানুয়ারিতে লক্ষ লক্ষ কৃষক প্রচুর ট্রাক্টর নিয়ে কৃষি সংস্কারের দাবিতে দিল্লিতে ঢুকে পড়ে। দিল্লি পুলিশের নির্দেশিত পথে না হেঁটে তারা অন্য পথ ধরে। ট্রাক্টর নিয়ে অসংখ্য কৃষক পুলিশি ব্যারিকেড অচল করে এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এরপর কৃষকেরা সোজা লালকেল্লায় গিয়ে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পতাকার ঠিক নিচে শিখ ধর্মীয় পতাকা ও কৃষক ইউনিয়নের পতাকা ওড়ায়। 

ভারতের ইতিহাসে অতীতের কৃষক বিদ্রোহ: 
 
ভারতে অবশ্য এটাই প্রথম কৃষক আন্দোলন বা বিক্ষোভ নয়। অতীতেও ভারতে বড় বড় কৃষক বিদ্রোহ বা আন্দোলন ঘটেছে। নিচে ছয়টি বড় ভারতীয় কৃষক বিদ্রোহের কথা সংক্ষেপে নথিবদ্ধ করা হলো: 

১. চম্পারণ সত্যাগ্রহ (১৯১৭): চম্পারণ কৃষক আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনেরই একটি অংশ ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরার পর গান্ধিজি বিহারের চম্পারণ এবং গুজরাটের খেদায় কৃষকদের ভেতর পরীক্ষামূলকভাবে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলেন। মূল লক্ষ্য ছিল কৃষকদের সংগঠিত করে তোলা। বিহারের চম্পারণে বৃটিশ শাসকদের জোর করে চাপিয়ে দেয়া নীল চাষ, কৃষিজমির উপর খাজনা বাড়িয়ে দেয়া, জমিদারের খেয়ালখুশি মাফিক ফসল চাষের জন্য কৃষককে তার জমির সেরা অংশ ছেড়ে দিতে বাধ্য করা, কৃষি মজুরির অত্যধিক নিম্নহার ও প্রবল দারিদ্র্য কৃষকদের বাধ্য করেছিল বিক্ষুব্ধ হতে। তবে কৃষকেরা শেষপর্যন্ত গান্ধির অসহযোগের বাণীতে স্থির থাকতে পারেনি এবং আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করে। এতে গান্ধি নিজে বিক্ষুব্ধ হন। কিন্তু, দরিদ্র কৃষকের পক্ষেই বা কতটুকু অহিংস থাকা সম্ভবপর ছিল? বৃটিশ সরকার কঠোর হাতে এই আন্দোলন দমন করলেও, এই আন্দোলনের অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে।
 
২. খেদা কৃষক সংগ্রাম: গুজরাটের মধ্যভাগে অবস্থিত 'খেদা' অঞ্চল তামাক ও সূতা চাষে তার মৃত্তিকার উর্বরতার জন্য বিখ্যাত। এখানে পাতিদার নামে পরিচিত কৃষকেরা চাষের জন্য বংশ-পরম্পরা ধরে পরিচিত। কিন্তু বৃটিশ সরকারের বাড়িয়ে দেয়া জমির খাজনা, খেদায় সহসা দেখা দেওয়া এক দূর্ভিক্ষ এবং দূর্ভিক্ষের ভেতরেও বৃটিশ সরকারের খাজনা মওকুফ না করা, খাজনা প্রদানে অক্ষম চাষীর ফসল ও গৃহপালিত গবাদিপশু জব্দ করায় ক্ষুব্ধ চাষীরা গান্ধিজি, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, এন.এম.যোশি প্রমুখ নেতার নেতৃত্বে খেদা সত্যাগ্রহ গড়ে তোলেন। সরকার পরে কৃষকদের কিছু দাবি-দাওয়া মেনে নিলে আন্দোলনটি স্তিমিত হয়। 

৩. গুজরাটের বারদোলি কৃষক আন্দোলন: ১৯২৫ সালে গুজরাটের বারদোলিতে প্রবল বন্যায় ফসল ধ্বংস হয়ে দূর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং কৃষকেরা ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কটে পড়ে। এই দু:সময়েও বন্বে প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ সরকার গুজরাটে ৩০ শতাংশ খাজনা বাড়ায়। নাগরিকদের নানা আবেদন-নিবেদনেও তাদের কথা শোনা হয় না। তখন নরহরি পারিখ, রবি শঙ্কর ব্যাস এবং মোহনলাল পান্ডা- গ্রামীণ নেতাদের সাথে আলাপের প্রেক্ষিতে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের সাথে কথা বলেন। প্যাটেল গুজরাটি কৃষকদের আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রেরণা যোগান। কৃষকেরা সরকারকে খাজনা দিতে অসম্মত হলে বৃটিশ সরকার উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে পাঠান যোদ্ধাদের আনিয়ে নিরীহ কৃষকদের ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে দিলেও; কৃষকেরা অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যান। জনতার সম্মিলিত, অহিংস প্রতিরোধে বিচলিত বৃটিশ সরকার একসময় কৃষকদের কেড়ে নেওয়া জমি ফেরত দিতে বাধ্য হন এবং জমির ৩০ শতাংশ বর্দ্ধিত খাজনা মওকুফ করা হয়। '

৪. মালবারের মোপলাহ বিদ্রোহ: মালবারের মোপলাহ- মুসলিম কৃষকেরা কেরালার মালাবারে বংশ পরম্পরায় বাস করতেন। মোপলাহ মুসলিমদের ভেতর কিছু ধনী ব্যবসায়ী থাকলেও অধিকাংশই ছিলেন দরিদ্র কৃষক এবং এই কৃষকদের জমিদাররা ছিলেন আবার উচ্চবর্ণ হিন্দু। ১৯২১ সালের আগস্টে মোপলাহ কৃষকেরা আন্দোলন শুরু করে। আপাত:দৃষ্টে মোপলাহ কৃষকদের আন্দোলন হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে মনে হলেও জমির চড়া খাজনার বিরুদ্ধেই এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দ্বিবিধ পার্থক্য থেকে আন্দোলনটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে। আসলে হিন্দু জমিদাররা ১৮৩৫ সাল থেকে মোপলাহ কৃষকদের নানা অধিকার খর্ব করতে থাকেন। 

বর্ণহিন্দু জমিদার বা জেনমিরা প্রতিবছর জমির কর বাড়াতেন এবং কৃষকদের জমি যখন-তখন কেড়ে নেওয়া হতো। হিন্দু জমিদার বা জেনমিরা যদিও হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকদেরই শোষণ করতেন, তবে মুসলিম কৃষকদের আরো বেশি শোষণ করা হতো। ঠিক এসময়েই সারা ভারতে মুসলিমদের ভেতর খিলাফত আন্দোলন বিস্তার লাভ করলে মোপলাহ কৃষকেরা আরো ক্ষুব্ধ হয়। তবে একটা পর্যায়ে কৃষকদের এই বিদ্রোহ খুব বেশি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার চেহারা নিলে এই আন্দোলন হিন্দু কৃষকদের সমর্থন হারায়। আন্দোলনে বাড়তে থাকা সহিংস উত্তেজনার কারণে বৃটিশ সরকার ১৯২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ আন্দোলন দমন করতে সমর্থ হন। 

৫. তেলেঙ্গানার কৃষক বিদ্রোহ: ভারতের ইতিহাসের বলতে গেলে সবচেয়ে রক্তাক্ত এই কৃষক বিদ্রোহে ২,০০০ কৃষক মারা পড়েছিলেন এবং ২৫,০০০ কম্যুনিস্ট গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। হায়দ্রাবাদের নিজাম পরিচালিত সামন্ততান্ত্রিক জমি চাষ পদ্ধতিতে প্রকৃত কৃষকদের কোন অধিকারই ছিল না। অধিকার ছিল খালসা জমি থেকে খাজনা আদায়কারী দেশমুখ ও দেশপান্ডেদের। তেলেঙ্গানার মূল বাণিজ্যিক ফসল যেমন সুপারী ও তামাক চাষের জমিগুলো ছিল ব্রাহ্মণদের হাতে। রেড্ডি ও অন্যান্য কৃষকেরা উচ্চবর্ণদের হাতই শক্ত করেছে। তবে, একটা সময় জমির মালিকানা আরো বেশি বেশি ব্রাহ্মণ, মাড়ওয়ারি, অভিজাত মুসলিম ও বৈশ্যদের হাতে চলে যেতে থাকে; যারা গ্রামেই বাস করতেন না এবং জমির সাথে তাদের কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। সাধারণ কৃষকদের অধিকার ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকলে তারা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে দূর্ণিবার সংগ্রাম গড়ে তুললেও কঠোর পন্থায় এই বিদ্রোহ দমন করা হয়। 

৬. বাংলার তেভাগা আন্দোলন: বর্গাদার কৃষকের জন্য জমির দুই-তৃতীয়াংশ ফসলের দাবিতে বাংলার কৃষকেরা গড়ে তুলেছিলেন তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৬-৪৭ সালে মূলত: উত্তর বাংলার কৃষকেরাই সবচেয়ে বেশি সংগঠিত হয়েছিলেন। দেখতে দেখতে বাংলার ১৯টা জেলায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রবল পুলিশী দমন-পীড়ন ও বাংলা ভাগের কারণে আন্দোলনটি একসময় মুখ থুবড়ে পড়ে। 

শিখ ধর্মে যেভাবে 'কৃষক বিদ্রোহ' বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে এসেছে: 
 
ইতোমধ্যে ভারতের মূলধারার কিছু সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে ও নগরবাসী, সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত মহলে প্রশ্ন উঠেছে, যে কেন এই আন্দোলনে হরিয়ানা ও পাঞ্জাবসহ তিনটি প্রদেশের কৃষকদের অংশগ্রহণই বেশি দেখা দিচ্ছে? একইসাথে, সমাবেশে বিপুল সংখ্যক শিখ কৃষকের অংশ নেওয়া, শিখ ধর্মীয় শ্লোগান উচ্চারণ ও লালকিল্লায় শিখ ধর্মীয় পতাকা ওড়ানোয় বহু ভারতীয় অস্বস্তি বোধ করছেন যে, আশির দশকে পাঞ্জাবে যে শিখ ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা "খালিস্থান আন্দোলন'' গড়ে উঠেছিল; সেই আন্দোলন আবার ফিরে আসছে কিনা? 

উল্লেখ্য এই খালিস্থান আন্দোলনের প্রবলতায় উদ্বিগ্ন ইন্দিরা গান্ধি এক পর্যায়ে শিখ ধর্মের মূল পীঠস্থান স্বর্ণমন্দিরে সেনা অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন ও গোটা ঘটনার বেদনাদায়ী পরিসমাপ্তি ঘটে শিখ দেহরক্ষী ভিন্দ্রানওয়ালের গুলিতে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুতে। পরিণতিতে ভারত জুড়ে ক্ষুব্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরা শিখ বিরোধী দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে।
 
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে আমরা অবশ্য দেখতে পাব যে, রণকুশলী শিখরা সেই মোগল আমলের সময় থেকে ফসলের ন্যায্য মূল্যের প্রশ্নে মোগল বাদশাহ থেকে আজকের নরেন্দ্র মোদির সরকার সবার সাথেই প্রতিবাদে শামিল হয়েছে। বস্তুত: শিখ ধর্মতত্ত্বে কৃষকের রয়েছে গভীর ভূমিকা। 

বর্তমান ভারতের চলমান আন্দোলনে উত্তর ভারতের নানা জায়গার কৃষকেরা যোগ দিলেও রঙীন সব পাগড়ির কারণে শিখ কৃষকরা সবার আগে চোখে পড়ে। শিখ কৃষক শুধু ফসলের ক্ষেতকে আলিঙ্গন করে না। প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে ধরতে তার কোনো কুণ্ঠা নেই। সত্যি বলতে ১৪৯৯ সাল থেকে ১৫৩৯ সাল নাগাদ পাঞ্জাবে গুরু নানকের হাতে শিখ ধর্মের প্রচার ও প্রসার হয়েছিল এক কৃষক সমাজের আন্দোলন হিসেবেই। 

বিখ্যাত শিখ লেখক খুশবন্ত সিং কৃষক চরিত্র ও শিখ মতবাদের ভেতরকার সম্পর্ক নিয়ে খুব তীক্ষ্ম কিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন। খুশবন্ত সিং তাঁর অমূল্য রচনা "আ হিস্ট্রি অফ দ্য শিখস'' গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় "শিখ মতবাদের জন্ম''-তে বলছেন যে, "গুরু নানক শুধুই এক নতুন ধর্মের স্থাপনা এবং নতুন জীবনাচারের সূচনাই করেননি; তিনি একটি কৃষক আন্দোলনে গতিবেগ সঞ্চার করেন যা দ্রুতই গোটা দেশে অনুভব করা যায়।''

যদিও শিখ ধর্মের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক নেতাই কৃষক ছিলেন না, তবে এই ধর্মের শিরদাঁড়া হিসেবে সবসময়ই পাঞ্জাব তথা ভারতের কেন্দ্রীয় সমতলভূমির জাঠ কৃষককুল কাজ করে এসেছে (দ্য শিখ হোমল্যান্ড, ভল্যুম ওয়ান, আ হিস্ট্রি অফ দ্য শিখস)। 

জাবালা সিং নামের বৃটিশ কলাম্বিয়ার ভ্যাঙ্কুভার নিবাসী এক শিখ লেখক সম্প্রতি গুরু গোবিন্দ সিংয়ের কৃষি সংক্রান্ত বাণী টুইট করেছেন: 

"জাঠ চাষী তার তুলেছে লাঙ্গল,
পেয়েছে গুরুর আশীর্ব্বাাদ,
বিতরণ করছে শস্যের ভাগ
আহার-ভোজনের আগে।" 

খালসা কি?

শিখ ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটেছিল ১৬৯৯ সালের ১৩ই এপ্রিল যখন পাঞ্জাবের জাঠ কৃষকেরা "খালসা'' গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। গুরু গোবিন্দ সিংয়ের "পাঞ্জ পেয়ারা'' বা পাঁচ প্রিয় শিষ্যের ভেতর দ্বিতীয়জন ছিলেন ধর্ম দাস, আজকের মীরাট বা অতীতের হস্তিনাপুরের এক জাঠ চাষী। 

খুশবন্ত সিং তাঁর "ফ্রম প্যাসিফিস্ট শিখ টু মিলিট্যান্ট খালসা (শান্তিকামী শিখ থেকে সশস্ত্র খালসা)'' অধ্যায়ে জানাচ্ছেন, "পাঞ্জাবের ভীরু কৃষকের মাঝে গুরু গোবিন্দ সিং এই বোধ জারিত করেন যে, জ্ঞানের ঝাড়– দিয়ে কৃষক যেন তার ভীরুতার যত আবর্জনা পরিষ্কার করে।'' 

সত্যি বলতে ১৬৯৯ সনে খালসা গঠনের মাধ্যমে পাঞ্জাবে জাঠ কৃষকদের আধিপত্য সূচীত হয়। খালসা গঠনের পূর্বপর্যন্ত অসামরিক, নগরবাসী ক্ষত্রিয়রা ছিল শিখ ধর্মের নেতৃত্বে। কিন্তু জাঠ কৃষকেরা যখন দলে দলে শিখ ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে শুরু করলো, তখন তারা ক্ষত্রীদের হাত থেকে নেতৃত্ব নিয়ে নিলো এবং শিখধর্ম তার আজকের সমর-কুশল, যোদ্ধা-চারিত্র্য লাভ করলো।

এভাবেই শিখ সম্প্রদায়ের আদি জন-বিন্যাসও বদলে গেল বলে খুশবন্ত সিং মনে করেন। জগজিৎ সিং নামে এক গবেষক তার ১৯৮৫ সালের গবেষণাপত্র "পার্সপেক্টিভস অন শিখ স্টাডিজ''-এ জানাচ্ছেন যে মূলত: শিখ ধর্মে ধর্মান্তরিত হবার পরই এতদিনের দলিত জাঠ কৃষকদের সামাজিক সম্মান বেড়ে গেল এবং আজ তারাই পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা। 

জগজিৎ তাঁর গবেষণাপত্রের ৫৭ নং পাতায় বৃটিশ শাসক স্যার ডেনজিল ইববেটসনকে উদ্ধৃত করে আরো বলছেন, খালসায় যোগ দানের পর শিখ জাঠদের রাজনৈতিক গুরুত্ব এতটাই বেড়ে গেল যে, রাজপুত হবার কোন শখও তাদের আর রইলো না। কারণ রাজপুতদের সামাজিক মর্যাদা এতই বেশি ছিল যে কোনো জাঠেরই রাজপুত হিসেবে পরিচিত হবার আশা ছিল না। বরং শিখ ধর্মে ধর্মান্তর তাদের সামাজিক মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। 
উল্লেখ্য, সিন্ধুতে মুহাম্মদ বিন কাশিম যখন আক্রমণ করেন, তখন যোদ্ধা তবে সামাজিক স্তর-বিন্যাসে অবদমিত জাঠ সম্প্রদায়ের অনেকে কাশিমকে শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে স্বাগত জানিয়েছিলেন। 

বান্দা বাহাদুর: 

শিখ ধর্মের ইতিহাসে আর এক বড় বীর ও নেতা হলেন বান্দা বাহাদুর। গুরু নানকের হাতে ধর্মান্তরিত এই কৃষক পাঞ্জাবে কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন ও নিজ বিশ্বাসের প্রশ্নে শহীদ হন। 

গুরু নানকই বান্দাকে সিরহিন্দের মোগল প্রশাসক ওয়াজির খানকে শাস্তি দেবার দায়িত্ব দেন। এই মোগল প্রশাসক জোরাওয়ার (৯) ও ফতেহ (৭) সিং নামে দুই শিখ শিশুকে হত্যাও করেছিলেন। 

গুরুর আদেশে বান্দা দাক্ষিণাত্যের উত্তর থেকে পাঞ্জাব অবধি দীর্ঘ পথ পাড়ি দেন এবং সামানা ও সাধুরা নামে দুই নগরী আক্রমণ করেন। এরপর সিরহিন্দের  দিকে তিনি অগ্রসর হন এবং ছপ্পরছিরির যুদ্ধে সিরহিন্দ শহর আক্রমণ করেন। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে বান্দার এই বিদ্রোহও মূলত: মোঘল সরকারের বিরুদ্ধে এক কৃষক বিদ্রোহই ছিল। 

খুশবন্ত সিং বান্দা বাহাদুরের মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছেন: "এভাবেই মরলো বান্দা বাহাদুর- যিনি কিনা প্রথমে সন্ন্যাসের বৈরাগ্যে পার্থিব মোহ-মায়া পরিত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরে শান্তি ও নির্জনতার পথ পরিহার করে দরিদ্র কৃষককে অস্ত্রধারণ করে; বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এত বড় বিক্ষোভে সংগঠিত করেছিলেন যে, পরে আর সেই সাম্রাজ্যের ভিত কখনোই শক্ত হতে পারেনি।'' 

যদিও মহাপরাক্রমশালী মোগল শাসনের সাথে বান্দা শেষপর্যন্ত হেরে যান, তবু তিনি সাত বছরের কৃষক বিদ্রোহের মাধ্যমে দাক্ষিণাত্যের অর্ধেক অংশে জমির শ্রেণি চরিত্র বদলে দিতে সক্ষম হন। বান্দা বাহাদুর মালওয়া এবং জুল্লুন্দার দোয়াবের জমিদার পরিবারগুলোর জমি দরিদ্র চাষীদের ভেতর বিলিয়ে দিয়েছিলেন। বান্দা বাহাদুরের প্রশস্তি তাই রচনা করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

শেষ কথা:

বাংলায় নীল চাষ বিরোধী তিতুমীরের আন্দোলনই হোক বা পাঞ্জাবের শিখ কৃষকদের বিদ্রোহ; একটা বিষয় পরিষ্কার যে উপমহাদেশের বড় কৃষক বিদ্রোহগুলো গড়ে তুলেছে সাধারণ কৃষকেরাই। ভারত উপমহাদেশের ইংরেজি শিক্ষিত, চাকরি ও সুযোগ সন্ধানী মধ্যবিত্ত পশ্চিমের মার্ক্স-রুশো পড়ে যা করতে পারেনি, সাধারণ কৃষক কখনো আল্লাহর দুনিয়ায় জমিতে সবার সমান হক বা কখনো গুরুর নামে অনেক বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছেন। তাহলে পশ্চিমা তত্ত্ব অথবা নিজের সংস্কৃতি ও ধর্মকেই শোষণের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা- কোনটি বেশি কার্যকরী সে বিতর্ক এসেই যাচ্ছে। 

তবে ধর্মকে শোষণের বিরুদ্ধে ব্যবহার বা 'লিবারেশন থিয়োলজি'র একটি বিপদের দিক হচ্ছে সমাজে এটি আন্ত:সম্প্রদায় উত্তেজনা বাড়াতে পারে। শিখ কৃষকেরা গুরুর নামে শ্লোগান দিলে; বিজেপির মত দলগুলো পাল্টা যুক্তি দিতে পারে যে, উত্তর ভারতের সাধারণ মানুষের কাছে রামও প্রবল জনপ্রিয়। তবে রাম নামে শ্লোগান দিলে কি সমস্যা? এমনভাবেই প্রবলের যুক্তি উত্থাপিত হতে পারে পাকিস্তান, আফগানিস্থান বা বাংলাদেশেও। 

তাই উপমহাদেশের "ইংরেজি শিক্ষিত, বাম নেতৃত্ব'' কীভাবে সাধারণ কৃষক-শ্রমিকের বঞ্চণা ও ক্ষোভকে তাদের সংস্কৃতির প্রাণরসে সিক্ত করেই বহুত্ববাদী ও সমন্বয়বাদী পন্থায় সংগঠিত করবেন- সে ভাবনার ভার কিন্তু তাদেরই নিতে হবে।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.