বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যে বিপর্যয় আর রাজনীতিতে বিষাক্ত ঐতিহ্য রেখে গেলেন ট্রাম্প 

মতামত

মনোয়ারুল হক
20 January, 2021, 06:40 pm
Last modified: 20 January, 2021, 06:48 pm
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ত্যাগের প্রেক্ষিতে আজ এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যেখানে ধনী দেশগুলোর ঔষধ কোম্পানি আর সংস্থাটির কর্তৃত্বের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা মানছে না

ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে আজ শেষ রাত্রিযাপন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসাবে  পৃথিবীর ইতিহাসে আরেকটি নাম যুক্ত হলো- সেটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের। বিগত চার বছর বিশ্ব রাজনীতি পাল্টে দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একক বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকার জন্যে বিষ্ময়ের সঙ্গেই তার আলোচনা বহুকাল চলবে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নানান সময়ে পরাজিত বিজয়ী প্রেসিডেন্টের বিদায়বেলায় নানা ঘটনা ঘটেছে, বহু ক্ষেত্রেই নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বিজয়ী প্রেসিডেন্টের সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করেননি। এদের অনেকেই পরাজিত হওয়ার পর বিজয়ী প্রেসিডেন্টের হোয়াইট হাউসে শপথ অনুষ্ঠানে অংশও নেননি । যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ১৫০ বছর পর- উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এক পরাজিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতোই ভোট কারচুপির অভিযোগ এনেছিলেন। 

তবুও, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপত্তি হ্রাসে ট্রাম্পের পদক্ষেপগুলোর প্রভাব নিয়ে আলোচনার অবকাশ থেকেই যায়। তার এমন বহু কাজের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর বিধ্বংসী ছিল; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করা। এই সিদ্ধান্ত মাহামারীকালে স্বাস্থ্যখাতে জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দেওয়ার মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে এক নতুন অবস্থার সম্মুখীন করেছে।

মহামারীর প্রথমদিকে হু' থেকে ট্রাম্প তার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে যান। বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষটির প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে থাকেন। এর পরিণতিতে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে; ধনী দেশগুলোর ঔষধ কোম্পানিগুলো আর হু'র কর্তৃত্বের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা মানছে না। তাদের অনেকেই  আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের প্রয়োজনীয় গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে সংস্থাটির কাছে অনুমতির জন্যও যাচ্ছে না। 

ফলে টিকা উৎপাদনকারী পশ্চিমা দেশগুলো এবং তাদের সেই কোম্পানিগুলো সরকারের সহযোগিতায় ক্ষেত্রবিশেষে নিজেরাই সরাসরি অপর দেশের সঙ্গে চুক্তি করছে। যেমনটি অক্সফোর্ড টিকা উৎপাদনকারী সেরাম ইনস্টিটিউড অব ইন্ডিয়ার সঙ্গেই বাংলাদেশ সরকার চুক্তি করেছে ভারত সরকারের মাধ্যমে। বাংলাদেশের স্থানীয় কোম্পানি বেক্সিমকো সেরামের কাছ থেকে এদেশে বিপণনের চুক্তিও করে। ফলে এই টিকা নিয়ে চূড়ান্ত বাণিজ্যিক মনোভাব দেখা দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে। বাংলাদেশে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে যে, বিত্তশালীরা নানা অভিজাত ক্লাবসমূহের মাধ্যমে টিকা সংগ্রহ করছেন। ক্লাবের সদস্য ও তাদের পরিবার-পরিজন এসব টিকা কিনতে পারবেন।

অপরদিকে, গ্রামের দরিদ্র মানুষ কী ব্যবস্থায় টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন- তা এখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। আমাদের মতো দেশগুলোসহ স্বল্প ও মধ্য আয়ের সিংহভাগ দেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বল্পমূল্যে টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা জোরালো হয়ে ওঠেনি। বাণিজ্যিক চুক্তিগুলোর ফলাফল হচ্ছে আলোচিত দেশগুলোতে ধনী সম্প্রদায়ের টিকা প্রাপ্তির পথ সুগম হয়েছে।

ক্ষেত্রবিশেষে, বেসরকারি খাতে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবস্থা করা হচ্ছে সক্ষম দেশগুলোর বিত্তশালী মানুষদের জন্য। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সমতার ভিত্তিতে বণ্টনের উদ্যোগ- কোভ্যাক্স্ কর্মসূচিতে এই কোম্পানিগুলো তাদের উদ্ভাবিত প্রতিষেধকের প্রয়োজনীয় অনুমোদনের গ্রহণ করলে সংস্থাটি গরিব দেশগুলোতে বিতরণ করার ব্যবস্থা করতে পারতো। কিন্তু, ডোনাল্ড ট্রাম্পের হু' থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে হু' ক্রমান্বয়ে বাকি বিশ্বের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।  

এই যেমন কিছুদিন আগে কোভিড-১৯ এর উৎপত্তিস্থল চীনের উহান প্রদেশ হু'র একদল গবেষক গিয়েছিলেন সার্স কোভ-২ জীবাণুর উৎস অনুসন্ধানে । বেশ কিছুদিন দেশটি তাদের প্রবেশের অনুমতি আটকে রেখেছিল। একইসঙ্গে, হু'র স্বীকৃতি ছাড়াই নিজেদের উদ্ভাবিত টিকা বিশ্বের বহু দেশে পাঠাচ্ছে চীন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট গতবছর যখন চীন টিকা আবিষ্কারের ঘোষণা দেয় তখন তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, সেই ব্রাজিলই চীনে তৈরি টিকাদান শুরুর মাধ্যমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। 

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারো যুক্তি দেন, অন্যান্য দেশের অনুকরণেই তিনি চীনের টিকাগ্রহণ করার পক্ষে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হওয়ার কারণেই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 

হু'কে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছেন, হোয়াইট হাউজে শেষরাত কাটানো ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই বিধ্বংসী সিদ্ধান্তের ফলে তার উত্তরসূরি জো বাইডেনকে বেশ ভুগতে হবে। এ অবস্থায় পৃথিবীর জনস্বাস্থ্য খাতের বর্তমান ও নিকট ভবিষ্যতের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে কিনা- তা প্রশ্নযোগ্য হয়ে গেল।  

এছাড়া ,ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও তার শেষ ১০ দিনে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা জো বাইডেনের সরকারকে গভীর সংকটে ফেলবে। তার মধ্যে আছে তাইওয়ানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সম্পর্ক। এর ফলে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে চীন। পাশপাশি কিউবাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে মদতদাতা দেশ হিসেবে চিহ্নিতকরণ বাইডেন প্রশাসনকে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টায় বর বাধা হিসেবে কাজ করবে। তারসঙ্গে, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করার মাধ্যমে দেশটিতে একটি চরম মানবিক বিপর্যয়, ইরানের সঙ্গেও দেখা দেবে নতুন ধরনের সংঘাত পরিস্থিতি, এসব ঘটনা বাইডেন প্রশাসনকে যথেষ্ট ভোগাবে।

  • লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.