বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে কীভাবে?

মতামত

30 August, 2021, 12:15 pm
Last modified: 30 August, 2021, 01:51 pm
প্রশ্ন জাগে, নিম্ন আদালতগুলোতে কোনো সুঁতার টান নেই তো? নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি এখনো রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের হাতে। নির্বাহী বিভাগ বলে, এ সকল ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেওয়া হয়। সেই পরামর্শ কতটা অর্থপূর্ণ সে প্রশ্ন তোলা যায়।

চার্লস লুই দ্য মন্টেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫) অষ্টাদশ শতকের একজন ফরাসি বিচারক ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক দার্শনিক এবং সমাজতত্ত্ববিদ। তিনি ছিলেন ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্বের প্রধান উৎস। যার মতবাদ পৃথিবীর বহু সংবিধানে প্রয়োগ করা হয়েছে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণের জন্য।মন্টেস্কু ছোটবেলা থেকেই রাজার স্বৈরশাসন দেখে বড় হয়েছেন যেখানে জনগণের স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না। ১৭৪৮ সালে প্রকাশিত দ্য স্পিরিট অফ লজ গ্রন্থে মন্টেস্কু ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের পূর্ণ রূপ হাজির করেন। 

আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বলতে বোঝায় রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন, শাসন ও বিচার ক্ষমতা পৃথক ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের হাতে অর্পণ করা যাতে এক বিভাগ অন্য বিভাগের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে। মন্টেস্কুর এই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ চিন্তা আধুনিক রাষ্ট্রধারণায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। পৃথিবীর বহু দেশ তাদের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই দর্শন কাজে লাগিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  সংবিধানের খসড়া তৈরির ক্ষেত্রে মন্টেস্কুর রাষ্ট্রচিন্তা প্রভাবিত করেছিল। আমাদের দেশের সংবিধানেও আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ স্বতন্ত্ররূপে কাজ করবে এবং কেউ কাউকে হস্তক্ষেপ করবে না, বলা আছে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থার কথা আলাদাভাবেও সংবিধানে বলা আছে।

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণে রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ সংসদ, সরকার এবং আদালত কখনই সম্পূর্ণ আলাদাভাবে কাজ করতে পারে না। দরকার হয় পারস্পারিক সমন্বয় ও ভারসাম্যের। এই ভারসাম্যের নীতি দ্বারাই আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। ভারসাম্য সব সময় সরল পথে পরিচালিত হয় না। নির্বাহী বিভাগ সর্বদাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে বা করতে চায়- এ অভিযোগ পুরাতন। সরকার পরিচালনার বহু ক্ষেত্রে সরকারকে অনেক কৌশলী ভূমিকা নিতে হয়। অনেক সময় মানুষের অধিকার বা মানবাধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সকল ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ যেন প্রতিবন্ধক হয়ে না ওঠে তার জন্য সরকার বিচার বিভাগের ওপর একটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাজারটা উপায় আছে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উপায়গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রাষ্ট্রের স্তম্ভ তিনটি কীভাবে পরিচালিত হবে তা আমাদের সংবিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে আইন তৈরি করে নেওয়ার কথাও সংবিধানে বলা আছে। আমাদের নির্বাহী বিভাগ রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে বিচারপতি মনোনয়ন ও নিয়োগ দিয়ে থাকে। যদিও আমাদের সংবিধান বিচারপতি নিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন তৈরি করার কথা বলেছে। আইনটি আজও করা হয় নি। এক্ষেত্রে ঝুঁকি দুটো। কোন আইনী বাধ্যবাধকতা না থাকায় নির্বাহী বিভাগ খেয়াল খুশি মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যার ফলে কোনো অযোগ্য মানুষ প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেতে পারে। আর অন্যটি হলো, এর ফলে বিচার বিভাগের উপর সরকারের একটা নিয়ন্ত্রণ তৈরি হতে পারে। আইনটি করা গেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটবে।

আমাদের দেশের বিচার প্রক্রিয়ার প্রাথমিক অথচ মৌলিক কাজটি করেন আমাদের নিম্ন আদালতের বিচারকগণ। যাকে আমরা বলি বিচারিক আদালত। উচ্চ আদালত সমূহ বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্তের সঠিকতা বা বেঠিকতা বিশ্লেষণ করে থাকেন। আদালত প্রত্যয়টির সাথে মানুষের নিরাপত্তার বোধ ও শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। মানুষকে মানসিকভাবে শক্ত যোগায়। কেউ আমার প্রতি অন্যায় করলে আমি প্রতিকার চাইতে পারি। সে কারণে মানুষ আদালতকে বিশেষ সমীহ করে থাকে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থাপিত হলেই কেউ অপরাধী হয়ে যায় না। তদন্দ ও বিচার প্রক্রিয়ার শেষেই বলা যাবে অভিযুক্ত ব্যাক্তিটি দোষী না নির্দোষী। এবং যতদিন তদন্ত ও বিচার কাজ চলবে ততদিন একজন মানুষের জামিন পাওয়া তার সাংবিধানিক অধিকার।  যদি না কেউ জামিনে মুক্ত হয়ে তদন্ত ও বিচার কাজে 'মারাত্মক' হুমকির কারণ না হয়।

নিম্ন আদালতের এই জামিন দেওয়া এবং না দেওয়া নিয়ে অনেক ঘটনা সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। অভিযোগ আছে সমাজের উচ্চবিত্ত বা ক্ষমতাসীনদের জামিন প্রাপ্তিতে কোন বাধা নেই। যত বিপত্তি সাধারণ মানুষ ও ক্ষমতাহীনদের। সংবাদপত্রে দেখলাম, একটি জামিন আবেদনের শুনানী হবে ২৩ দিন পর। কেন এমনটা হলো? এই ঘটনা যখন জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি হলো তখন উচ্চ আদালতকে এগিয়ে আসতে হলো। এখন সেই একই আদালত জামিন শুনানীর দিন ১৫ দিন এগিয়ে এনে ৩১ আগস্ট নির্ধারণ করেছে। প্রশ্ন জাগে, নিম্ন আদালতগুলোতে কোনো সুঁতার টান নেই তো? নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি এখনো রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের হাতে। নির্বাহী বিভাগ বলে, এ সকল ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেওয়া হয়। সেই পরামর্শ কতটা অর্থপূর্ণ সে প্রশ্ন তোলা যায়।

স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় উপমহাদেশের তিনটি দেশ কে কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে তা বলা মুশকিল। গত ২৫ আগস্ট ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ তিনজন নারীসহ ৯ জন বিচারপতিকে সে দেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম ঐ ৯ জন বিচারকের তালিকা চূড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠায়। রাষ্ট্রপতি যেহেতু এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সে কারণে প্রস্তাবটি সরকারের কাছে পাঠায়। সেখান থেকে প্রস্তাবটি ফেরত আসলে রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিয়ে থাকেন।

ভারতীয় সংবিধানের ১২৪ (৩,৪,৫) ধারায় বিচারপতি নিয়োগের যোগ্যতা, বয়সসীমা ও নিয়োগ প্রক্রিয়া বলা হয়েছে। বিচারপতির যোগ্যতা ও বয়সসীমার সাথে আমাদের মিল রয়েছে। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়াটা একেবারেই ভিন্ন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে জ্যেষ্ঠতার বিচারে পরের ৪ জন বিচারপতিসহ মোট ৫ জনকে নিয়ে কলেজিয়াম গঠন করা হয়। এরাই বিচারপতি নিয়োগের তালিকা চূড়ান্ত করেন। এই প্রক্রিয়া ক্ষমতাসীনদের একটু অস্বস্তিতে ফেলে। এখানে তাদের কিছু করার থাকে না। কিছু করা না গেলে বিচারবিভাগের নিয়ন্ত্রণের বাসনা অপূর্ণ থেকে যায়। ক্ষমতাসীন বিজেপি ২০১৪ সালে সংবিধানের ১২৪ ধারা সংশোধনের জন্য একটা বিল নিয়ে আসে। সুপ্রিম কলেজিয়ামের পরিবর্তে একটি কমিশন গঠনের কথা বলা হয়। যে কমিশনে তিনজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির সাথে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী ও দুইজন সরকার ও বিরোধীদল মনোনীত ব্যাক্তি থাকবেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো বিজেপির এই প্রস্তাবে কংগ্রেস সমর্থন জানায় এবং সংসদে সংশোধনী বিলটি পাস করে।

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সংসদে পাস হওয়া বিলটি বাতিল করে দেয় এবং কলেজিয়াম পদ্ধতি পুনর্বহাল করে। সুপ্রিম কোর্ট সমগ্র প্রক্রিয়াটি উন্মুক্ত করে দেয়। ভারতীয় নির্বাহী বিভাগ প্রার্থী বিচারকের প্রাথমিক তালিকা সুপ্রিম কলেজিয়ামে পাঠায়। কলেজিয়াম সম্ভাব্য বিচারকের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে দেয়। যে কেউ তালিকা দেখতে পারে। কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে তা জানাতেও পারে। এবারে নিয়োগ পাওয়া কর্নাটক হাইকোর্টের নারী বিচারপতি বি ভি নাগরত্ম ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি হতে পারেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রে সাধারণত জ্যেষ্ঠতা লংঘন করা হয় না। সেই বিচারে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো হিসাব করে বলেছে, বি ভি নাগরত্ম ২০২৭ সালে প্রথম ভারতীয় নারী যিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হবেন। যা এই উপমহাদেশে প্রথম এমন কি সমগ্র বিশ্বেও বিরল।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রাতারাতি প্রতিষ্ঠা হয়ত সম্ভব নয় কিন্তু চেষ্টাটা জারি রাখতে হবে। সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়শই বিচারবিভাগের স্বাধীনতার কথা বলেন কিন্ত প্রক্রিয়াটা কী হবে সেটা কেউ স্পষ্ট করেন না। আইনের কী কী পরিবর্তন আনতে হবে বা নতুন কী ধরনের আইন প্রণয়ন করতে হবে সেটাও কেউ বলেন না। এটা খুবই জরুরি। আদালতকে মানুষের আস্থায় আনতে হবে পূর্ণ মাত্রায়। নিম্ন আদালত হতে উচ্চ আদালত পর্যন্ত মানুষ যেন নিশ্চিত হতে পারে এখানে সে ন্যায়বিচার পাবে। মানুষের মানসিক নিরাপত্তা বোধের মূল্য অনেক। আদালতকে মানুষ ন্যায়ালয় হিসেবেই দেখতে চায়।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.