জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধু যা ভাবতেন
বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যের এক বিপুল ভাণ্ডার। খুব ছোট সবুজ শ্যামল একটি দেশ যার জীববৈচিত্র্যের রয়েছে বিশেষ এক ধরণ। সকলের অগোচরেই এই বিশাল জীববৈচিত্র্য সর্বদাই ভূমিকা রেখে চলেছে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়। কিন্তু ক্রমাগত দূষণ, দুর্নীতি, অসচেতনতা, অসামাজিক কার্যকলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে আমরা মানুষেরাই প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলেছি এই বৈচিত্র্যের সমাহারকে। তাই প্রয়োজন হয় বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্য যথার্থ আইন প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন, যেমনটা করেছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই এই দেশের সাধরণ জনতাকে নিয়েই শুধু নয়, তিনি সর্বদা সচেতন ছিলেন এ দেশের জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ নিয়েও। আজ এত বছর পরেও তাই যে প্রাণিসম্পদ ও উদ্ভিদকূল আমাদের পরিবেশকে নিরন্তর রক্ষা করে চলেছে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে, তাদের বাঁচাতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অনস্বীকার্য এবং অপরিহার্য।
জীববৈচিত্র্য কী
সাধারণত নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলে বা বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে বসবাসকারী অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণিগোষ্ঠীকে এক সাথে জীববৈচিত্র্য বলা হয়।
বাংলা জীববৈচিত্র্য শব্দটির ইংরেজি অর্থ হল Biodiversity, শব্দটি 'Biological' ও 'Diversity' এই দুটি শব্দের সংযুক্তিকরণের ফলে সৃষ্টি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৬৮ সালে বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক 'রেমনড দাসমান' "একটি ভিন্ন ধরণের দেশ" নামক গ্রন্থে প্রথম জীববৈচিত্র্য শব্দটি ব্যবহার করেন। অবশ্য কেউ কেউ বলেন শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন মার্কিন জীববিজ্ঞানী 'থমাস লাভজয়'। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত 'পরিবেশ ও বিকাশ' সম্পর্কিত 'বসুন্ধরা সম্মেলনের' জীববৈচিত্র্য শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার পরেই সারা বিশ্বে এটি ব্যপকভাবে প্রসার লাভ করে। জৈব বৈচিত্ৰ্যকে প্ৰধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়-
জিনগত বৈচিত্ৰ্য
প্ৰজাতি বৈচিত্ৰ্য
বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য।
পরিবেশের ওপর জীববৈচিত্র্যের ভূমিকা
জীববৈচিত্র্য অর্থাৎ জীবিত উদ্ভিদ এবং প্রাণী প্রজাতির বৈচিত্র্যতা ও তাদের আন্তঃসম্পর্কিত জটিল বাস্তুতন্ত্র প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে আমাদের পরিবেশকে। জলে কিংবা স্থলে, অরণ্যে বা মরুভূমিতে, বরফ আবৃত কঠিন পর্বতমালা কিংবা অতল সাগর সর্বত্রই বিস্তৃত থাকা জীবজগৎ তার আকার-আকৃতি, খাদ্যধরণসহ জীবনযাপনের নানা বিভিন্নতার মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছে এই পৃথিবী। মূলত এই বিশাল জীববৈচিত্র্যই গড়ে তুলেছে পৃথিবীর বৈচিত্র্যতা। তারাই প্রাচীনকাল থেকে নানা সভ্যতার সময় পার করে ভারসাম্য বজিয়ে রেখেছে পরিবেশের। পরিবেশের সৌন্দর্যের সূচক এই জীববৈচিত্র্য। তাছাড়াও জীববৈচিত্র্যের আছে উপভৌগিক ব্যবহার, যেমন- খাদ্য, ঔষধ ও অন্যান্য উপাদান। এছাড়াও আছে উৎপাদনশীল ব্যবহারিক মূল্য, নৈতিক মূল্য, সামাজিক মূল্যসহ বিবিধ।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম একটি সার্বভৌম দেশ। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপের সিংহভাগ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান। জীববৈচিত্র্যের বিচারে বাংলাদেশ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত 'এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফ্লোরা এন্ড ফনা অব বাংলাদেশ' কোষগ্রন্থে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশিত আছে। যেখানে বাংলাদেশের এ পর্যন্ত উল্লিখিত উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির প্রাথমিক তথ্যাদি সন্নিবেশিত হয়েছে। বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্যে মোট প্রজাতির সংখ্যা ১২০০০ এর বেশি।
উদ্ভিদঃ উর্বর পলিমাটির জমি এবং উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যে খুবই সমৃদ্ধ। বাংলাদেশে আছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন 'সুন্দরবন'। এছাড়াও আছে গ্রীষ্মমন্ডলীয় চিরসবুজ ও আধা চিরসবুজ বন। এদেশে উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৬ হাজারের ওপরে। এর মাঝে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ ও খাদ্যশস্য অসংখ্য যা একাধারে রক্ষা করে চলেছে এদেশের পরিবেশের ভারসাম্য এবং যোগান দিচ্ছে অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নয়ন। যার দরুন বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
প্রাণীঃ দেশের উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু নিম্নশ্রেণীর প্রাণী, বিশেষত কীটপতঙ্গের সংখ্যাবৃদ্ধির অত্যন্ত অনুকূল। অমেরুদন্ডী প্রাণীর সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশিত না হলেও মেরুদন্ডীদের (মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী) তালিকা প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে বলা যায়। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্বাদু ও লোনা পানির কাঁকড়া, গলদা ও বাগদা চিংড়ি বাংলাদেশে পর্যাপ্ত। বাংলাদেশের বনভূমি ও জলাভূমি মেরুদন্ডী প্রাণীতে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের প্রায় ১,৬০০ প্রজাতির মেরুদন্ডীর মধ্যে রয়েছে ৬৫৩ প্রজাতির মাছ (অভ্যন্তরীণ ২৫৯ ও সামুদ্রিক ৪০২), ৩২ প্রজাতির উভচর, ১২৬ প্রজাতির সরীসৃপ (অভ্যন্তরীণ ১০৯, সামুদ্রিক ১৭), ৬২৮ প্রজাতির পাখি (স্থায়ী ৩৮৮, পরিযায়ী ২৪০) ও ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী (অভ্যন্তরীণ ১১০, সামুদ্রিক ৩)। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবং পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গত শতাব্দীতে ১ ডজনেরও বেশি মেরুদন্ডী প্রাণী বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে। বর্তমানেও খুব দ্রুত কমছে বাংলাদেশের সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংখ্যা।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
যেহেতু বাংলাদেশ ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে অত্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত একটি দেশ তাই এদেশের প্রকৃতি ও তার মানবসম্পদকে রক্ষার একমাত্র উপায় হল এদেশের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করা। ক্ষুদ্র থকে বৃহৎ প্রতিটি উদ্ভিদ ও প্রাণীর রয়েছে গুরুত্ব। নিজ নিজ বাস্তুসংস্থানে তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ভূমিকায় অবতীর্ণ। দেশের মানুষকে বাঁচাতে প্রথমে বাঁচাতে হবে তার প্রকৃতিকে। আর এদেশের প্রকৃতিকে বাঁচাতে প্রথমেই গুরুত্ব দিতে হবে সুন্দরবন সহ সকল বন্য পরিবেশকে ,যার মাধ্যমে টিকে থাকবে অসংখ্য প্রাণী। এভাবেই রক্ষা হবে পরিবেশের ভারসাম্য। শুধু পরিবেশগত কারণেই না, এদেশের জীববৈচিত্র্যকে বাঁচাতে হবে দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলেও। অসচেতনতা এবং নানাবিধ কারণে প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীবকূল। তাই তাকে বাঁচাতে নিতে হবে সঠিক আইনের পদক্ষেপ। দেশের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে ছিলেন সদা তৎপর। দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তাঁর গৃহিত নানা পদক্ষেপ প্রতি মুহূর্তেই প্রমাণ দেয় তাঁর দূরদর্শিতা ও শ্রেষ্ঠত্বের।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধুর অবদান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাজনীতির মহানায়ক। ইতিহাসের পাতায় উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে অন্যতম। একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের সকল গুণাবলী তাঁর মাঝে দৃশ্যমান। আমরা আজ যা ভাবছি, তিনি তা ভেবেছেন সেই সময়ে বসে। আজ আমাদের যে উপলব্ধি, তিনি সেই সময়ে তা যথার্থ প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি যেন অতীতে বসেই দেখেছিলেন ভবিষ্যতকে!
তাঁর এক একটি চিন্তা, স্বপ্নকে স্পর্শ করলে প্রমাণ মেলে তাঁর দূরদর্শিতার।
প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা ছিল তার দূরদর্শী কর্মকান্ডের অন্যতম। সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশের গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করেছিলেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধু কৃষি,বন,সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্ব লাভ করেন।
সদ্য স্বাধীন একটি দেশের সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তন্মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রত্যক্ষ অবদানের কথা নিচে উল্লেখ করা হলঃ-
# যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি বন, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে ১৯৭৩ সালে 'Bangladesh Wildlife (Preservation) Order 1973 অধ্যাদেশ জারি করেন।
# দেশের বন্যপ্রাণী বাঁচাতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার তাগিদে ১৯৭৪ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করেন। মূলত এই আইনের মাধ্যমে দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়।
এ আইনটির মাধ্যমে Bangladesh Wildlife Advisory Board গঠনসহ ন্যাশনাল পার্ক ঘোষণা ও প্রাণী অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
এ আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা ধরনের শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা। ভ্রাম্যমাণ আদালত স্থাপন, সরকারি কর্মকর্তাদের দায়-দায়িত্বসহ বন্যপ্রানী সংরক্ষণের বিভিন্ন বিধিবিধান বর্ণনা করা হয়েছে আইনটিতে। এ আইনের তফসিলগুলোতে এমন কিছু বন্যপ্রাণীর নাম উল্লেখ আছে, যেগুলো শিকার করতে সরকারের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হবে। আবার তফসিলে এমন কতিপয় প্রাণীর নাম আছে, যেগুলো কোনোভাবেই শিকার করা যাবে না।
** প্রথম তফসিলের দ্বিতীয় অংশে কতিপয় সরিসৃপ, পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর নাম আছে। যেমন: কোলা ব্যাঙ, সবুজ ব্যাঙ, হলুদ পাহাড়ী কাছিম, পিয়ং হাঁস, রাংগামুরি, রাজহাঁস, জলার চা পক্ষী, ডুবুরি, বন্য শূকর ইত্যাদি শিকার করতে সরকারের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হবে। কোনো বন্যপ্রাণীর বৃদ্ধি যদি সেই এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় হুমকি হিসেবে দেখা দেয় অথবা কোনো বন্যপ্রাণী যদি মানুষের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ হয় (যেমন: মানুষখেকো বাঘ কিংবা বন্য খ্যাপা হাতি) তবে সেই ধরনের প্রাণী হত্যা করা যাবে।
** আইনের দ্বিতীয় তফসিলে কতিপয় প্রাণীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলোর চামড়া আইনগত সার্টিফিকেট ছাড়া কোনোভাবেই দখলে রাখা যাবে না। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি সরকারের পূর্বানুমতি ব্যতীত ঘরের শোভাবৃদ্ধি করার জন্য হরিণ বা বাঘের চামড়া দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখেন তবে তা বেআইনী হবে।
** তৃতীয় তফসিলে ১৮ প্রজাতির সরিসৃপ, ৪৬১ প্রজাতির পাখি এবং ৬৭ প্রজাতীর স্তন্যপায়ী প্রাণীর নাম উল্লে¬খ করা হয়েছে, যেগুলো সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হবে এবং এগুলো কোনোভাবেই শিকার, হত্যা বা ধরা যাবে না। এ প্রাণীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাঘ, চিতাবাঘ, ভালুক, বনরুই, উল্লুক, লজ্জাবতী বানর, হাতী, হনুমান, চিত্রা হরিণ, মায়ামৃগ, কুমির, শকুন, বাজ, ধনেশ, মদন টাক, নীলকণ্ঠ, বেগুনি কবুতর, লাল ঘুঘু, ময়ুর, কোকিল ইত্যাদি।
** আইনটির ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সরকারের অনুমতি ছাড়া বন্যপ্রাণী আমদানি বা রপ্তানি করতে পারবে না।
** ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি পেশা বা ব্যবসা হিসাবে বন্যপ্রাণী ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না, করলে ছয় মাসের জেলসহ জরিমানা হবে। আবার কোনো ব্যক্তি আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা ফাঁদ বা অন্য কোনো উপায়ে বন্যপ্রাণী শিকার করলে তার এক থেকে দুই বছরের জেলসহ জরিমানা হবে।
বিশ্বের প্রেক্ষাপটে সরাসরি সংবিধানিক আইনের মাধ্যমে পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় এমন পদক্ষেপ গ্রহণ বঙ্গবন্ধুর এক অসামান্য কীর্তি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ জরুরিভিত্তিতে এসব বন্যপ্রাণী ও পাখি সংরক্ষণের জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি।
# বঙ্গবন্ধু নদ-নদী, খাল-বিল, প্রকৃতি-পরিবেশকে খুব বেশি ভালোবাসতেন। নদীর প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম ভালবাসা। যার প্রমাণ মেলে তাঁর বিভিন্ন ভাষণ ও লেখনীতে। তাঁর বিভিন্ন ভাষণ ও লেখনীতে নদী অভিজ্ঞান ও নদী দর্শন ফুটে উঠেছে অত্যন্ত সাবলীলভাবে। ১৯৭২ সালে 'যৌথ নদী কমিশন' গঠন করে তিনিই প্রথম পানি কূটনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন।
# সর্বপ্রথম তিনিই দেশের হাওর-বাঁওড়, নদ-নদী ও অন্যান্য জলাভূমি উন্নয়নের রূপলেখা প্রণয়ন করেন। বঙ্গবন্ধুর লেখা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে মধুমতী নদীর প্রসঙ্গ এসেছে একাধিকবার।
# স্বাধীনতা লাভের পরপরই তিনি নদীর নাব্যতা সংকট দূরীকরণে ড্রেজার সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া নৌপথ উন্নয়নের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি বহুমাত্রিক কর্মপরিকল্পনা হাতে নেন।
# বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে Water Pollution Control Ordinance, 1973 জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সূচনা করেন।
# তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৫ সালে দেশে 'ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম' প্রতিষ্ঠিত হয়।
# Plant Protection Agreement for the Asia and Pacific Regions (৪ ডিসেম্বর, ১৯৭৪ তারিখে স্বাক্ষরিত)। এর লক্ষ্যও এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে উদ্ভিদের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ এবং রোগের অনুপ্রবেশ ও বিস্তার রোধ।
# স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে খুব কম সময় পেলেও তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ। এরই ফলে তিনি বৃক্ষরোপণে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গণভবন, বঙ্গভবনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে গাছ লাগান। পাশাপাশি তিনি দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের ফলে বৃক্ষ সম্পদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তা পূরণ করার জন্য সারা দেশে বৃক্ষরোপণ অভিযান শুরু করেন। তিনি মহাসড়কের পাশে, বাসাবাড়ির চারপাশে, পতিত জমিতে সবাইকে বৃক্ষরোপণের আহ্বান জানান।
# তিনি ১৯৭২ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় বন্ধ করে গাছ লাগিয়ে সুদৃশ্য উদ্যান তৈরি করেন, যার নাম দেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এখনো নগরবাসীর প্রাণ ভরে সতেজ শ্বাস নেয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
# সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙালির হাত ধরেই সূচনা হয় উপকূলে বনায়ন কর্মসূচি। যেটাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সার্বিক বনায়ন বৃদ্ধিতে অনেকদূর এগিয়েছে।
# প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে তিনি বাংলাদেশ বনশিল্প করপোরেশনকে জাতীয়করণ করেন এবং এর আধুনিকায়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
# বঙ্গবন্ধু সরকার পরিবেশের পাশাপাশি গ্রামের সার্বিক পরিবেশ ও এর উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় এক সামষ্টিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ছিল কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষিতে সেচ ও সারের ব্যবহার বৃদ্ধি, শস্য উৎপাদনের বিকেন্দ্রীকরণ, গ্রাম সমবায়, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, গ্রামীণ সার্বিক পরিবেশ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
# দেশব্যাপী এখন যে বৃক্ষ আন্দোলন, প্রতি বছর জুন মাসে বৃক্ষরোপণের যে উৎসব এবং বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়, তার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন বঙ্গবন্ধুই।
# তাঁর লেখা 'কারাগারের রোজনামচা' বইয়ে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সালের কারাস্মৃতি থেকে জানা যায়, জেলখানার বাগান ও গাছপালার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। জেলখানায় অবাধে প্রবেশ করা পশুপাখি তার সাথী হয়ে গিয়েছিল!
জেলের মধ্যে বন্দি থেকেও তিনি প্রকৃতি-পরিবেশকে ভালোবেসেছেন। প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষায় টান অনুভব করেছেন।
# তিনি ১৯৭৪ সালে বৃক্ষরোপণ অভিযান উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে বিভিন্ন আহ্বান জানান। এ আহ্বানে তিনি গাছ লাগিয়ে বৃক্ষসম্পদ সম্প্রসারণের কথা বলেন। তিনি বৃক্ষরোপণের সময় ও পরবর্তীতে অধিক বৃক্ষরোপণ করে সরকারের প্রচেষ্টাকে সাফল্যমন্ডিত করার কথা বলেন। তিনি দেশের জনপ্রতিনিধি, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, সমাজসেবী ও আপামর জনসাধারণের কাছে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং সবাইকে এগিয়ে আসতে বলেন। তার দেখানো পথেই দেশের কোটি কোটি মানুষ বৃক্ষ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখে। বৃক্ষপ্রেমে সবাই উদ্বুদ্ধ হয়। তিনিই সর্বস্তরে বৃক্ষরোপণের আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এখন বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন বেড়েই চলেছে। এটা বঙ্গবন্ধুরই অবদান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনেক নারিকেল গাছ বঙ্গবন্ধুর হাতে লাগানো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় তার স্মৃতিবিজড়িত কয়েকটি নারিকেল ও হিজলগাছ দেখা যায়।
# তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব তখন থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন! এখন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ যে বিশ্বে প্রশংসা কুড়াচ্ছে, এর শুরুটা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই।
# জাতির পিতা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি মাটি, পানি ও বায়ুদূষণ যাতে না ঘটে; সে ব্যাপারে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
# তিনি বঙ্গীয় বদ্বীপের এই উর্বর মাটি যাতে কোনোভাবেই দূষিত না হয়; সে ব্যাপারে জমিতে কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের কথা বলতেন।
# ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বৃক্ষরোপণের যে ডাক দিয়েছিলেন, তার এই দূরদর্শী ভাবনা বর্তমান সময়ে এসে কতটা সমসাময়িক, যুগোপযোগী ও গ্রহণযোগ্য; তা বলে শেষ করা যাবে না। কেননা, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে ভুগছে পুরো বিশ্ব। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় দেশগুলো রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারির দিকে। তবু বাংলাদেশ নিজম্ব প্রচেষ্টায় জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় কাজ করে যাচ্ছে।
# সমুদ্র ও তার জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য ও বঙ্গবন্ধু নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন যেগুলো সেই সময়ের চিন্তা ভাবনার তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল।
দেশের প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সামাজিক আন্দোলন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ কালের গন্ডি পেরিয়ে তাঁকে দিয়েছে অমরত্বের গৌরব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের নদ-নদী রক্ষা, বৃক্ষসম্পদ বৃদ্ধিসহ সর্বোপরি প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণের যে ডাক দিয়েছিলেন, তা দেরিতে হলেও সফলতা পেয়েছে। এসব কাজে প্রকৃতি-পরিবেশপ্রেমীদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সময়ে চালু করা হয়েছে জাতীয় পরিবেশ পদক, বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ করজারভেশন, বঙ্গবন্ধু নদী পদক ইত্যাদি।
এ ছাড়া গত আড়াই দশকে প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণে বহু নীতি, আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছে ১৮(ক) অনুচ্ছেদ, যেখানে বলা হয়েছে—'রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা বিধান করিবেন।'
যদিও পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশকে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের 'চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ' পুরস্কার পেয়েছেন।
উপসংহার
জাতির পিতা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'-এর শুরুতে লিখেছেন, 'একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।'
রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান একটি জাতিকে শুধু স্বাধীনতার স্বপ্নই দেখিয়েছিলেন না, বরং স্বাধীন দেশে একটি সুন্দর, মনোরম, জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ একটি পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে যাবতীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা সময়ের তুলনায় ছিল অনেক এগিয়ে, যা তাঁকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিল নতুন আঙ্গিকে, যা তাঁকে বারবার প্রমাণ করেছে কেন তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, কেন তিনি সর্বসেরা রাষ্ট্রনায়ক। বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের সকলের তাই উচিৎ তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করা। তাঁর গৃহীত সকল পদক্ষেপ সঠিকভাবে পরিচালনা করে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তবেই তাঁর দেখা স্বপ্ন সত্যি হবে। সবশেষে কবির ভাষায় বলতে হয়-
"যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।"
লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়